‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ বইটি আমার সামনে। সুরমার সাথে সিলেট নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। উত্তরের নয়, দক্ষিণের সুরমা। এখানের সুর কী অন্যরকম? এখানের সুরে কী মিঠা বেশি নাকি চিনি বা গুড় বেশি। এর জবাব দিয়েছে নওয়াব। মানে মোহাম্মদ নওয়াব আলী। তিনি অনুসন্ধানী, তিনি মনুসন্ধানী এবং মননশীল লেখক ও সম্পাদক।
আসুন এক নজরে বইটি দেখা যাক। বইটির পৃষ্ঠা সংখ্যা মাত্র ৪৮০, প্রকাশক মকসুদ আহমদ বাসিত। বাসিয়া প্রকাশনী, স্টেশন রোড সিলেট। প্রচ্ছদশিল্পী আরেক স্বনামধন্য সিলেটবাসী ধ্র“ব এষ। আলোকচিত্রী : মো. রিয়াজউদ্দিন ও আজাদুর রহমান সুমন, মূল্য মাত্র ৫০০/- টাকা। প্রকাশকাল- অমর গ্রন্থমেলা-২০১৩। বইটিতে প্রথম অধ্যায় হতে শুরু করে পঞ্চদশ অধ্যায়ে খতম করা হয়েছে। সুরমা দক্ষিণের মানচিত্রসহ ৯টি ইউনিয়নের মানচিত্র ব্যবহার করা হয়েছে। সুরমা দক্ষিণ উপজেলার কি কি আছে তা এক নজরে উল্লেখ করা হয়েছে।
মৌজা, নদ-নদী, খালবিল, জল মহলের এবং হাট-বাজারের তালিকা আছে তৃতীয় অধ্যায়ে। মসজিদ, মন্দির, গির্জা, তীর্থস্থানসহ বিভিন্ন স্থানের নামকরণের বিবরণ আছে চতুর্থ অধ্যায়ে। গণকবরের বিবরণও পাওয়া যাবে এ অধ্যায়ে।
৫ম অধ্যায়ে ঐতিহাসিক স্থানের বিবরণ। ৬ষ্ঠ অধ্যায়ে ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা, সাহিত্য, রাজনীতি, সাংবাদিকতার আইন বিচার প্রকাশ, কৃষি বাণিজ্য, তথ্য প্রযুক্তি, চিকিৎসাসহ প্রবাসীদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
৭ম অধ্যায়ে বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের যাবতীয় তথ্য পাওয়া যাবে। ৮ম অধ্যায়ে সরকারি-বেসকারি যাবতীয় প্রতিষ্ঠানের বিবরণ পাওয়া যাবে।
৯ম অধ্যায়ে শীর্ষ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা সন্নিবেশিত করা হয়েছে। দশম ও একাদশ অধ্যায়ে বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া যাবে।
দ্বাদশ, প্রাথমিক শিক্ষা, ত্রয়োদশ অধ্যায়ে আছে সংসদ, উপজেলা ও সিটি নির্বাচন। চতুর্দশ অধ্যায়ে বিভিন্ন ওলি আওলিয়া দরবেশদের পরিচয় পাওয়া যাবে। পঞ্চদশ অধ্যায়ে আছে বিবিধ বিষয়ের কথা।
বইটি পাঠ করলেই বোধা যাবে কতটা পরিশ্রম এবং মেধা খরচ করা হয়েছে। নওয়াব আলী অসাধ্য সাধনের কাজটি করেছেন। তাকে দেখলে কথা বললে মালুম করা কঠিন। ভিতরে ভিতরে এতটা গবেষণার জন্য প্রস্তুতি এবং প্রস্তুত হয়ে কাজটি সমাধান করেছেন। সে জন্য আমি বিষ্ময়ের সাথে অভিনন্দন জানাচ্ছি। এটা খাতিরের মন্তব্য নয় এটা তার আদায় করে নেবার যোগ্যতার স্বীকৃতি। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো মানুষের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। মোহাম্মদ নওয়াব আলী এই বিষয়ে অগ্রগামী। জানিনা তার পরিবার তাকে কীভাবে মূল্যায়ণ করে থাকে। তবে আগামীদিনে তিনি সুরমা অঞ্চলের একজন অগ্রগামী গবেষক বলে চিহ্নিত হয়ে গেলেন।
তিনি বইয়ের কথাসূত্র নামক ভূমিকায় বলেছেন, “নানা জনের হরেক রকম কথা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ সমালোচনা, মন্তব্য মহতী কাজে স্থির থাকার পথে বিরাট অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। তারপরও নিজেকে প্রোএকটিভ রেখে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহে ছুটেছি গ্রাম থেকে গ্রামে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর। সমালোচকদের সমালোচনাকে উপেক্ষা করে তা থেকে শক্তি ও সাহস নিয়ে এগিয়েছি”।
তিনি আরো প্রত্যাশা করেছেন, “এ গ্রন্থ কোন আর্থিক রুটি রুজির বাহন নয়, বরং আমার জন্মভূমির যে মাটিতে আমার শেকড় প্রোথিত যে মাটিতে সে মাটি ও মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস। কারণ আঞ্চলিক ইতিহাস সংগৃহীত হলে জাতীয় ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস”।
এই তার সরল এবং স্বাভাবিক উচ্চারণ তার প্রতি আমার সহমর্মিতা সে আদায় করেই নিয়েছে আর কী !
কোন এক মনীষী বলেছেন, মানুষ অমরতার জন্য তিনটি কাজ করে। একটি হলো- সে প্রজন্ম সৃষ্টি করে। মানে বাবা-মা, দাদা-দাদী, নানা-নানী হয়। দ্বিতীয়টা হলো, সে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চায় আকৃষ্ট হয়। মানুষ এতেই সন্তুষ্ট হতে পারে না। বয়স হলে, শরীর দুর্বল হলে মানুষ ধর্মে মনোযোগ দেয়, সেই জন্য ধর্মীয় গ্রন্থ তৈরি করে। তীর্থ স্থানে গমন করে যাতে পরলোকেও সে ভালো থাকতে পারে।
আমাদের দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলীর তিনটি আশাই পূর্ণ হোক এটাই আমার আন্তরিক প্রত্যাশা।
লেখক : মহাপরিচালক, গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তর, শাহবাগ ঢাকা।