বিভাগ: বই পত্র

ছয়টি বিদেশী রূপকথা

ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার ঝুলি, রাজপুত্র ডালিমকুমার, রাজকন্যা কংকাবতী, রাক্ষস-খোক্ষস, ডাইনি বুড়ি এই বই ও চরিত্রগুলোর সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মধুর শৈশব। যদিও এখনকার শিশুরা বইমুখী না হয়ে ডিভাইসমুখী হচ্ছে বেশী। এতে তাদের শরীর ও মনের উপর পড়তে পারে নেতিবাচক প্রভাব। হাসান হাফিজ লিখিত ছয়টি বিদেশী রূপকথা শিশুদেরকে বইমুখী করার একটি অন্যতম প্রচেষ্টার উদাহরণ। এতে লেখক বিভিন্ন দেশের রূপকথার সম্মেলন ঘটিয়েছেন যা পাঠ করলে শিশুরা পাবে তাদের মনের খোরাক। বইটি প্রকাশ করেছে বাসিয়া প্রকাশনী।
পাওয়া যাচ্ছে রকমারি ডটকমে। সরাসরি বইটি পেতে যোগাযোগ করুন ০১৭১১৪৮৪৬৬৮

ডেইলি বিউটি রুটিন

সাজগোজ করতে বেশির ভাগ মেয়েরাই ভালোবাসে। ঠোঁটে একটু লিপস্টিকের ছোঁয়া, চোখে একটু কাজলের ছোঁয়া কে না পছন্দ করে? তবে সেই সাথে নিয়মিত ত্বকের যত নেওয়াটাও জরুরী। তা নাহলে মেকআপের মাধ্যমে ত্বকের সৌন্দর্য ঠিকমতো ফুটবে না। বইটিতে প্রতিদিনের রুপচর্চার বেসিক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে যা নারী-পুরুষ সবারই কাজে লাগবে ও উপকার করবে।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে অনলাইনে রকমারি ডটকমে। সরাসরি নিতে হলে যোগাযোগ করুন ০১৭১১৪৮৪৬৬৮

মোহাম্মদ নওয়াব আলীর দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য ইতিহাস নির্মিতির এক বিশাল আয়োজন…. এ কে শেরাম

‘ইতিহাস’ শব্দটি অনেক ক্ষেত্রেই এক ধরনের ধূসর রহস্যময়তার আড়ালে ঢাকা। কারণ ইতিহাস নিয়ে নানা সময়েই সৃষ্টি হয়েছে নানা ইতিহাস। ইতিহাসকে খন্ডিত করা হয়েছে নানাভাবেÑবিকৃত করা হয়েছে ইতিহাসের সত্য। আবার কখনোবা পুনর্লিখিত হয়েছে ইতিহাসের ধারা; ইতিহাসকে যাঁরা প্রভাবিত করতে পারেনÑতাঁদেরই প্রয়োজনে। সচরাচর আমরা তাই লক্ষ করি, সাধারণ মানুষ নয়Ñরাজা-রাজড়া তথা শাসক শক্তিরই নানায়তনিক কাহিনীকেই উপজীব্য করে রচিত হয়েছে ইতিহাস। কিন্তু বিরল ব্যতিক্রম হলেও, কোনো কোনো ইতিহাসবিদ নিজস্ব সত্যের কাছে অনুগত থেকে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের রোজনামচা থেকে আহৃত তথ্য নিয়েই রচনা করে থাকেন ইতিহাসের ইতিবৃত্ত। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকারের উচ্চারণে তাই আমরা শুনিÑ ‘ইতিহাস হলো গিয়ে সাধারণ মানুষের উত্থান ও পতন, বিজয় গৌরবের আনন্দ অথবা পরাজয়ের ট্রাজেডী।’ প্রায় একই ধরনের অনুভবের ব্যঞ্জনা শুনি ইতিহাস নির্মাণের এক বিশাল আয়োজন ‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থের প্রণেতা মোহাম্মদ নওয়াব আলীর কণ্ঠেও। ‘কথাসূত্র’ পর্যায়ে তিনি বলেনÑ ‘দক্ষিণ সুরমাÑএক ঐতিহাসিক জনপদের নাম। … এ ঐতিহ্যবাহী বিশাল জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ইতোপূর্বে পুস্তক আকারে মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেনি। মানুষ জানতে পারেনি এ জনপদের মাটি ও মানুষের বিস্ময়কর অভাবনীয় সাফল্যের কথা।’ মানুষ স্বভাবতই শিকড়সন্ধানী। মোহাম্মদ নওয়াব আলীও তাই এক অন্তর্গত তাগিদ থেকে তাঁর নিজের শিকড় সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েই যে ইতিহাস নির্মাণের এই বিপুলায়তন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা তিনি অকপটে বলেছেনÑ ‘আমার জন্মভ‚মি যে মাটিতে, আমার শিকড় প্রোথিত যে মাটিতে সে মাটি ও মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করার লক্ষে আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।’ কিন্তু এই সত্যের পাশাপাশি আমাদের সমাজবাস্তবতা মোটেও আগ্রহোদ্দীপক নয়Ñবরং হতাশাব্যঞ্জক। কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের সমাজে ইতিহাসের কদর মোটেও নেই। ইতিহাস নিয়ে প্রবাদপ্রতিম সেই বক্তব্যের কথা আমরা সবাই জানি, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হলো এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শেখে না।’ আমরা জানি, জাতি হিসেবে আমরা যেমন ইতিহাস পাঠে অনাগ্রহী তেমনি চরম অনীহ ইতিহাস রচনায়ও; বিশেষত সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায়। তাইতো আমরা দেখি শ্রীহট্ট বা সিলেট এক প্রাচীন জনপদ হওয়া সত্তে¡ও সিলেটের নির্ভরযোগ্য সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস খুব বেশি রচিত হয়নি। এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ দক্ষিণ সুরমা সম্পর্কেতো কোনো গ্রন্থই এযাবত রচিত হয়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন আলোচ্য গ্রন্থের লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলী। অথচ আমরা জানি এবং স্বীকার করি ইতিহাস রচিত হওয়া দরকার। প্রকৃত ইতিহাস ব্যতীত জাতির অগ্রগমণ প্রায় অসম্ভব। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একারণেই শতাধিক বৎসর আগেই বলে গেছেনÑ ‘বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। যাহা আছে তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙ্গালার বিদেশী বিধর্মী অসার পরপীড়কদের জীবনচরিত মাত্র। বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙালি তাহাকেই লিখিতে হইবে।’ সাহিত্যস¤্রাটের এই আহŸানে সাড়া দিয়েছেন দক্ষিণ সুরমার এক শিকড়সন্ধানী দায়িত্বশীল লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলী। তিনি জানেন, সমগ্র বাংলার না হোক অন্তত নিজ এলাকার গৌরবগাথা নিয়ে, ইতিহাসের নানা কুশীলব আর তাঁদের কর্ম ও কৃতি নিয়ে ইতিহাস রচনার সূচনা তিনি করতেই পারেন। আর কে না জানে, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজই বৃহত্তের ভিত গড়ে তোলে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়Ñ ‘যাহার যতটুকু সাধ্য সে ততদূর করুক। ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্মাণ করে।’ আমরা এও জানিÑ ‘ক্ষুদ্র বালুকার কণা বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ি তোলে মহাদেশ সাগর অতল।’ এই উপলব্ধির উজ্জ্বল আলোকেই মোহাম্মদ নওয়াব আলী অনেক শ্রম আর মেধা ও মননের স্বেদবিন্দু তিল তিল করে সাজিয়ে গড়ে তোলা ‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক বেশ বিপুলায়তন এই গ্রন্থখানি আমাদের উপহার দিয়েছেন।
দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ৪৮০ পৃষ্ঠার এই বৃহদায়তন গ্রন্থটিতে পনেরটি অধ্যায়ে বিন্যন্ত হয়েছে ‘দক্ষিণ সুরমা’ নামের এই জনপদের ইতিহাস নির্মিতির যাবতীয় আয়োজন। দক্ষিণ সুরমা বলতে সাধারণত সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে অবস্থিত সিলেট শহর সংলগ্ন পূর্বতন সিলেট সদর উপজেলার যে অংশটুকু সেটিকেই বুঝানো হয়ে থাকে। ২০০৫ সালে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় অবস্থিত ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয় দক্ষিণ সুরমা উপজেলা। এই ৯টি ইউনিয়ন হলোÑ মোল্লারগাঁও, বরইকান্দি, তেতলী, কুচাই, সিলাম, লালাবাজার, জালালপুর, মোগলাবাজার ও দাউদপুর। পরবর্তীতে কামালবাজার নামে নতুন একটি ইউনিয়ন গঠিত হওয়ায় দক্ষিণ সুরমা উপজেলার অন্তর্গত ইউনিয়নের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। তবে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাড়াও দক্ষিণ সুরমা এলাকায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৩ টি ওয়ার্ডের অবস্থান। এই তিনটি ওয়ার্ড হলোÑ ২৫, ২৬ ও ২৭ নং ওয়ার্ড। এই গ্রন্থে দক্ষিণ সুরমা বলতে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার অন্তর্গত ১০টি ইউনিয়ন এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উপরোল্লিখিত ৩টি ওয়ার্ডের সমন্বিত ভৌগোলিক পরিসরকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে অবস্থান, নামকরণ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই পর্যায়ে উপশিরোনাম হিসেবে স্থান পেয়েছেÑ দক্ষিণ সুরমার মানচিত্র; ভৌগোলিক অবস্থান; উৎপত্তি, নামকরণ ও প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস; উপজেলা প্রশাসনিক ভবন; একনজরে উপজেলা পরিচিতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তালিকা। আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে, ঐতিহ্যবাহী নদী সুরমার দক্ষিণ পার ঘেঁষে এই উপজেলার অবস্থান বলে এর নামকরণ হয়েছে ‘দক্ষিণ সুরমা’। এই উপজেলার আয়তন ১৯৫.৪০ বর্গকিলোমিটার এবং ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জনসংখ্যা ২,৫৩,৩৮৮ জন। উপজেলা কমপ্লেক্স স্থাপিত হয়েছে মোগলাবাজার ইউনিয়নের নৈখাই এলাকায় ৬ একর ভ‚মির উপর। এই উপজেলার অন্যান্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সন্নিবেশিত হয়েছে এই অধ্যায়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনামÑ ইউনিয়ন ও সিটি ওয়ার্ডের মানচিত্র ও পরিচিতি। এই অধ্যায়ে দক্ষিণ সুরমা উপজেলাভুক্ত ১০টি ইউনিয়নের মানচিত্র এবং বিস্তারিত পরিচিতি ও আনুষঙ্গিক তথ্যাদি তুলে ধরা হয়েছে। পৃথক পৃথকভাবে প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকাল, আয়তন, জনসংখ্যা, মৌজা ও গ্রামের সংখ্যা, ইউনিয়নের অন্তর্গত মসজিদ, মন্দিরের সংখ্যা এবং প্রকৃতি অনুযায়ী বিভাজনসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাসহ নানা তথ্যাদি যেমন উল্লেখিত হয়েছে, তেমনি মেয়াদকালসহ দায়িত্ব পালনকারী চেয়ারম্যানদের তালিকাও সন্নিবেশিত হয়েছে। একইভাবে সিটি কর্পোরেশনভুক্ত তিনটি ওয়ার্ডের পরিচিতি এবং সংক্ষিপ্ত তথ্যাদিও স্থান পেয়েছে এই অধ্যায়ে। তৃতীয় অধ্যায় সাজানো হয়েছে মৌজা, নদনদী, খালবিল, জলমহাল, নালা, টিলা, হাটবাজার, গ্রামÑএসবের বিস্তারিত বর্ণনা ও এতদসংক্রান্ত বহুবিধ তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে। ইউনিয়নওয়ারী মৌজা ও গ্রামের তালিকা আছে, আছে হাটবাজারের বিবরণ, খাল ও বিলের তালিকা, তেমনি আছে নদীর নাম এবং সেগুলোর ইতিহাস ও বিস্তারিত বিবরণ। সিলেটের প্রধান নদী সুরমা। সুরমা নদীর নামকরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেÑ ‘দ্বাদশ শতকের রাজা ক্ষেত্রপাল বরাক নদী হতে খাল কেটে নদীটি খনন করেন এবং প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে নাম রাখেন ‘সুরমা’। .. হট্টনাথের পাঁচালিতে উল্লেখ আছে সুরমা নদী মনুষ্যসৃষ্ট কাটা গাঙ। বরাক হতে লোভার সংযোগ পর্যন্ত সাত বাঁক, আটগ্রাম প্রভৃতি স্থানের লোকমুখে নদীর ওই অংশ কাটা নদী বা কাটা গাঙ নামে অভিহিত হয়। তাই বলা যায় দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে সুরমা নদীর জন্ম।’ চতুর্থ অধ্যায়ে আছে ‘মসজিদ, মন্দির, গির্জা, তীর্থস্থান, বিভিন্ন স্থানের নামকরণ, আন্দোলন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা ও গণকবর’ প্রসঙ্গ। গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায়ে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিবরণ যেমন আছে, তেমনি আছে বিভিন্ন স্থানের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে অনেক মজাদার তথ্য। যেমন, লালাবাজারের নামকরণ হয়েছে হিন্দু জমিদার লালা গৌরহরির নামে, জালালপুরের নামকরণ সাধকপুরুষ হযরত শাহজালাল (র.)-এর নামানুসারে। সিলাম নামকরণের সাথেও যুক্ত আছে হযরত শাহজালালের (র.) শ্রীহট্ট বিজয়ের ঘটনা। জালালী বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করার জন্য গৌড়গোবিন্দ পথে পথে ছড়িয়ে রেখেছিলেন বিশাল আকৃতির সব পাথর বা ‘শিল’। হযরত শাহজালালের (র.) পবিত্র মুখ থেকে তখন উচ্চারিত হয় ‘শীল লাম’ অর্থাৎ পাথর নিচে সরে যাও। সেই ‘শীল লাম’ থেকে ‘সিলাম’ নামের উৎপত্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে গ্রন্থে। আবার খোজারখোলা নামের সাথে জড়িয়ে আছে মোগল আমলের খোজা ব্যবসার প্রসঙ্গটি। এছাড়াও এই অধ্যায়ে আছে আন্দোলন সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ সুরমার অবদান নিয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ কৌতুহলোদ্দীপক আলোচনা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে একাত্তরের পঁচিশে রাতের কালো রাতে হানাদার পাক-বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র ও শিক্ষক। ঐ ঘটনায় শহীদ হন দক্ষিণ সুরমার কৃতী সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚তত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল মুক্তাদির। গণকবর প্রসঙ্গটিও এসেছে এখানে। তবে মুক্তিযুদ্ধ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর আলোচনা আরো অনুপুঙ্খ তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে আরেকটু বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ হলে আমরা উপকৃত হতাম। পঞ্চম অধ্যায়ে ঐতিহাসিক স্থান পর্যায়ে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম ব্যক্তিত্ব। প্রথমেই রয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। এই পর্যায়ে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সূচনালগ্নে শহীদ হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবদুল মুক্তাদির এবং বিশজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ তুলে ধরা হয়েছে। এর পরপরই রয়েছে জাতির সাহসী সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ইউনিয়নওয়ারী তালিকা। এই তালিকা অনুযায়ী মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের ১৫ জন, বরইকান্দি ইউনিয়নের ১৭ জন, তেতলী ইউনিয়নের ১৮ জন, কুচাই ইউনিয়নের ২৭ জন, সিলাম ইউনিয়নের ৫০ জন, লালাবাজার ইউনিয়নের ১৩ জন, জালালপুর ইউনিয়নের ৫২ জন, মোগলাবাজার ইউনিয়নের ৪১ জন, দাউদপুর ইউনিয়নের ১৬ জন, কামালবাজার ইউনিয়নের ১০ জন এবং সিটি কর্পোরেশনের তিনটি ওয়ার্ডে ১১ জন মিলে দক্ষিণ সুরমা জনপদের মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২৭০ জন। গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায়ে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, রাজনীতি ও সমাজসেবা, ক্রীড়া, আইন বিচার প্রশাসন, তথ্যপ্রযুক্তি, চিকিৎসা, প্রবাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রবীণ ও নবীন বিশিষ্টজন, সরকারী ও বেসরকারী পদস্থ ব্যক্তিবর্গ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে, মোহাম্মদ নওয়াব আলীর দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থটি এই জনপদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের নির্মাণের এক বিশাল ও মহাকাব্যিক আয়োজন। এর কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে গ্রন্থের প্রায় অর্ধেক কলেবর জুড়ে ২২০ পৃষ্ঠা ব্যাপ্ত এই অধ্যায়ে অসংখ্য তথ্য ও বর্ণনার সমাবেশে এই জনপদের নানা পর্যায়ের অনেক ব্যক্তিত্বের ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী পরিবেশনের আয়োজন থেকে। এ ব্যাপারে একটি সাধারণ ধারণা দেওয়ার জন্যে আমি বিষয়-বিভাজন অনুযায়ী ভুক্তির সংখ্যাগুলো শুধু উল্লেখ করতে চাই। শিক্ষা পর্যায়ে ২৩ জন ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি সাহিত্য পর্যায়ে ৬৯ জন, সংস্কৃতি পর্যায়ে ৪২ জন, সাংবাদিকতায় ৪০ জন, রাজনীতি ও সমাজসেবায় ২৫ জন, ক্রীড়াক্ষেত্রে ৪৩ জন, আইন বিচার ও প্রশাসন পর্যায়ে ১২ জন, কৃষি শিল্প ব্যবসাবাণিজ্যে ১৪ জন, তথ্যপ্রযুক্তিতে ১১ জন, সরকারি বেসরকারি পদস্থ ব্যক্তিবর্গের তালিকায় ৪১ জন, চিকিৎসায় ৩২ জন এবং প্রবাস পর্যায়ে ৫৪ জনের জীবন ও কৃতি তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া সিলেট বারে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত দক্ষিণ সুরমার আইনজীবীদের একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ১০০ জন আইনজীবীর নাম ও পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিত্ব পর্যায়ের এই অলোচনায় সমসাময়িক বাংলা কবিতার এক প্রধান পুরুষ কবি দিলওয়ার, সিলেটের অন্যতম প্রধান মরমী কবি সুফি সাধক আরকুম শাহ, আসাম প্রাদেশিক পরিষদের স্পীকার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রথম মন্ত্রীসভার সদস্য বসন্ত কুমার দাস, বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির এক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব পীর হবিবুর রহমান, দেশের মহিলা দাবার ক্ষেত্রে এক কিংবদন্তী নাম রাণী হামিদ, সিলেট ও মুসলিম বঙ্গের প্রথম আইসিএস গজনফর আলী খান, রিয়ার এডমিরেল মাহবুব আলী খান, ড. ক্ষণদামোহন দাশ, জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আবদুল মালিক, মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সপ্তদশ মহাসচিব আইরিন খান প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সপ্তম অধ্যায় বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে। এখানে সংসদ সদস্য, উপজেলার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়নসমূহের চেয়ারম্যান এবং সিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলারবৃন্দের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। অষ্টম অধ্যায়ে আছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের খবর। দক্ষিণ সুরমা অঞ্চলে উপজেলা সদর ও তৎসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে বিভাগীয় ও জেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও দপ্তর। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সিলেট বিভাগীয় সদর দপ্তর, ডিআইজি অফিস, সিলেট শিক্ষাবোর্ড, সিলেট রেলস্টেশন, সিলেট বিসিক শিল্পনগরী, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় রিজিওনাল রিসোর্স সেন্টার, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সিলেট ফরেন পোস্ট অফিস, সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সিলেট সরকারি বাণিজ্যিক মহাবিদ্যালয়, সিলেট সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সিলেট সরকারি মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি। নবম অধ্যায়ে শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিরোনামে ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দশম অধ্যায় সাজানো হয়েছে দক্ষিণ সুরমার ৩০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিয়ে। আর একাদশ অধ্যায় জুড়ে আছে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্ণনা। ফাজিল মাদ্রাসা, আলিম মাদ্রাসা, দাখিল মাদ্রাসা, হাফিজিয়া মাদ্রাসা এবং কওমি মাদ্রাসা শিরোনামে বিভক্ত করে দক্ষিণ সুরমার বিভিন্ন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এই অধ্যায়ে। একইভাবে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা ও বর্ণনা দিয়ে সাজানো হয়েছে দ্বাদশ অধ্যায়। এই অধ্যায়ে ইউনিয়নওয়ারী তালিকা দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ত্রয়োদশ অধ্যায় সংসদ, উপজেলা ও সিটি নির্বাচন নিয়ে। এই পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের তালিকা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের নাম ও তাঁদের প্রাপ্ত ভোটের বিবরণ যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনি উপজেলা নির্বাচন ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রার্থী ও তাঁদের প্রাপ্ত ভোটের তথ্যও সংযোজিত হয়েছে। চতুর্দশ অধ্যায়ের শিরোনাম ওলি আউলিয়া ফকির দরবেশ। আমাদের এই অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচার করেছিলেন ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (র.)। তিনি তাঁর অনুগামী ৩৬০ আউলিয়াকে নিয়ে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহট্ট বিজয় করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ মেলে। আর একারণেই সিলেটকে তিনশত ষাট আউলিয়ার দেশও বলা হয়। মোহাম্মদ নওয়াব আলীর এই গ্রন্থে ‘শাহজালাল (র.) ও তিনশ’ ষাট ওলির বিবরণ’ শিরোনামে হযরত শাহজালালের (র.) শ্রীহট্ট বিজয়ের ঘটনাকে ১৩০৩ বঙ্গাব্দের বলে উল্লেখ করা হয়েছে; এটি বড় ধরনের এক মুদ্রণবিভ্রাট। আসলে এই সাল হবে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দ। শাহজালালের (র.) সফরসঙ্গী ওলির সংখ্যা ৩৬০ জন বলা হলেও লেখকের ভাষায় ‘৩৬০ ওলির নির্ভরযোগ্য একটি তালিকা পাওয়া দুর্লভ। সৈয়দ মর্তুজা আলী’র ‘সুহেলে ইয়ামেনী’ অবলম্বনে হজরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাসে ২৫২ জন ওলির নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন পত্রিকা ‘আল ইসলাহ’ ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত শাহজালাল (র.) সংখ্যায় মুহম্মদ নূরুল হক ৩২২ জন ওলির নামের তালিকা প্রদান করেছেন।’ লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলীও হযরত শাহজালালের (র.) সফরসঙ্গী সেই ৩২২ জন আউলিয়ার নামতালিকা এই অধ্যায়ে সংযোজন করেছেন। হযরত শাহজালালের (র.) সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে ২২ জন আউলিয়ার মাজার দক্ষিণ সুরমা এলাকায় অবস্থিত বলে উল্লেখ করে লেখক তাঁদের তালিকা সন্নিবেশনের পাশাপাশি অলোকচিত্রসহ মাজারগুলোর পরিচিতি তুলে ধরেছেন। তবে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, লেখক শাহজালালের সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম বলে যে ২২ জন আউলিয়ার নামের উল্লেখ ও মাজারের বিবরণ দিয়েছেন, তার মধ্যে অনেকেরই নাম ইতোপূর্বে উল্লেখিত ৩২২ জন আউলিয়ার তালিকার মধ্যে নেই। আসলে, হযরত শাহজালাল (র.)-এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার নাম ও তাঁদের মাজার নিয়ে এ জাতীয় বিভ্রম প্রায়শই লক্ষ করা যায়। সুতরাং, এ ব্যাপারে আরো অনুসন্ধান এবং গবেষণার মাধ্যমে সঠিক তালিকা প্রণয়ন আবশ্যক বলে আমি মনে করি। এছাড়াও লেখক এই অধ্যায়ে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় অবস্থিত অন্যান্য ৬৬ জন ওলি আউলিয়া বুজুর্গদের নামতালিকা এবং সচিত্র মাজার পরিচিতিও তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে লেখক নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়ভাবে অনেক শ্রম ও অভিনিবেশ যুক্ত করেছেন। গ্রন্থের শেষ ও পঞ্চদশ অধ্যায়ের শিরোনাম বিবিধ। এই পর্যায়ে বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষা, রেজিস্ট্রিকৃত সমাজকল্যাণ সমিতি, বহুমূখী সমবায় সমিতি, কৃষি সমবায় সমিতি, মৎসজীবী সমবায় সমিতি, যুব সমবায় সমিতি, সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি, ব্যাংকসমূহ ও কমিউনিটি সেন্টার সংক্রান্ত তথ্য ও উপাত্তের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। এছাড়া এই গ্রন্থ প্রণয়নে এবং তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে যাঁরা নানাভাবে সহায়তা করেছেন তাঁদের একটি দীর্ঘ তালিকা যেমন লেখক দিয়েছেন, তেমনি সহায়কগ্রন্থের বেশ দীর্ঘ একটি তালিকাও সন্নিবেশিত হয়েছে। যে কোনো সহায়তার জন্যে লেখকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা ঋণ স্বীকারের এই মহৎ ঔদার্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
আমি আগেই বলেছি, মোহাম্মদ নওয়াব আলীর ‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থখানি ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ সুরমা জনপদের কাঙ্খিত ইতিহাস নির্মিতির এক বিশাল আয়োজন। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস নির্মাণের বিচারে কিছু কিছু ন্যূনতা বা অসম্পূর্ণতা থেকে গেছে; কিন্তু তথ্য-উপাত্তের সমাবেশে, কাহিনী বা ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহে, বিভিন্ন মানচিত্র ও আলোকচিত্রের বিন্যাসে যে মহাকাব্যিক আয়োজন সম্পন্ন করেছেন গ্রন্থকার মোহাম্মদ নওয়াব আলী; তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়জাগানিয়া। এই জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য বা বিষয়ই বাদ পড়েনি মোহাম্মদ নওয়াব আলীর অনুসন্ধানী দৃষ্টির সীমানা থেকে। এজন্যে তাঁকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে, প্রযুক্ত করতে হয়েছে মেধা ও মননের স্বেদবিন্দু। শ্রমসাধ্য অনেক তথ্যানুসন্ধানের পাশাপাশি লেখককে কষ্টকর গবেষণাকর্মেও সক্রিয় হতে হয়েছে। মোহাম্মদ নওয়াব আলীকে এতোদিন আমরা কবি, সম্পাদক ও সংগঠক হিসেবেই চিনতাম; এখন দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচ্য এই বিপুলায়তন গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর গবেষক পরিচয়টিও সুস্পষ্ট হলো আমাদের সামনে।
মোহাম্মদ নওয়াব আলীর ‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থটি সামগ্রিকভাবে খুবই শোভনÑসুন্দর। দক্ষিণ সুরমার মানচিত্রের নিচে সিলেটের হৃদয় ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া নদী কল্লোলিনী সুরমার উপর স্থাপিত ঐতিহাসিক কীন ব্রীজের দক্ষিণপ্রান্ত, যা ছুঁয়ে আছে দক্ষিণ সুরমার ভ‚মিকে, এই চিত্ররূপকে প্রেক্ষাপটে রেখে প্রখ্যাত প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রæব এষের করা প্রচ্ছদ যেমন নান্দনিক ও ব্যঞ্জনাময়, তেমনি গ্রন্থভুক্ত বিষয়ের বিশাল প্রেক্ষাপটকে সুবিন্যন্তভাবে সাজানো, পরিচ্ছন্ন মুদ্রণ, চমৎকার বাঁধাইÑসমস্ত কিছুই প্রথম দর্শনে পাঠককে বিমোহিত করার মতো। সরল বাক্যবিন্যাসে গ্রন্থের ভাষা ঝরঝরে ও আকর্ষণীয়।
কিছু কিছু জায়গায় সামান্য ত্রæটি-বিচ্যুতি থাকলেও মুদ্রণপ্রমাদ প্রায় নেই বললেই চলে। ৪৮০ পৃষ্ঠার এই বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা, যা খুবই সহনীয় পর্যায়ে। এই মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করে বাসিয়া প্রকাশনী নিঃসন্দেহে বিদ্বৎসমাজের প্রশংসাধন্য হয়েছেন। দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থখানি পাঠকপ্রিয়তায় পাবে এবং এর লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলী কালের প্রসেনিয়ামে এক উজ্জ্বল কুশীলব হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন এই প্রত্যাশা আমি লালন করছি প্রবল প্রত্যয়ে।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় কবিতা পরিষদ, সিলেট

কামরুল এবং মাহীর দুঃসাহসিক অভিযান : শিশু মনস্তত্ত¡ স্পর্শের প্রয়াস ……সাইদুর রহমান সাঈদ

‘বিড়ালছানা ইঁদুরছানাকে করলো টেলিফোন
কালকে আমার জন্মদিনে তোমার আমন্ত্রণ।’
ইঁদুরছানা যদি আমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য বিড়ালছানার বাড়িতে যেতে তাহলে কেমন হতো? বা কি ঘটতো?
গল্পকার জুবায়ের চৌধুরী তার গল্পের নায়ক কামরুলের প্রিয় বিড়ালছানা মাহীর জন্য খেলনা হিসেবে খেলনা-ইঁদুর পছন্দ করে বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। শিশুতোষ সাহিত্যে চরিত্র নির্মাণ অতন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শিশুদের মনে কৌতুহল সৃষ্টি ও নানা প্রশ্ন জাগিয়ে তুলতে পারলে শিশুর মানস গঠনে তা সহায়ক ভ‚মিকা পালন করে।
শিশুতোষ সাহিত্যের ভাষা সহজ-সরল-কোমল-প্রাঞ্জল-সাবলিল ও বোধগম্য হতে হয়। শিশুদের জন্য উপযোগী শব্দচয়ন ও বর্ণনভঙ্গির বৈচিত্রতা একান্ত প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে গল্পকার যে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে। তার চমৎকার উপস্থাপনা গল্পটিকে হৃদয়গ্রাহী করে তুলেছে।
কামরুল এবং মাহীর দুঃসাহসী অভিযান’ পড়ার পর আমার মনে হয়েছে গল্পকার শিশুদের নৈতিকতাবোধে উজ্জ্বীবিত এবং সংঘবদ্ধভাবে কাজ করার মানসিকতা গড়ে তোলার প্রয়াস পেয়েছেন। পারস্পরিক সহযোগিতার মাধ্যমে যে কোনো কাজ করার প্রতিও তিনি শিশুদের উৎসাহিত করেছেন। আসলে শিশুদের মধ্যে নৈতিকতাবোধ, ভালমন্দবোধ, জীবনবোধ, চেতনাবোধ প্রভৃতি জাগিয়ে তোলার কাজ করতে হয় শৈশবকাল থেকেই। আনন্দঘন পরিবেশে শিশুদের শিক্ষা দিতে হয় বা শিশুদের শিক্ষাদানের জন্য আনন্দময় পরিবেশ সৃষ্টি করতে হয়। এ ক্ষেত্রে গল্পকার তার সৃজনশীল প্রতিভার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। তার জীবন ঘনিষ্ঠ একটি অভিজ্ঞতার আলোকেই তিনি ইংরেজি ভাষায় গল্প লেখার প্রয়াস পেয়েছেন। এতে শিশুরা ইংরেজি ভাষা শিখতেও আগ্রহী হবে এবং ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারবে।
বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় ‘কামরুল এবং মাহীর দুঃসাহসী অভিযান’ গল্পটি লেখকের সুদূর প্রসারি চিন্তা ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গির পরিচায়ক। এ গল্প পড়ে শিশুরা বেশ উৎফুল্ল হবে এবং শৈশবে কিভাবে জীবনযাপন করতে হয়, সে সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করবে।
গল্পের বর্ণনায় দেখা যায়, কামরুল তার প্রিয় বিড়ালছানা ও তার খেলনা-ইঁদুরকে বাড়িতে খুঁজে পাচ্ছে না তখন তার
মনে পড়ে যায় গত পরশু মনির দাদার উঠানে বিড়ালছানাকে ইঁদুরের সাথে খেলতে দেখেছে। তখনই সে মনির দাদার বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। তাদের বাড়ির মাঝখানে যে জঙ্গল ছিল তার দিয়ে হাঁটতে গিয়ে সে একটি কাঠবিড়ালীর দেখা পায়। বন্ধু বৎসল কাঠ বিড়ালী কামরুলের অভিপ্রায় জানার পর তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে এবং তাকে নিয়ে মনির দাদার বাড়ির দিকে যাত্রা করে। যাত্রা পথে তারা বনের মধ্যে একদল খরগোশের দেখা
পায়। তারা তাদের অভিযানের কারণ জানতে চায়। ঘটনাটি জানার পর খরগোশের দল তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে এবং মাহী ও খেলনা-ইঁদুর খুঁজে বের করে দেওয়ার আশ^াস দেয়। কামরুল, কাঠবিড়ালী ও খরগোশের দল মিলে মনির দাদার বাড়ির ঝোঁপঝাড়ের ভেতরেই খেলনা-ইঁদুরটি পেয়ে যায়। এ অভিযানে আন্তরিক সহযোগিতার জন্য কামরুল কাঠবিড়ালী ও খরগোশের দলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানালো। বাড়িতে ফিরে আসার পর কামরুল অনুধাবন করলো দলবদ্ধভাবে কাজ করার ফলেই তার অভিযান সফল হয়েছে। এ অভিযানে তার কিছু নতুন অ্যানিমেল ফ্রেন্ড তৈরি হলো। গল্পের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় চমৎকার বর্ণনা জোবায়ের চৌধুরীর সৃজনশীল প্রতিভা ও দক্ষতার পরিচয় বহন করে।
কামরুল এবং মাহীর দুঃসাহসী অভিযান’ গল্পটি বাংলা ইংরেজি উভয় ভাষায় রচিত হওয়ার ফলে শিশু কিশোরদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা অর্জন সহজ হবে এবং ইংরেজি ভাষা শিখতে তারা আগ্রহী হয়ে ওঠবে। গল্পটি শিশু শিক্ষামূলক এবং শিশুর মানস গঠনের সহায়ক। জীবন চলার পথে অন্যান্যদের সহযোগিতার প্রায়োজনীয়তার গুরুত্বের বিষয়টিও গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট। এক কথায় এটি একটি সফল শিশুতোষ গল্প।
বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিক গল্পকার জোবায়ের চৌধুরী দুই ভাষার গল্প লিখে ব্রিটিশ ও বাঙালি জাতির ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্যে সংযোগ স্থাপনের যে প্রচেষ্টা করছেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আমরা আশাবাদী এই তরুণ গল্পকারের কাছ থেকে আগামী দিনে আরও বেশি সৃজনশীল শিশুতোষ সাহিত্যকর্ম আমাদের সাহিত্য ভাÐারকে সমৃদ্ধ করবে।

২৫/০১/১৪৩০
লেখক: সভাপতি : বাংলাদেশ সাম্যবাদী সাহিত্য পরিষদ

শিশিরকন্যা জয়িতার প্রথম বই : ‘দূর পরবাসে’-এর পাঠ প্রতিক্রিয়া

শুনেছি এক কোটির বেশি বাংলাদেশি দেশের বাইরে থাকে। বিশাল একটা সংখ্যা। পৃথিবীর অনেক দেশের জনসংখ্যাই এক কোটি না, আর আমরা সেই পরিমাণ আদম সন্তান রপ্তানি করে দিয়েছি! প্রবাসে তাই বাংলাদেশি কমিউনিটি বিরল না। বড় শহরে তো বটেই, মাঝারি, এমন কী ছোট শহরেও বাংলাদেশি পাবেন আপনারা, আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিরা একে দেশি কমিউনিটি বলে থাকি। কেমন আছেন তারা? কী ভাবছেন? কী খাচ্ছেন, কতখানি অভিযোজিত হয়েছেন ভিন্ন দেশে, ভিন্ন প্রতিবেশে? জীবন বৈরী হয়ে উঠলে কী করেন তারা? এই প্রশ্নগুলো উত্তর আপনারা পত্রিকাতে পাবেন না। অন্তর্জালে বাংলা লেখার সহজলভ্যতার কারণে প্রবাসীরাও লিখছেন, দেশি কমিউনিটির মধ্যে দেশি লেখক সমাজও গড়ে উঠছে আস্তে আস্তে। আমি জিনিসটাকে ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখি। নোয়াখালির গ্রাম থেকেও মিনিটের মধ্যে নেব্রাস্কার ছোট শহরের বাংলাদেশির জীবনটা এখন দেখা সম্ভব।
আমি নিজেকে বøগার মনে করি। বøগ অনেকটা ডায়েরির মতোন, ব্যক্তিগত ভাবনা আর পারিপার্শ্বিক এবং তার আড়ালে যা আছে সেগুলো সব উঠে আসে এতে। আমি মনে করি বøগ একটা সমাজের চিত্র, এতে খুঁটিনাটি ব্যাপার যেগুলো ধরা পড়ে আর কোনো কিছুতে একটা সময়কে অতটা ধরা সম্ভব না। প্রবাসী বাংলাদেশীদের জানতে হলে সবচেয়ে উত্তম তাদের লেখা বøগ পড়া। পড়ে শেষ করলাম শিশিরকন্যা জয়িতার প্রথম বই- ‘দূর পরবাসে’। বইটার নামই বলে দিচ্ছে দুই মলাটের ভেতরে কী আছে। শিশিরকন্যা জয়িতা আমেরিকাতে আছেন ৩০ বছর ধরে। তিনি আমেরিকার ঢাকা শহর নিউইয়র্কে থেকেছেন, থেকেছেন অপেক্ষাকৃত ছোট শহর অস্টিনেও। কাজ করেছেন কর্পোরেশনে, সন্তান বড় করেছেন, সংসারধর্ম পালন করেছেন। অর্থাৎ একটা জীবনে যা যা অনুষঙ্গ থাকে সবই তাঁর আছে, তাই দূর প্রবাসের জীবনের ৩৬০ ডিগ্রি একটি ছবি তিনি দিতে পারবেন সেই বিশ্বাস আমার বইটা হাতে নেওয়ার আগেই ছিল।
দেশ ছেড়ে চলে যাওয়া সহজ কাজ না, বহু কষ্ট আর শূন্যতা বয়ে বেড়াতে হয় প্রথম জেনারেশনের বাংলাদেশিদের। আত্মপরিচয়ের সংকট আছে, সেই সাথে আছে পরবর্তী প্রজন্মকে নিজের সমাজ ও জীবন দর্শন চেনানোর সুকঠিন দায়িত্ব। মাছেভাতে বাঙালি জাতি আমরা কিন্তু অবধারিত প্রশ্ন ধেয়ে আসে সন্তানের কাছ থেকে- What is so special about fish? সেই সঙ্গে বাংলাদেশি নারীকে কর্মক্ষেত্রে কী কী প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় সেটাও এই বইতে উঠে এসেছে। টানাপোড়েন আরও প্রখর হয়ে উঠে যখন সন্তান কুকুর পালার আবদার করে, অধিকাংশ দেশি মানুষ যখন কুকুর দেখলে ভয়ে কাঠ হয়ে যান, তখন এই আব্দার কীভাবে মেটানো সম্ভব?
জয়িতা আরও দুই একটা অভিজ্ঞতার কথা লিখেছে যেটার সাথে বাকি প্রবাসীরাও সংযোগ করতে পারবেন। প্যারিসের রাস্তাতে বাংলাতে কথা বলতে শুনে এক প্রবাসী বাংলাদেশীর স্ট্রিট ভেন্ডরের সহমর্মিতার কথা এসেছে জয়িতার বইয়ে একটি অধ্যায়ে। এই অভিজ্ঞতা আমাদের প্রায় সবারই হয়েছে। এক কোটি রেমিটেন্স যোদ্ধা ছড়িয়ে আছে জাপান থেক পেরু পর্যন্ত, এদের প্রায় সবাই পায়ের ঘাম মাথায় ফেলছেন জীবন ও জীবিকার জন্য, ঋদ্ধ করছেন বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডার। কিন্তু রাস্তায় হঠাৎ বাংলা শুনলে আমরা ভুলে যাই দেশ থেকে বহুদূরে আছি, আমি একবার প্রচÐ তৃষ্ণার্ত হয়ে এক বোতল পানি কিনেছিলাম নিউইয়র্কের রাস্তাতে, সেই পানির দাম দিতে আমাকে অনুনয় বিনুনয় করতে হয়েছিল। জয়িতার মতো আমিও জানি না স্বজাতির প্রতি এত টান আর কোন জাতির মানুষ অনুভব করে কি না।
বইতে বিভিন্ন কিছু চিত্তাকার্ষক টপিকও উঠে এসেছে, যেমন মৃত্যুর কাছাকাছি থেকে ফেরৎ আসার অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি লেখা আছে (ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নয়), কলম্বাস ডে আর ভ্যালেন্টাইন্স ডে নিয়ে দুটো অধ্যায় আছে। ৯/১১ এর সময় জয়িতা নিউইয়র্কে কর্মরত ছিলেন, সেই সময়ের অভিজ্ঞতার কথা আছে, আছে ছেলেবেলার ইদ উৎসবের কথাও।
আত্মপ্রকাশের তাগিদ মানুষের মজ্জাগত। আমার মনে হয় এই তাগিদেই গল্প, উপন্যাস, কবিতাসহ যাবতীয় শিল্পমাধ্যমের সৃষ্টি হয়েছে। দূর পরবাসে জয়িতার আত্মপ্রকাশের সূচনা। জয়িতা ভাষা সাবলীল, বাহুল্যবর্জিত। ৩০ বছর পরবাস জীবন একটি বইতে ধরা পড়বে না, জয়িতার কলম (কী বোর্ড বলা উচিত) চালু থাকবে এই বিশ্বাস আমার আছে। আরও অনেক অনেক বিষয় নিয়ে সে লিখবে, প্রবাস জীবনের আনাচে কানাচে ও গভীরে সে প্রবেশ করবে, আরও অনেক অনেক ঋদ্ধ হবে ওর লেখনি এই প্রত্যাশা আমার আছে। আমি সেই অপেক্ষাতে আছি।
দূর পরবাসে প্রকাশ করেছে বাসিয়া প্রকাশনী। প্রচ্ছদ করেছেন দেলোয়ার রিপন। মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা। বাংলাদেশে রকমারি ডট কম থেকে কিনতে পারবেন।

তাসনীম হোসেন । বøগার/ লেখক।
টেক্সাস, ইউএসএ

সুর : শেখ মুজিবুর ।। আতাউর রহমান আফতাব

কাব্যগ্রন্ত্রটি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যর বিশিষ্ট কবি দিলওয়ার। প্রচ্ছদ- ধ্রæব এষ, সাদা-কালো মোড়কে গ্রন্থটি সাজানো হলেও আকর্ষণীয়, আভিজাত্যের প্রতিফলন রয়েছে। প্রকাশক- বাসিয়া প্রকাশনী, সামসুদ্দীন হাউস, স্টেশন রোড, সিলেট। মূল্য- ২২৫ টাকা, প্রকাশকাল- অমর একুশের বইমেলা- ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ।
কবি দিলওয়ার ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। কবির অন্তর্দানের ৭ বছর পর বইটি প্রকাশিত হয়। মোট ৯০টি কবিতা এ গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। গ্রন্ত্রটিতে রয়েছে ২১টি সনেট। সনেট রচনায় কবি দিলওয়ারের সাফল্য ও দক্ষতা যে কেউ স্বীকার করবেন।
বইটির ভূমিকা লিখেছেন কবির
সূযোগ্য পুত্র কামরান ইবনে দিলওয়ার। গ্রন্ত্রটির নাম কবিতা- ‘সুর : শেখ মুজিবুর’। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রথম কবিতা এবং শেষ কবিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাম্যবাদী, গরিব-দুঃখী, মেহনতী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে নিয়ে সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবনের স্বপ্ন দেখতেন তা কবি দিলওয়ারের ভালোই জানা ছিল। কবি দিলওয়ার পৃথিবীর বহু বিখ্যাত মনিষী, রাজনীতিবিদ ও কবি সাহিত্যিকবৃন্দ নিয়ে জীবনে গবেষণা করেছেন। উক্ত গ্রন্থেও তাদের বিষয়ে অকুণ্ঠচিত্তে লিখে গেছেন কবি দিলওয়ার।
স্বদেশ ও স্বজাতীয় চেতনায় জীবনে বারবার দোলায়িত কবি বঙ্গবন্ধুকে উক্ত গ্রন্থে যেন নায়কের ভূমিকায় তুলে ধরেছেন। ‘সুর : শেখ মুজিবুর’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-
‘দেশ যদি বৃক্ষ হয়, তুমি তার প্রণেতা শিকড়
তোমাকে রেখে তাই যারা ঋদ্ধ হতে চায়
বিভ্রান্ত বিশ^াসে তারা হৃদপিন্ডে বৃদ্ধ হতে চায়।
বড় মর্মান্তিক সেই বিচারক কালের আঁচড়।’

‘প্রতিদিন পত্রিকায়’ নামক কবিতা থেকে-
‘আমাকে বলতে দিন সম্মানিত মহোদয়গণ
প্রতিদিন দুঃসংবাদ ছাপা হয় কত?
আমাকে বলতে দিন কত হয় আহত নিহত?
উন্মাদ আশ্রমে আছি এই বোধে কাঁদে কেন মন?

প্রতিদিন পত্রিকায় স্বদেশের আর্তদান শুনি
ছুটছে মাতাল তরী, দৈবাকাশে ঝাঁকের শকুনি।’
‘প্রিয় সম্পাদক’ নামক কবিতায় কোন প্রিয়জন সম্পাদকের উদ্দেশ্য কবি দিলওয়ারের কবিতা দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসার চরম অভিব্যক্তি। যেমন-
‘প্রিয়জন সম্পাদক
বন্ধুজন তুমি
সমস্যা সংকুল দেশে
দৃষ্টি নিষ্পলক।
জানতে চাইবো না আমি
এই দেশে কবে
মুক্তি যুদ্ধ হয়েছিল
মুক্তিপক্ষ পাখির গৌরবে
বলবো না কত রক্ত
রূপ নিল কলঙ্ক কালিতে

আমাতে নৈরাশ্যবাদ
আজন্মই রয়েছে নিখোঁজ
চিরায়ত আলোবায়ু
আমাকে যোগায় রাজভোজ

তাই আমি প্রিয় সম্পাদক
তোমাকে একান্ত চাই রশ্মির কনক
কলমে ছড়াও তুমি
খুলে ধরো প্রাচীন প্যাপিরাস
জ্ঞাত হোক জনশক্তি
কী করে ঘটলো সেই দুর্বোধ্য প্রজ্ঞার সুপ্রকাশ।’
২০০৫ সনের জুন মাসে লিখিত কবিতায় কবি দিলওয়ারের বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সুর তারণ্যের চেতনায় উদ্ভাসিত। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া সে ধরনের ভাব, ভাষা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা প্রকাশ দূর্লভ।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (বর্তমান) অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবির একটি কবিতার অংশ বিশেষ-
তুমি ভুলে গেছো নারী একদিন শিকারী আমাকে
ঘরমুখো করেছিল যৌথভাবে ধানের আবাদে,
সেই কাল খৃষ্টপূর্ব দশ হাজার বছর হল যে!
যদিও তখনো প্রিয়া উঠেনি নোলক তোর নাকে,’
¯েœহ, প্রেম, প্রীতি, আকর্ষণ নারী পুরুষের স্বভাবজাত। ধর্মের বন্ধনে আমরা সংসার গড়ি। নারী পুরুষের মিলনে
হয় সৃষ্টি। কবি সেখানে স্বামী স্ত্রীর প্রেম, মিলন, ভালবাসা
তথা প্রকারান্তরে ধর্মের জয়গান গেয়েছেন। যেমন-
‘ধ্রæপদী আকাশ দেখো পূর্বেকার আদিম নয়নে
তারপরে যাব জুটি সভ্যতার কুসুম কাননে।’
(ধ্রæপদী আকাশ দেখা)
কবি দিলওয়ার তাঁর‘ সুর : শেখ মুজিবুর’ কাব্যগ্রন্ত্রে পৃথিবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে টেনে এনেছেন। যেমন- কাজী নজরুল ইসলাম,রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরম গ্যেটে, সক্রেটিস, এরিষ্টটল, প্লেটো, হোসিয়ড, পিন্ডার, হোমার,
ঈশপ, সফেক্লিস, আলেকজান্ডার, ভার্জিন, দ্বৈপায়ন, ফেরদৌসী, দান্তে, বাল্মিকী, মিল্টন, সেপিয়র, কার্ল মার্কস, স্পার্টাকাস, লিওর্নিদাস, লেনিন, মাওসেতুং, হোচিমিন, আরনেস্টা, চেগুয়েভারা, বেঞ্জামিন জেফানিয়াহ প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদগণকে তুলে ধরেছেন। এমনকি সিলেটের কৃতি সন্তান রাজনীতিবিদ পীর হবিবুর রহমানকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন। তাতে প্রমাণিত হয় কবি জীবনে বিশে^র বিভিন্ন ধর্ম, বিশ^ভ্রহ্মান্ড, দর্শন, সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, বিপ্লব, জাতিতত্ত¡, সবকিছু নিয়েই গবেষণা করেছেন।
‘২২ শে শ্রাবণ’ নামক কবিতায় কবি লিখেন-
‘রবীন্দ্রনাথ, আজ ২২শে শ্রাবণ ১৪০৮
এমনি এক বর্ষাকালে তোমার সর্বশেষ
শরীর সর্বস্ব পরিচিতি
তোমার বিশাল রচনা সম্ভারে
কালের অশ্রæ হয়ে যায়।

রবীন্দ্রনাথ, তুমি সত্যি ভাগ্যবান
বেঁচে থাকলে বিক্ষুদ্ধ বিস্ময়ে নীরিক্ষণ করতে
তোমার লেখা জাতীয় সংগীতে
কী নান্দনিক রক্তকরণ।’
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ‘নজরুলের কৈফিয়ত ডাকে’ কবিতা থেকে-
‘কোথায় যাচ্ছো, তুমি
নজরুলের কৈফিয়ত ডাকে,
তোমার কী কৈফিয়ত
কহে দ্রোহী দৃষ্টি মৌচাকে,

শিকল পড়ার ছল… দেখো তুমি
সত্য হয়ে যায়,
কবিতা ‘বিদ্রোহী’ দিক চূর্ণ করে
সব অন্তরায়।’
কবি দিলওয়ারের চোখে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই সব বাধা, ভেদাভেদ, ভন্ডামীর আসল মুখোশ উন্মোচিত করে, যা কোন দিন কেউ করেছে কি না, আমাদের জানা নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গ্রন্থের শেষ কবিতা। কবি দিলওয়ারের লেখায় বঙ্গবন্ধু বিভিন্নভাবে বিভূষিত হয়েছেন। যেমন-
‘বঙ্গবন্ধু তোমার জন্মদিনে
নিপীড়িত আর শোষিত মানুষজন
নব জীবনের বিপ্লব নিক চিনে…

তোমার জবানে কথিত চার্টার দল
লোহিত সাগরে মিটাক কৌতূহল,
ঝরাক পশুরা মরণাস্ত্রের ঋণে,

মুক্তিযোদ্ধা ফিনিক্স পক্ষী হবে,
গণমানবিক দুরন্ত গৌরবে।
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল কবি দিলওয়ারের, ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে তা অনুমান করা যাবে।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় কাব্যগ্রন্থ ‘সুর : শেখ মুজিবুর’। কবি দিলওয়ারের লিখায় ও চেতনায় বঙ্গবন্ধু মেখ মুজিবুর রহমান এদেশের জাতীয় নায়ক, দেশ জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু।
পরিশেষে আমরা পরপারে বঙ্গবন্ধুর প্রতি জানাই অশেষ শ্রদ্ধা এবং কবির প্রতি মেবারকবাদ।

সিলেট বিভাগের ঠিক মধ্যবিন্দুতে, মহাভারতে বর্ণিত প্রাচীন বরবক্র (বরাক) নদীর তীর ঘেষে, বরাকের শাখা নদী ও তৎপার্শ্ববর্তী হাওড়সমূহের চতূস্পার্শ্বে গড়ে ওঠা জনবসতি, বর্তমান জরিপী ১৪৪টি মৌজায় ২৯৩ গ্রাম ২২৪.৫৪ বর্গ কিলোমিটার আয়তন বিশিষ্ট, ২০১৫ সালের হিসাবানুযায়ী ২,৩০,৪৬৭ জন জনসংখ্যা সম্বলিত একটি প্রাচীন ও ঐতিহাসিক জনপদ যা ‘ওসমানীনগর উপজেলা’ নামে পরিচিত।
ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক, সাদীপুর ইউনিয়নের শেরপুর থেকে দয়ামীর ইউনিয়নের আহমদনগর এবং কুশিয়ারা-বিবিয়ানার নাব্য নদীপথ ও পরবর্তীতে নৌ ও স্থল যোগাযোগ এ অঞ্চলকে পাশর্^বর্তী জেলাসমূহ তথা সারা দেশের সাথে প্রাচীন নৌ ও বর্তমান সড়কপথে সিলেট অঞ্চলের যোগাযোগের কেন্দ্রস্থলে পরিণত করেছে এবং সিলেট বিভাগের যোগাযোগ ব্যবস্থার কেন্দ্রস্থলে থাকার সুবাদে এ অঞ্চল বৃহত্তর সিলেটের রাজনীতি-সংস্কৃতির মিলনস্থল হিসেবে বরাবরই খ্যাতি লাভ করে আসছে।
এর উত্তরে সিলেটের দক্ষিণ সুরমা ও বিশ^নাথ উপজেলা, দক্ষিণে কুশিয়ারা নদীর ওপারে মৌলভীবাজার সদর ও রাজনগর উপজেলা, পশ্চিমে হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর আর পূর্বে বর্তমান বালাগঞ্জ উপজেলা। সূদুর অতীত কাল থেকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বৃহত্তর সিলেটের ভাঙা-গড়া, বৌদ্ধ সংষ্কৃতি, অগ্রহার, ব্রাম্মণ্য বসতি ইত্যাদি অতি নিকট থেকে অবলোকন করেছে এ অঞ্চল এবং প্রভাবিতও হয়েছে সময় সময়। প্রাচীন গৌড়-লাউড় ও দক্ষিণ সিলেটের সীমানা বেষ্টিত এ অঞ্চলটি প্রাচীন গৌড় রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। হযরত শাহজালালের (র.) গৌড়বিজয় কালে তাঁর প্রথম পদস্পর্শে ধন্য হয়েছে এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষ। এ অঞ্চল তাই তার প্রাচীনত্ব ছাড়াও ইতিহাসের বিভিন্ন ভাঙা-গড়া, উত্থান-পতন ও বহুমূখী বিনির্মাণে রেখেছে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ও কালের সাক্ষী হয়ে রয়েছে।

মাতা পিতা একসময় ছিলেন নিজের ঘর-পরিবারের নির্মাতা, সংসার-সমাজের প্রতিষ্ঠাতা। অথচ কালের বিবর্তনে কিছু সংখ্যক হয়েছেন অকর্মণ্য, নিজের ঘরে পরগাছা, সন্তানের চক্ষুশূল এবং পরিবার ও সমাজের বোঝাস্বরূপ।
অথই জলে ভাসমান কচুরিপানার মতো দুর্বিষহ অবস্থা বহে চলে তাদের উপর দিয়ে। শেষ পর্যন্ত তারা তাদের নিজেদের হাতে গড়া পরিবার বা সংসারে হয়ে পড়েন এক প্রকার বন্দি কিংবা অপাংক্তেও।
অথচ মাঠে-ময়দানে খুব জোরেসোরে শোনা যায় যে, ‘আজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ’। কিন্তু এই কথা কেউ স্পষ্ট করে কিংবা জোর দিয়ে বলে না যে, ‘আজকের প্রতিষ্ঠা কেবল গতকালের কষ্টের ফসল’। অর্থাৎ গতকাল যারা কষ্টেসৃষ্টে দিন-রাত পরিশ্রম করে সমাজকে ‘আজ’কে পৌঁছে দিয়েছে, তারা হলেন পিতা মাতা। আজকের সমাজের বৃদ্ধ মানুষেরা। আজকের এই বৃদ্ধরাই একসময় ছিলেন সমাজের ভবিষ্যৎ ও কর্ণধার।
বৃদ্ধগণের প্রতিপালনের ক্ষেত্রে ছেলে-সন্তানদের ঘর-সংসারে লেগে থাকে ভুল বোঝাবুঝি ও ঝগড়া-বিবাদ। অনেক ছেলের বউ তার শ্বশুর-শাশুড়িকে গ্রহণ করতে পারে না নিজের মা-বাপের মতো।
উপরন্তু তারা বৃদ্ধ পিতা মাতার পরিচর্যাকে আরেকটি বাড়তি ঝামেলা মনে করে।
আজকাল অধিকাংশ বৃদ্ধ পিতা মাতা মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের শিকার- যেটা ধ্র“বতারার মতো সত্য।
কোনো কোনো পরিবারে বৃদ্ধ মানুষের জন্য দিন-রজনির সিংহভাগ সময় ব্যয় করতে হয়, যার পুরোটাই পণ্ডশ্রমতুল্য।
ফলে ইসলামি শরীয়ত, বিধি-বিধান, হালাল-হারাম ইত্যাদির তোয়াক্কা না করেও আষাঢ়ের কদম ফুলের মতো দিকে দিকে গড়ে উঠছে বৃদ্ধাশ্রম। এ সকল বৃদ্ধাশ্রমে বসবাস করছেন সমাজের অসংখ্য বৃদ্ধ মানুষ। অনেক বৃদ্ধ পিতা মাতা ছেলে-সন্তান থাকা সত্তে¡ও বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দা হতে বাধ্য। ওইসব সভ্যতার কোনো কিছু না হলেও সমাজের রুঢ় বাস্তবতা।

ইসলাম ও আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা ।। কানিজ আমেনা

আবদুল মুকিত মুখতার। যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখক সাংবাদিক। প্রবাসের কর্মব্যস্ত জীবনে সাহিত্য ও সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে নিরলস চর্চা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ পর্যন্ত তার ১০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ‘ইসলাম ও আধুনিক বিশ্বব্যবস্থা’ তার একাদশ বই। বর্তমান সময়ে ইসলাম ও এ সম্পর্কিত কোনো বিষয়ের উপর কলম ধরা চাট্টিখানি কথা নয়। হৃদয়ে ক্ষণিকের আবেগ চলে এলো আর লিখে ফেললাম দু লাইন- ইসলাম বিষয়টি এমন নয়। কবিতার ক্ষেত্রে হয়তো কেউ কেউ মনে করতে পারেন এ কথাটি প্রযোজ্য নয়। কারণ কবিতা তো আবেগ দিয়ে লেখা হয়। কিন্তু ইসলাম বিষয়ক কোনো কবিতা লিখতে গেলেও উপরোক্ত কথাটি প্রযোজ্য। আবেগের বশে এমন কিছু কবিতার ছত্রে লেখা যাবে না যা শিরকের পর্যায়ভুক্ত হয়ে যায়। আর গবেষণাধর্মী কোনো প্রবন্ধের ক্ষেত্রে তো আবেগ বলতে গেলে পুরোপুরি বর্জনীয়। যে বিষয় নিয়ে লেখা হবে, সেই বিষয়ের উপর প্রচুর পড়াশোনা, অধ্যয়ন ও গবেষণা করে তবেই কলম ধরতে হয়। আর সেই দুঃসাহসিক, কষ্টসাধ্য ও পরিশ্রমসাপেক্ষ কাজটিই করে দেখিয়েছেন লেখক আবদুল মুকিত মুখতার।
বইটি পড়তে যাওয়ার আগেই বইয়ের আয়তনের দিকে এক পলক নজর বুলালেই যেকোনো যেকোনো পাঠক এটি সহজে অনুমান করতে পারবেন।
লেখক বইটিকে তিনটি অধ্যায় বিভক্ত করেছেন। প্রথম অধ্যায়ে যেসব বিষয়ের উপর আলোচনা করেছেন তার মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য শব্দ হচ্ছে- মুক্তচিন্তা, মুক্তিযুদ্ধ, সামাজ্যবাদ, বিশ্বব্যাংক, সন্ত্রাসবাদ, আরব লীগ ও আইসি, ওরিয়েন্টালিজম, ক্রুসেড ও মিডিয়ার ভূমিকা ইত্যাদি। এছাড়াও প্রসঙ্গক্রমে একজন সাহাবীর কথাও এসেছে। তিনি সর্বাধিক হাদীস বর্ণনাকারী প্রখ্যাত সাহাবী হযরত আবু হুরায়রা (রা.)-এর মর্যাদার উপরও আলোকপাত করেছেন।
দ্বিতীয় অধ্যায় আরও বিস্তৃতভাবে এসেছে। এই অধ্যায়ে যেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে তার কিছু উদাহরণ হলো- খিলাফতে উমাইয়া, খারিজী বিদ্রোহ, উটের যুদ্ধ, সিফফিন যুদ্ধ, তাহরীফ এবং তাবীল, খিলাফতে আব্বাসীয়া, ইউরোপের সমাজ ব্যবস্থা, ইয়াহুদীবাদ, গেøাবালাইজেশন, ফরাসী বিপ্লব, তুরস্কের উসমানীয়া খিলাফত ইত্যাদি। এ ছাড়াও যেসব ঐতিহাসিক ব্যক্তিতের আলোচনা এসেছে তারা হলেন তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান (রা.), ইমাম হাসান (রা.), ইমাম হুসাইন (রা.), মুআবীয়া (রা.), ইয়াযীদ, হাজ্জাজ বিন ইউসুফ, উমর ইবনে আবদুল আযীয (রা.), সাদ্দাম হোসেন।
তৃতীয় ও সর্বশেষ অধ্যায়ের অর্ধেক অংশে এসেছে উপমহাদেশের ইতিহাস। যেমন- মোঘল সম্রাট, সম্রাট আকবর, সম্রাট জাহাঙ্গীর, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের জন্ম, ভারত ও বাংলা অঞ্চলে আইনী জটিলতা ইত্যাদি। বাকি অর্ধেক অংশে এসেছে আফগানিস্তান ও রাশিয়ার ইতিহাস। যেমন- আফগানিস্তানে খিলাফত ও তালিবানী চমক, রুশ ভল্লুকের আফগান দখল, আশির দশকের আফগান জিহাদ, বর্তমান আফগানিস্তান, তালিবান বিপ্লব, মোল্লা ওমর, বহির্বিশ্বের শত্রুতা ও তালিবান শাসনের সম্পর্ক ইত্যাদি। এছাড়াও উপসংহারে ইসলামের চারজন খলিফার বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা হয়েছে। সর্বশেষে কুতুবে আলম মাদানী (রহ.)-এর চল্লিশটি বাণী সন্নিবেশিত হয়েছে।
যদি ও বইটি আকারে বিশাল তবু পড়তে বসলে জ্ঞানপিপাসু পাঠক তা সম্পূর্ণ শেষ না করে উঠতে পারবে না বলে আমার বিশ্বাস।
ইসলাম ও আধুনিক বিশ্বব্যবস্থার মতো বিশাল আকারের এই বইটি প্রকাশনার দায়িত্ব নেয়ার মতো সাহস দেখিয়েছেন সিলেটের অগ্রসরমান প্রকাশনীগুলোর অন্যতম বাসিয়া প্রকাশনী। প্রথম প্রকাশ অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০, দ্বিতীয় মুদ্রণ ডিসেম্বর ২০২০। পৃষ্ঠা ৬৩২। বইটির মূল্য রাখা হয়েছে ৮০০ টাকা, প্রচ্ছদ এঁকেছেন দেলোয়ার রিপন।
লেখক আবদুল মুকিত মুখতার প্রচুর সময়, ধৈর্য ও শ্রম বিনিয়োগ করে এমন একটি মূল্যবান তথ্যসমৃদ্ধ বই পাঠক সমাজকে উপহার দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তাঁকে এই কাজের সর্বোত্তম প্রতিদানে ভূষিত করুন এই কামনা।

কৃষ্ণপক্ষের কবিতা ।। সুমন বনিক

করোনা নামক অতিমারি তাবৎ দুনিয়ায় বাসা বেঁধেছে প্রবল আক্রোশে। বুকের পাজরে, চোখের কোঠরে ভয় এসে দানা বাঁধে তিলে তিলে। এক আজানা ব্যাধির হিংস্র থাবায় অসহায় পৃথিবীর মানুষ। শ্লথ হয়ে পড়ে জীবনের গতিধারা, সভ্যতার রথ। ফিকে হয়ে যায় মানুষের বেঁচে থাকার স্বপ্ন। এরকম শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতেও কবি তাঁর কাব্য সুষমার বাতায়ন খুলে বসেন। ভয়-শংকাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে সৃষ্টির নিমগ্ন সাধনায় ব্রতী হন। এই করোনাকালে কাব্যরচনায় কবি এ কে শেরাম জীবন উদযাপনে মেতে ওঠেন চারদেয়ালের প্রকোষ্ঠে। জয় করেন প্রতিটি অপম্রিয়মাণ মুহূর্ত। তাঁর রচিত কৃষ্ণপক্ষের কবিতা বইটি করোনাকালের সময়কে ফ্রেমবন্দি করেছে। কবি অতিমারির বিষাদময়কালকে কবিতায় মলাটবদ্ধ করে মহাকালের হাতে তুলে দেয়ার প্রয়াস খুঁজেছেন।
কবি এ কে শেরাম কবিতাররাজ্যে অবিশ্রান্ত ও অভিজাত অভিযাত্রী। তাঁর কবিতা দিবালোকের মতো সহজ, চাক্ষুষ সুন্দর। তাঁর কবিতায় ভাবুক ধ্যানের প্রকাশ স্বচ্ছতা, কাল-যুক্ততা, নির্মাণকলার মুন্সিয়ানা তাঁকে বিশিষ্টতা এনে দিয়েছে।
তাঁর কৃষ্ণপক্ষের কবিতা বইয়ে হƒদয়ের গহিন থেকে খুঁড়ে খুঁড়ে এনেছেন বিষাদের নীলরং, ভালোবাসার আবির, আর বেঁচে থাকার শস্যদানা। বইটির ভূমিকায় তিনি লিখেছেন মহামারির করাল গ্রাসে পতিত হয় অসংখ্য জীবন। করালে মৃত্যু তার অশুভ ছায়া মেলে দেয় আমাদের ওপর; দুঃখ-কষ্ট, অসহায়তার আর্ত-হাহাকারে ভারি হয় আকাশ-বাতাস, পরিবেশ ও প্রতিবেশ। সবকিছু দেখে দেখে ক্লান্ত-বিষণœ মনে বেদনার হাহাকারগুলো বাণীবদ্ধ করি কবিতার আঙ্গিকে। কৃষ্ণপক্ষের এইসব চূর্ণক ভাবনা তাঁর কবিতায় কল্পনার আধার হয়ে উঠেছে। গ্রন্থাশ্রিত কবিতাসমূহ থেকে কয়েকটি কবিতা পড়ছি-
কোয়ারেন্টাইন জীবন
আমার এখন দিন শুরু হয় রৌদ্রদগ্ধ দুপুরে।/ সকাল দেখি না আমি,/ সকালের সোনালি রোদের স্নিগ্ধ রেণু/ শরীরে মাখিনি অনেকদিন,/ ভোরের বাতাসের সুশীতল ধারাজলে/ মুখ ধোয়া হয় না আমার।/ ঘুম থেকে উঠেই বসে যাই ক্লান্তির প্রাতরাশ নিয়ে,/ সামনে তখন টিভির নিউজ চ্যানেলে/ পপকর্ণের মতো ফটফট ফুটতে থাকে অসংখ্য শব্দ,/ প্রচারিত হতে থাকে চলমান সংকটের সচিত্র প্রতিবেদন।/ মনঃসংযোগ নেই কোনো কিছুতেই,/ মোবাইল নিয়ে নাড়াচাড়া করি/ বেখেয়ালে ঘুরাঘুরি করি ফেবুর পাতায়;/ কতজন কতকিছু লিখে/ প্রয়োজনীয়-অপ্রয়োজনীয় নানা বিষয় নিয়ে;/ নিজেও অনেক হাবিজাবি লিখি।/ এইসব করে করে ক্লান্ত হই,/ এক বিপন্নতার বোধ কেবল কাজ করে যায় গোপনে গোপনে।/ রাতে, বিবমিষা জাগানো মন নিয়ে,/ বিরক্তির বিছানায় শুয়ে শুয়ে দুঃস্বপ্ন দেখি।/ ছটফট করি, নানা উল্টোপাল্টা ভাবি,/ ঠিকমতো ঘুমও আসে না,/ কেবল প্রতীক্ষায় থাকি/ কখন পোহাবে এই দুঃস্বপ্নের রাত।
কবি দুঃস্বপ্ন রাত পোহানোর অপেক্ষায় ছটফট করছেন। গোটা দুনিয়ায় মানুষের মনে আতঙ্কের যে ছটফটানি তা যেন কবির মনেও সঞ্চারিত হয়েছে। কবি ফররুখ আহমদের সেই পাঞ্জেরী কবিতার আকুতি ‘রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী।’ কবি তাই বিবমিষা জাগানো মন নিয়ে দুঃস্বপ্ন রাত কাটাচ্ছেন।
মানুষের মৃত্যু নেই
আমরা দেখেছি,/ মারিতে-মড়কে, প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে,/ অসংখ্য মানুষের মৃত্যু হয় বারংবার;/ তবু মরে না মানুষ।/ মৃত্যুকে অতিক্রম করে বেঁচে থাকে সে।/ পুরাণের ফিনিক্স পাখির মতো/ বারবার সে জেগে ওঠে ভস্মস্তূপ থেকে।/ আসলে,/ মানুষের মৃত্যু নেই;/ অজস্র অসংখ্য মৃত্যুতে বরং সে অমরতা পায়।
মানুষের মৃত্যু নেই এ যেন কবির দার্শনিক উক্তি। আদতে মানুষের মৃত্যু নেই। বরং মৃত্যু মানুষকে অমরতা দান করে। গীতার সেই বাণী জাতস্য হি ধ্রুবমৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। অর্থাৎ, যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী। এই কবিতায় একটি আধ্যাত্মিক দর্শনের রসাস্বাদন করতে পারি। ব্রিটিশ কবি জর্জ হার্বার্টের কবিতায় আমরা আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে কাব্যের সংশ্লেষ পড়ে মুগ্ধ হই, প্রাণিত হই। আমাদের মন ভিজে যায়। কবি এ কে শেরাম তেমন করেই যেন তাঁর এই কবিতায় পাঠকের মন ছুঁয়েছেন।
আছি প্রতীক্ষায়
এখন আমার স্পর্শের যোগ্য কেউ নেই এ পৃথিবীতে,/ এমনকি তুমিও না।/ এখন সবাই অস্পৃশ্য, যেন অশুচি তারা;/ সবাই এখন দূরে দূরে থাকে/ দূর আকাশের তারার মতো।/ আমাদের মধ্যে সম্পর্কের এই নতুন মেরুকরণ/ সৃষ্টি করেছে এক অচেনা-অদেখা শত্রু।/ তাই কেবল প্রতীক্ষায় আছি/ সকলের সাথে/ তুমিও আবার কবে শুচি-শুভ্র সৌন্দর্যে জেগে উঠবে,/ কবে আবার তুমি স্পর্শযোগ্য হবে,/ হবে আগের মতো আবার একান্ত আপনার।
ধ্যানমগ্ন কোনো এক আর্য ঋষির মতো প্রতীক্ষায় আছেন কবি শুচি-শুভ্র দিনের জন্য। সুদিন ফিরে আসবে, পৃথিবীর ফুলেরা হেসে উঠবে। কবি স্পর্শ পাবেন প্রিয়মানুষের। কবি শুদ্ধতার অভিসারী। কবির হƒত হƒদয়ের আর্তনাদ এবং প্রণয়কাতর পাঠক হƒদয়ের হাহাকার; একাকার হয়ে আছে এখানে।
ভালো নেই
ভালো নেই।/ ভালো নেই মন/ ভালো নেই এ জীবন,/ ভালো নেই চেতনার সকাল/ ভালো নেই এই করোনারকাল।/ ভালো নেই এ-পৃথিবী আজ ভালো নেই/ ভালো নেই বিষাদে-বেদনায় তার মন ভালো নেই।/ ভালো নেই বিশ্বের তাবৎ মানুষ ভালো নেই।/ ভালো নেই বাতাস, এই সুনীল আকাশ,/ ভালো নেই গান, ফুলের বাগান,/ ভালো নেই কবিতা ও কবি/ ভালো নেই শিল্পীর ছবি,/ ভালো নেই কিছু,/ ভালো নেই।
কবির এই ভালো নেই কবিতাটি পড়লে, ব্রিটিশ কবি জর্জ হার্বাটের কবিতার শরীর কাঠামোর কথা মনে করিয়ে দেয়। ব্রিটেনের ওয়ালসে ১৫৯৩ সালে জন্ম নেয়া এই কবিকে ইংলিশ রিলিজিয়াস কবি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। তাঁর কবিতায় প্রভু যিশুর পুনরুত্থানের মহিমাবার্তা বিকশিত হয়েছে। কবি এ কে শেরাম তাঁর ভালো নেই কবিতায়, মানুষের ভালো না-থাকার নানান অনুষঙ্গ তুলে এনে সেই কষ্টে জর্জরিত মানুষের বার্তা ¯্রষ্টার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। কবিতার দৈহিক গঠনে হার্বাটের কবিতার সাযুজ্য কিছুটা খুঁজে পাই।
কবি এ কে শেরাম বইতে বিষাদের মাঝে জীবনের রং ছড়ানোর চেষ্টা করেছেন। ভালোবাসার প্রণয়ের কৃষ্ণচূড়া রং মেখেছেন কিছু কিছু কবিতায়। চুম্বনের অধিকার, পরকীয়া, তবুও ভালোবাসা, বদলে যেও না তুমি ইত্যাদি কবিতা হƒদয় জুড়ে কেবলই মুগ্ধতা ছড়ায়। এই গ্রন্থে তাঁর কবিস্বরূপ নিন্দিষ্টতা ও স্বকীয়তা অর্জন করেছে বলে মনে করি। তাঁর কবিতা পরিশীলিত পাঠককুলের হƒদয় স্পর্শ করতে পারবে নিশ্চয়ই। কবির প্রজ্ঞাময় মঙ্গলপ্রত্যয়ী কবিতার পঙক্তি আমাদেরকে বেঁচে থাকতে উদ্বুদ্ধ করে।
কৃষ্ণপক্ষের কবিতা বইতে সর্বমোট চৌষট্টিটি কবিতা ঠাঁই পেয়েছে। আশি পৃষ্ঠার বইটি বাসিয়া প্রকাশনী বের করেছে। মূল্য রাখা হয়েছে একশো পঞ্চাশ টাকা। প্রচ্ছদ এঁকেছেন দেলোয়ার রিপন। কবি বইটি উৎসর্গকৃত করেছেন কবি আবিদ ফায়সালকে। কৃষ্ণপক্ষের কবিতা বইটি প্রিয়তা অর্জনে সক্ষম হবে নিশ্চয়ই। জয় হোক কবি এবং কবিতার । পৃথিবী নিরাময় হোক।

Developed by: