হিজরি নববর্ষ ও আশুরার তাৎপর্য ।। মুফতি সাদিকুর রহমান খাদিমানী

সকল প্রশংসা ও ক্ষমতার মালিক মহান আল্লাহ পাক যিনি আকাশ জমিন চন্দ্র সূর্য ভূমন্ডল ও নভোমন্ডলের সকল কিছু সৃষ্টি করেছেন। শত কোটি দরূদ ও সালাম আল্লাহপাকের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি যিনি মানবজাতির সম্মুখে মহান আল্লাহর একত্ববাদ ও মহা ক্ষমতার কথা তুলে ধরেছেন। সৃষ্টি যার আইন তার এই মূলনীতিতে প্রতিদিন যেমন পূর্ব দিগন্তে সূর্য উদিত হয় পশ্চিম দিগন্তে অস্ত যায় তেমনিভাবে রাতের আকাশে জ্বলে ওঠে দৃষ্টিনন্দন চন্দ্র। আল্লাহ পাক তার সৃষ্টির কোন কিছুই অযথা কিংবা অকারণে সৃষ্টি করেননি বরং প্রত্যেকটি সৃষ্টির মাঝে রয়েছে নিগূঢ় রহস্য সেই হিসেবে চন্দ্রও তার ব্যতিক্রম নয়। মুসলিম জীবনে ইবাদত-বন্দেগির হিসাবের সাথে চন্দ্রের একটি গভীর সম্পর্ক রয়েছে তাই চন্দ্রবর্ষ অর্থাৎ হিজরী বর্ষ গণনা করা মুসলমানদের কর্তব্য। আমরা সকলেই অবগত আছি আমাদের দেশে তিন পদ্ধতিতে দিন তারিখ বছর গণনা হয় যেমন খ্রিস্টাব্দ, বঙ্গাব্দ এবং হিজরি।
বিশ্ব মুসলিমের কাছে হিজরি সনের গুরুত্ব অত্যধিক আর এর সূচনা হয় পবিত্র মহররম মাসের দ্বারা আমরা জানি, ইসলামি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম। মহররম অর্থ সম্মানিত। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে- ‘আকাশ ও জমীন সৃষ্টির দিন থেকেই আল্লাহর নিকট মাসের সংখ্যা ১২। আর এর মধ্যে চারটি মাস (মহররম, রজব, জিলক্বদ, জিলহজ্ব) সম্মানিত।’ (সূরা তাওবা-৩৬)।
হাদিস শরিফে মহররমকে ‘শাহরুল্লাহ’ বা ‘আল্লাহর মাস’ বলা হয়েছে। (তাফসীরে মাজহারী)।
মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর হিজরতের বছরকে প্রথম বছর ধরে এই সন গণনা শুরু করা হয়েছে বলে এর নাম হিজরি সন। হিজরি সনের সঙ্গে মুসলিম উম্মাহের ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পৃক্ত। বিশ্ব মুসলিম উম্মাহের সভ্যতা-সংস্কৃতি ও মুসলিম জীবনে হিজরি সনের গুরুত্ব অপরিসীম।
হিজরি সন চন্দ্রবর্ষ ও সৌরবর্ষ উভয়ভাবে গণনা করা যায়। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন-‘আর সূর্য ও চন্দ্র হিসাবমতো চলে।’ (সূরা রহমান-৫)
‘আর আমি রাত্রি ও দিবসকে করেছি দুটি নিদর্শন; রজনীর নিদর্শনকে আচ্ছাদিত করেছি এবং দিবসের নিদর্শনকে আলোকোজ্জ্বল করেছি; যাতে তোমরা তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ সন্ধান করতে পারো এবং তোমরা যাতে বর্ষসংখ্যা ও হিসাব জানতে পারো।’ (সূরা ইসরা-১২)
‘তিনিই সূর্যকে তেজদীপ্ত ও চন্দ্রকে জ্যোতির্ময় করেছেন এবং উহার গমনপথ নির্ধারণ করেছেন; যাতে তোমরা বৎসর গণনা ও সময়ের হিসাব জানতে পারো।’ (সূরা ইউনুস-৫)
মুসলমানদের ধর্মীয় বিধিবিধান ও ইবাদত বন্দেগির অনেক বিষয় চন্দ্রতারিখের সঙ্গে সম্পর্কিত। তাই চন্দ্রতারিখের হিসাব রাখা ফরজে কিফায়া। উদাসীন মুসলমান চন্দ্রতারিখের হিসাব কজনই রাখে! সুতরাং আরবি তারিখ চর্চায় রাখার জন্য হিজরি নববর্ষ উদ্যাপন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হিজরি নববর্ষ উদ্যাপন প্রিয় নবীজি (সা.)এর হিজরতের বিরহবিচ্ছেদযন্ত্রণাকে স্মরণ করিয়ে দেয়; নবীপ্রেমে উজ্জীবিত করে বিধায় সে দৃষ্টিকোণ থেকে উদযাপন করা যেতে পারে।
আরবি বর্ষপঞ্জির অন্যতম একটি মাস মহররম আর মুহাররমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিবস হচ্ছে আশুরা। আশুরা অর্থ দশম তারিখ। মহররমের ১০ তারিখকে আশুরা বলা হয়। আল্লাহ তাআলা এদিনে জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং আদম (আ.)-কে সৃষ্টি করেছেন। এদিনে নুহ (আ.)এর প্লাবন সমাপ্ত হয়। এদিন ইব্রাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে ৪০ দিন পর নিরাপদে মুক্তি পান। ইউনুস (আ.) মাছের পেট থেকে মুক্তি পান। আইয়ুব (আ.) রোগমুক্তি লাভ করেন। সুলাইমান (আ.) তাঁর হারানো রাজত্ব ফিরে পান। ইয়াকুব (আ.) হারানো পুত্র ইউসুফ (আ.)-কে ৪০ বছর পর ফিরে পান। এদিনে ঈসা (আ.) জন্মগ্রহণ করেন এবং এদিনেই তাঁকে দুনিয়া থেকে আকাশে উঠিয়ে নেওয়া হয়।
রমজানের রোজা ফরজ হওয়ার আগে মুসলমানদের জন্য আশুরার রোজা ফরজ ছিল। দ্বিতীয় হিজরিতে শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরজ হলে আশুরার রোজা সুন্নাত রয়ে যায়। তবে সুন্নাত রোজার মধ্যে আশুরার রোজা সর্বাধিক ফজিলতপূর্ণ। (তিরমিজি)।
মহানবী (সা.) বলেছেন, ‘আশুরার দিনের রোজার ব্যাপারে আল্লাহর নিকট আমি আশাবাদী, তিনি পূর্বের এক বছরের গুনাহ ক্ষমা করে দেবেন।’ (মুসনাদে আহমাদ) নবীজি (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি আশুরার দিবসে তার পরিবারের জন্য ভালো খাবারের আয়োজন করবে, আমি আশাবাদী আল্লাহ তাআলা সারা বছর তার জন্য ভালো আয়োজন রাখবেন।’ (আবু দাউদ)
পবিত্র আশুরার এ সুন্নাত সিয়াম সম্পর্কে রাসুলে পাকের হাদিসে বর্ণিত আছে তিনি বলেছেন আশুরায় দুই দিন সিয়াম পালন করার জন্য যাতে ইহুদীদের সাথে ইবাদতে পার্থক্য সৃষ্টি হয়।
উম্মতে মুহাম্মদীর জন্য আশুরার সর্বশেষ সংযোজন ‘শাহাদাতে কারবালা’। তাই দিনটি ‘শুহাদায়ে কারবালা দিবস’। কারবালা ট্র্যাজেডি আশুরাকে শোকাবহ করে তুলেছে। হজরত মুআবিয়া (রা.)এর ইন্তেকালের পর ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে এপ্রিল মাসে ইয়াজিদ মসনদে আরোহণ করে অনাচার পাপাচার জুলুম ও ক্ষমতার অপব্যবহারে ন্যায়-পরায়ণদের কাছে ঘৃণার পাত্রে পরিণত হয়। ফলে মক্কা, মদিনা, কুফাসহ বহু অঞ্চলের মানুষ তাকে খলিফা হিসেবে অস্বীকৃতি জানান। জনগণ হজরত হোসাইন (রা.)-কে খলিফা হিসেবে দেখতে চান। তাঁরা শত শত চিঠি পাঠিয়ে হোসাইন (রা.)-কে কুফায় এসে নিজেকে খলিফা ঘোষণার জন্য আমন্ত্রণ জানান। মহানবী (স.)-এর ওফাতের অর্ধশতাব্দী পর ৬১ হিজরির ১০ মহররম শুক্রবার নবীদৌহিত্র হযরত আলীর দুলাল মা ফাতেমার নয়নের পুত্তলি জান্নাতের সরদার হোসাইন (রা.) সহ আহলে বাইতের বহুসংখ্যক ইয়াজিদ বাহিনীর নিষ্ঠুরতা ক্ষমতার অপব্যবহার এবং প্রতারণার দ্বারা ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে নির্মমভাবে শাহাদতবরণ করেন। (আল বিদায়া ওয়ান নিহায়া)
পরিশেষে বলা যায়-আরবি বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস মহররম অনেক ঘটনাবহুল ও আলোচিত। এ মহান মাসের সম্মানিত দিন আশুরা সম্পর্কে বর্ণিত আছে এ দিনে কেয়ামত অনুষ্ঠিত হবে ফলে আমাদের সকলকে সেই মহাপ্রলয়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে মহান আল্লাহর ইবাদত ও সন্তুষ্টির মাধ্যমে।
লেখক: আরবি প্রভাষক, কামাল বাজার ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসা, বিশ্বনাথ, সিলেট।

Developed by: