মরমি কবি শাহ ইসকন্দর মিয়ার ভাগ্যে জোটেনি রাষ্ট্রীয় সম্মাননা

মোহাম্মদ নওয়াব আলী
001পীর মোহাম্মদ শাহ ইসকন্দর মিয়া গানের জগতে অতি সুপরিচিত নাম। তিনি সুপরিচিত গীতিকার। এ যাবত প্রায় তিন হাজারের বেশি গান রচনা করে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছেন। তাঁর বেশির ভাগ গানই পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়েছে। দেশ-বিদেশের অসংখ্য বাউল শিল্পী তাঁর গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। বাউলদের মুখে মুখে তাঁর গানের অংশ বিশেষ প্রতিনিয়ত শুনা যায়।
বহুগ্রন্থ রচয়িতা মরমি সাধক বাউল কবি পীর মোহাম্মদ শাহ ইসকন্দর মিয়া ১৯৩৫ সালের ১৫ জুন সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর উপজেলার পাইলগাঁও ইউনিয়নের তেরাউতিয়া মোকামবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহ মোহাম্মদ আব্দুল হামিদ পীর ও মাতা সৈয়দা মিরজান বিবি।
বৃহত্তর সিলেটের সুনামগঞ্জ গানের একটি সমৃদ্ধ উর্বর জনপদ। এ জনপদে হাছন রাজা, রাধারমন দত্ত, ফকির দূর্বিন শাহ, শাহ আবদুল করিমের মত প্রতিথযজ্ঞা বাউল সাধকদের জন্ম, যারা সগৌরবে সংগীতের জগতে আপন আলোয় দিপ্তীমান। তাদের উত্তরসুরী পীর মোহাম্মদ শাহ ইসকন্দর মিয়া তাদেরই পথ অনুসরণ করে সংগীতের এই সুন্দর ভুবনে পা বাড়ান। ইতিপূর্বে একজন সার্থক গীতিকার হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সম হয়েছেন।
গানপাগল পীর মোহাম্মদ শাহ ইসকন্দর মিয়া কৈশোর বয়সেই বাউল গানের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েন এবং গান লিখতে শুরু করেন। প্রবাস জীবনের শত ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে ভাবুক ইসকন্দর মিয়া সংগীত চর্চা চালিয়ে যান নীরবে নিভৃতে। তাঁর বিশ্বাস ছিল মানুষের মনের কথা সুন্দর করে উপস্থাপন করা যায় সংগীতের মাধ্যমে। স্রষ্টার সান্বিধ্য লাভ করা যায় সংগীত সাধনার মাধ্যমে। তাই তিনি মানুষের মনের কথা বলার জন্য। অধরাকে ধরার জন্য বেছে নেন সংগীতের এই শক্তিশালী মাধ্যম। আর কর্মব্যস্ততাকে ফাঁকি দিয়ে ভাবের গভীরে চলে যান এবং লিখতে থাকেন অনবরত।
মরমি কবি ইসকন্দর মিয়ার এ যাবত প্রকাশিত গ্রন্থগুলো হলো ইসকন্দর গীতি ১ম খণ্ড (অক্টোবর ১৯৮৯), ইসকন্দর গীতি ২য় খণ্ড (জানুয়ারি ১০৯০)। বইগুলোর মুদ্রণ সংখ্যা শেষ হলে পরবর্তীতে ইসকন্দর গীতি প্রথম খণ্ড গান সংখ্যা ১০১টি (ফেব্র“য়ারি ২০০৩), ইসকন্দর গীতি ২য় ও ৩য় খণ্ড গান সংখ্যা ২২৯টি, ইসকন্দর গীতি ৪র্থ ও ৫ম খণ্ড গান সংখ্যা ২৮৩টি (মে ২০০৩), ইসকন্দর গীতি ৬ষ্ঠ, ৭ম ও ৮ম খণ্ড গান সংখ্যা ৪৩৯টি (আগস্ট ২০০৩), ইসকন্দর গীতি ৯ম, ১০ম, ১১তম, ১২তম খণ্ড গান সংখ্যা ৫৬১টি (মে ২০০৪), ইসকন্দর গীতি ১৩তম খণ্ড গান সংখ্যা ২৮৬টি (ফেব্র“য়ারি ২০০৬) প্রকাশিত হয়। এছাড়া বাংলাদেশ ও বিদেশের অসংখ্য বই, পুস্তক, ম্যাগাজিন, সিডিতে তাঁর গান ও জীবনী প্রতিদিনই ছাপা হচ্ছে।
তিনি ২০০৬ সালে অর্জন করেছেন ইতিহাসবিদ ড. মুমিনুল হক একাডেমি ইউকে এর এ্যাওয়ার্ড। মহাকবি সৈয়দ সুলতান সাহিত্য ও গবেষণা পরিষদের মরমি সাহিত্য পদক। পাইলগাঁও বিএন উচ্চ বিদ্যালয় তাকে এক বর্ণাঢ্য সংবর্ধনা প্রদান করে। তিনি যুক্তরাজ্যের সিলেট একাডেমির পৃষ্ঠপোষক।
তাঁর দ্বিতীয় ছেলে মোহা. ইউছুফ মিয়া নুনু পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে লেখালেখির জগতে চলে এসেছেন। ইতিপূর্বে তাঁর প্রকাশিত বই- সুর লহরী ১ম থেকে ৪র্থ খন্ড, মেঘ বৃষ্টি ও প্রেম কুঞ্জে প্রকাশিত হয়েছে। গান ও কবিতার এ বইগুলো পাঠক সমাদৃত হয়েছে।
ইসকন্দর মিয়া আপাদমস্তক একজন ভাবুক। প্রতিটি মুহুর্ত ভাবের জগতে ঢুবে থাকতে চান। তাই সংগীত সাধনায় রেখেছেন অসাধারণ সাফল্যের স্বার। কিন্তু পরিতাপের বিষয় আজ পর্যন্ত এলাকাবাসী কিংবা দেশবাসীর কাছ থেকে এ সৃষ্টিকর্মের মূল্যায়নধর্মী কোন স্বীকৃতি তিনি পাননি। তিনি গান লিখে দেশ বিদেশে সুপরিচিত হলেও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত তিনি (২ পৃষ্ঠায় দেখুন) বাংলাদেশ বেতার কিংবা বাংলাদেশ টেলিভিশনের গীতিকার হিসেবে অনুমোদন লাভ করতে পারেননি। তার অনেক অনুজ গীতিকার বেতার কিংবা টেলিভিশনের অনুমোদন লাভ করলেও তার ভাগ্যে জুটেনি এ দুর্লভ প্রাপ্তি। এটা দেশ জাতি এবং সংগীত জগতের জন্য লজ্জার বিষয়। প্রবীণ এ গীতিকার শেষ বয়সের যেন তার সৃষ্টিকর্মের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করতে পারেন। বয়সের ভারে বেশ বয়সেও তিনি আশাবাদী তার গান বেতার কিংবা টেলিভিশনে শীঘ্রই প্রকাশিত হবে।
দেশে-বিদেশে একজন নন্দিত গীতিকার হওয়ার গীতিকার, ঠিক তখনও পীর মোহাম্মদ শাহ ইসকন্দর মিয়া অননুমোদিত গীতিকার। যেটা বেশ লজ্জ্বার বিষয়। যুক্তরাজ্য প্রবাসী কলম সৈনিক পীর মোহাম্মদ শাহ ইসকন্দর মিয়া রচিত অনেক গানের শুধু ভণিতার পরিবর্তন করে অনেক তথাকথিত গীতিকার অনুমোদন লাভ করেছেন। দেশ জাতি তাঁকে অনেক ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত রেখেছে যেটা কিছুতেই অস্বীকার করা যায় না। তাঁর প্রতি এ বঞ্চনা, অবহেলা সৃজনশীলতার জন্য কোনোভাবেই হিতকর হতে পারে না। সাড়ে তিন হাজার মরমি সংগীত রচনা করে পীর মোহাম্মদ শাহ ইসকন্দর মিয়া কী পেলেন? এ সত্য উপলব্ধি করে অনেক নতুন ভাবুক সাধনার পথে অগ্রসর হতে আগ্রহ পোষণ করবে না। পাঠকের জন্য ইসকন্দর মিয়ার একটি গান পত্রস্থ করা হলো-
তুমি হাকিমুল হাকিম
বাদশাহ্র বাদশাহ তুমি
রহমান রহিম।
অপার মহিমা মহিম
পরওয়ারদিগার।।

তুমি- কুদরতে কামাল
পড়েছি অকুল সাগরে
তরাও হে দয়াল।
কিনারায় লাগাইয়া জালাল
দূর করো আঁধার।।

ওগো- কাদির ও গনী
করুণা করিয়া দান
দাও হে রওশনী।
খুলে দাও রহমতের খনি
করিম ও ছত্তার।।

ভেবে ইসকন্দরে কয়
অপরাধ মা কর
প্রভু দয়াময়।
ভক্ত ভাবে রাখ হৃদয়
ডাকি বারেবার।।

Developed by: