‘ইতিহাস’ শব্দটি অনেক ক্ষেত্রেই এক ধরনের ধূসর রহস্যময়তার আড়ালে ঢাকা। কারণ ইতিহাস নিয়ে নানা সময়েই সৃষ্টি হয়েছে নানা ইতিহাস। ইতিহাসকে খন্ডিত করা হয়েছে নানাভাবেÑবিকৃত করা হয়েছে ইতিহাসের সত্য। আবার কখনোবা পুনর্লিখিত হয়েছে ইতিহাসের ধারা; ইতিহাসকে যাঁরা প্রভাবিত করতে পারেনÑতাঁদেরই প্রয়োজনে। সচরাচর আমরা তাই লক্ষ করি, সাধারণ মানুষ নয়Ñরাজা-রাজড়া তথা শাসক শক্তিরই নানায়তনিক কাহিনীকেই উপজীব্য করে রচিত হয়েছে ইতিহাস। কিন্তু বিরল ব্যতিক্রম হলেও, কোনো কোনো ইতিহাসবিদ নিজস্ব সত্যের কাছে অনুগত থেকে সাধারণ মানুষের প্রাত্যহিক জীবনের রোজনামচা থেকে আহৃত তথ্য নিয়েই রচনা করে থাকেন ইতিহাসের ইতিবৃত্ত। উপমহাদেশের প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ স্যার যদুনাথ সরকারের উচ্চারণে তাই আমরা শুনিÑ ‘ইতিহাস হলো গিয়ে সাধারণ মানুষের উত্থান ও পতন, বিজয় গৌরবের আনন্দ অথবা পরাজয়ের ট্রাজেডী।’ প্রায় একই ধরনের অনুভবের ব্যঞ্জনা শুনি ইতিহাস নির্মাণের এক বিশাল আয়োজন ‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থের প্রণেতা মোহাম্মদ নওয়াব আলীর কণ্ঠেও। ‘কথাসূত্র’ পর্যায়ে তিনি বলেনÑ ‘দক্ষিণ সুরমাÑএক ঐতিহাসিক জনপদের নাম। … এ ঐতিহ্যবাহী বিশাল জনপদের ইতিহাস-ঐতিহ্য ইতোপূর্বে পুস্তক আকারে মানুষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেনি। মানুষ জানতে পারেনি এ জনপদের মাটি ও মানুষের বিস্ময়কর অভাবনীয় সাফল্যের কথা।’ মানুষ স্বভাবতই শিকড়সন্ধানী। মোহাম্মদ নওয়াব আলীও তাই এক অন্তর্গত তাগিদ থেকে তাঁর নিজের শিকড় সন্ধানে প্রবৃত্ত হয়েই যে ইতিহাস নির্মাণের এই বিপুলায়তন উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন তা তিনি অকপটে বলেছেনÑ ‘আমার জন্মভ‚মি যে মাটিতে, আমার শিকড় প্রোথিত যে মাটিতে সে মাটি ও মানুষের ইতিহাস ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করার লক্ষে আমার এ ক্ষুদ্র প্রয়াস।’ কিন্তু এই সত্যের পাশাপাশি আমাদের সমাজবাস্তবতা মোটেও আগ্রহোদ্দীপক নয়Ñবরং হতাশাব্যঞ্জক। কারণ, আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, আমাদের সমাজে ইতিহাসের কদর মোটেও নেই। ইতিহাস নিয়ে প্রবাদপ্রতিম সেই বক্তব্যের কথা আমরা সবাই জানি, ‘ইতিহাসের সবচেয়ে বড়ো শিক্ষা হলো এই যে, ইতিহাস থেকে কেউ শেখে না।’ আমরা জানি, জাতি হিসেবে আমরা যেমন ইতিহাস পাঠে অনাগ্রহী তেমনি চরম অনীহ ইতিহাস রচনায়ও; বিশেষত সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস রচনায়। তাইতো আমরা দেখি শ্রীহট্ট বা সিলেট এক প্রাচীন জনপদ হওয়া সত্তে¡ও সিলেটের নির্ভরযোগ্য সত্যনিষ্ঠ ইতিহাস খুব বেশি রচিত হয়নি। এক ঐতিহ্যবাহী জনপদ দক্ষিণ সুরমা সম্পর্কেতো কোনো গ্রন্থই এযাবত রচিত হয়নি বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন আলোচ্য গ্রন্থের লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলী। অথচ আমরা জানি এবং স্বীকার করি ইতিহাস রচিত হওয়া দরকার। প্রকৃত ইতিহাস ব্যতীত জাতির অগ্রগমণ প্রায় অসম্ভব। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় একারণেই শতাধিক বৎসর আগেই বলে গেছেনÑ ‘বাঙ্গালার ইতিহাস নাই। যাহা আছে তাহা ইতিহাস নয়, তাহা কতক উপন্যাস, কতক বাঙ্গালার বিদেশী বিধর্মী অসার পরপীড়কদের জীবনচরিত মাত্র। বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালার ভরসা নাই। কে লিখিবে? তুমি লিখিবে, আমি লিখিব, সকলেই লিখিবে। যে বাঙালি তাহাকেই লিখিতে হইবে।’ সাহিত্যস¤্রাটের এই আহŸানে সাড়া দিয়েছেন দক্ষিণ সুরমার এক শিকড়সন্ধানী দায়িত্বশীল লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলী। তিনি জানেন, সমগ্র বাংলার না হোক অন্তত নিজ এলাকার গৌরবগাথা নিয়ে, ইতিহাসের নানা কুশীলব আর তাঁদের কর্ম ও কৃতি নিয়ে ইতিহাস রচনার সূচনা তিনি করতেই পারেন। আর কে না জানে, এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাজই বৃহত্তের ভিত গড়ে তোলে। বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায়Ñ ‘যাহার যতটুকু সাধ্য সে ততদূর করুক। ক্ষুদ্র কীট যোজনব্যাপী দ্বীপ নির্মাণ করে।’ আমরা এও জানিÑ ‘ক্ষুদ্র বালুকার কণা বিন্দু বিন্দু জল/ গড়ি তোলে মহাদেশ সাগর অতল।’ এই উপলব্ধির উজ্জ্বল আলোকেই মোহাম্মদ নওয়াব আলী অনেক শ্রম আর মেধা ও মননের স্বেদবিন্দু তিল তিল করে সাজিয়ে গড়ে তোলা ‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ শীর্ষক বেশ বিপুলায়তন এই গ্রন্থখানি আমাদের উপহার দিয়েছেন।
দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ৪৮০ পৃষ্ঠার এই বৃহদায়তন গ্রন্থটিতে পনেরটি অধ্যায়ে বিন্যন্ত হয়েছে ‘দক্ষিণ সুরমা’ নামের এই জনপদের ইতিহাস নির্মিতির যাবতীয় আয়োজন। দক্ষিণ সুরমা বলতে সাধারণত সুরমা নদীর দক্ষিণ পারে অবস্থিত সিলেট শহর সংলগ্ন পূর্বতন সিলেট সদর উপজেলার যে অংশটুকু সেটিকেই বুঝানো হয়ে থাকে। ২০০৫ সালে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় অবস্থিত ৯টি ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত হয় দক্ষিণ সুরমা উপজেলা। এই ৯টি ইউনিয়ন হলোÑ মোল্লারগাঁও, বরইকান্দি, তেতলী, কুচাই, সিলাম, লালাবাজার, জালালপুর, মোগলাবাজার ও দাউদপুর। পরবর্তীতে কামালবাজার নামে নতুন একটি ইউনিয়ন গঠিত হওয়ায় দক্ষিণ সুরমা উপজেলার অন্তর্গত ইউনিয়নের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টি। তবে দক্ষিণ সুরমা উপজেলা ছাড়াও দক্ষিণ সুরমা এলাকায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৩ টি ওয়ার্ডের অবস্থান। এই তিনটি ওয়ার্ড হলোÑ ২৫, ২৬ ও ২৭ নং ওয়ার্ড। এই গ্রন্থে দক্ষিণ সুরমা বলতে দক্ষিণ সুরমা উপজেলার অন্তর্গত ১০টি ইউনিয়ন এবং সিলেট সিটি কর্পোরেশনের উপরোল্লিখিত ৩টি ওয়ার্ডের সমন্বিত ভৌগোলিক পরিসরকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গ্রন্থের প্রথম অধ্যায়ে রয়েছে অবস্থান, নামকরণ ও সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। এই পর্যায়ে উপশিরোনাম হিসেবে স্থান পেয়েছেÑ দক্ষিণ সুরমার মানচিত্র; ভৌগোলিক অবস্থান; উৎপত্তি, নামকরণ ও প্রতিষ্ঠার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস; উপজেলা প্রশাসনিক ভবন; একনজরে উপজেলা পরিচিতি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তালিকা। আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে, ঐতিহ্যবাহী নদী সুরমার দক্ষিণ পার ঘেঁষে এই উপজেলার অবস্থান বলে এর নামকরণ হয়েছে ‘দক্ষিণ সুরমা’। এই উপজেলার আয়তন ১৯৫.৪০ বর্গকিলোমিটার এবং ২০১১ সালের আদমশুমারী অনুযায়ী জনসংখ্যা ২,৫৩,৩৮৮ জন। উপজেলা কমপ্লেক্স স্থাপিত হয়েছে মোগলাবাজার ইউনিয়নের নৈখাই এলাকায় ৬ একর ভ‚মির উপর। এই উপজেলার অন্যান্য বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও সন্নিবেশিত হয়েছে এই অধ্যায়ে। দ্বিতীয় অধ্যায়ের শিরোনামÑ ইউনিয়ন ও সিটি ওয়ার্ডের মানচিত্র ও পরিচিতি। এই অধ্যায়ে দক্ষিণ সুরমা উপজেলাভুক্ত ১০টি ইউনিয়নের মানচিত্র এবং বিস্তারিত পরিচিতি ও আনুষঙ্গিক তথ্যাদি তুলে ধরা হয়েছে। পৃথক পৃথকভাবে প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকাল, আয়তন, জনসংখ্যা, মৌজা ও গ্রামের সংখ্যা, ইউনিয়নের অন্তর্গত মসজিদ, মন্দিরের সংখ্যা এবং প্রকৃতি অনুযায়ী বিভাজনসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাসহ নানা তথ্যাদি যেমন উল্লেখিত হয়েছে, তেমনি মেয়াদকালসহ দায়িত্ব পালনকারী চেয়ারম্যানদের তালিকাও সন্নিবেশিত হয়েছে। একইভাবে সিটি কর্পোরেশনভুক্ত তিনটি ওয়ার্ডের পরিচিতি এবং সংক্ষিপ্ত তথ্যাদিও স্থান পেয়েছে এই অধ্যায়ে। তৃতীয় অধ্যায় সাজানো হয়েছে মৌজা, নদনদী, খালবিল, জলমহাল, নালা, টিলা, হাটবাজার, গ্রামÑএসবের বিস্তারিত বর্ণনা ও এতদসংক্রান্ত বহুবিধ তথ্যের সমাবেশ ঘটিয়ে। ইউনিয়নওয়ারী মৌজা ও গ্রামের তালিকা আছে, আছে হাটবাজারের বিবরণ, খাল ও বিলের তালিকা, তেমনি আছে নদীর নাম এবং সেগুলোর ইতিহাস ও বিস্তারিত বিবরণ। সিলেটের প্রধান নদী সুরমা। সুরমা নদীর নামকরণ প্রসঙ্গে বলা হয়েছেÑ ‘দ্বাদশ শতকের রাজা ক্ষেত্রপাল বরাক নদী হতে খাল কেটে নদীটি খনন করেন এবং প্রিয়তমা স্ত্রীর নামে নাম রাখেন ‘সুরমা’। .. হট্টনাথের পাঁচালিতে উল্লেখ আছে সুরমা নদী মনুষ্যসৃষ্ট কাটা গাঙ। বরাক হতে লোভার সংযোগ পর্যন্ত সাত বাঁক, আটগ্রাম প্রভৃতি স্থানের লোকমুখে নদীর ওই অংশ কাটা নদী বা কাটা গাঙ নামে অভিহিত হয়। তাই বলা যায় দ্বাদশ শতকের মধ্যভাগে সুরমা নদীর জন্ম।’ চতুর্থ অধ্যায়ে আছে ‘মসজিদ, মন্দির, গির্জা, তীর্থস্থান, বিভিন্ন স্থানের নামকরণ, আন্দোলন সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ সুরমা ও গণকবর’ প্রসঙ্গ। গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায়ে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের বিবরণ যেমন আছে, তেমনি আছে বিভিন্ন স্থানের নামকরণের ইতিহাস নিয়ে অনেক মজাদার তথ্য। যেমন, লালাবাজারের নামকরণ হয়েছে হিন্দু জমিদার লালা গৌরহরির নামে, জালালপুরের নামকরণ সাধকপুরুষ হযরত শাহজালাল (র.)-এর নামানুসারে। সিলাম নামকরণের সাথেও যুক্ত আছে হযরত শাহজালালের (র.) শ্রীহট্ট বিজয়ের ঘটনা। জালালী বাহিনীর অগ্রযাত্রা রুদ্ধ করার জন্য গৌড়গোবিন্দ পথে পথে ছড়িয়ে রেখেছিলেন বিশাল আকৃতির সব পাথর বা ‘শিল’। হযরত শাহজালালের (র.) পবিত্র মুখ থেকে তখন উচ্চারিত হয় ‘শীল লাম’ অর্থাৎ পাথর নিচে সরে যাও। সেই ‘শীল লাম’ থেকে ‘সিলাম’ নামের উৎপত্তি বলে উল্লেখ করা হয়েছে গ্রন্থে। আবার খোজারখোলা নামের সাথে জড়িয়ে আছে মোগল আমলের খোজা ব্যবসার প্রসঙ্গটি। এছাড়াও এই অধ্যায়ে আছে আন্দোলন সংগ্রাম এবং মহান মুক্তিযুদ্ধে দক্ষিণ সুরমার অবদান নিয়ে সংক্ষিপ্ত অথচ কৌতুহলোদ্দীপক আলোচনা। মুক্তিযুদ্ধের সূচনালগ্নে একাত্তরের পঁচিশে রাতের কালো রাতে হানাদার পাক-বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে শহীদ হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র ও শিক্ষক। ঐ ঘটনায় শহীদ হন দক্ষিণ সুরমার কৃতী সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ‚তত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. আবদুল মুক্তাদির। গণকবর প্রসঙ্গটিও এসেছে এখানে। তবে মুক্তিযুদ্ধ এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোর আলোচনা আরো অনুপুঙ্খ তথ্যানুসন্ধানের মাধ্যমে আরেকটু বিস্তারিত ও পূর্ণাঙ্গ হলে আমরা উপকৃত হতাম। পঞ্চম অধ্যায়ে ঐতিহাসিক স্থান পর্যায়ে ঐতিহাসিক স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম ব্যক্তিত্ব। প্রথমেই রয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদ বুদ্ধিজীবী ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। এই পর্যায়ে একাত্তরে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সূচনালগ্নে শহীদ হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. আবদুল মুক্তাদির এবং বিশজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার তালিকা তাঁদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতিসহ তুলে ধরা হয়েছে। এর পরপরই রয়েছে জাতির সাহসী সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ইউনিয়নওয়ারী তালিকা। এই তালিকা অনুযায়ী মোল্লারগাঁও ইউনিয়নের ১৫ জন, বরইকান্দি ইউনিয়নের ১৭ জন, তেতলী ইউনিয়নের ১৮ জন, কুচাই ইউনিয়নের ২৭ জন, সিলাম ইউনিয়নের ৫০ জন, লালাবাজার ইউনিয়নের ১৩ জন, জালালপুর ইউনিয়নের ৫২ জন, মোগলাবাজার ইউনিয়নের ৪১ জন, দাউদপুর ইউনিয়নের ১৬ জন, কামালবাজার ইউনিয়নের ১০ জন এবং সিটি কর্পোরেশনের তিনটি ওয়ার্ডে ১১ জন মিলে দক্ষিণ সুরমা জনপদের মোট মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২৭০ জন। গুরুত্বপূর্ণ এই অধ্যায়ে শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, সাংবাদিকতা, রাজনীতি ও সমাজসেবা, ক্রীড়া, আইন বিচার প্রশাসন, তথ্যপ্রযুক্তি, চিকিৎসা, প্রবাসসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রবীণ ও নবীন বিশিষ্টজন, সরকারী ও বেসরকারী পদস্থ ব্যক্তিবর্গ এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ব্যক্তিদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। আগেই উল্লেখিত হয়েছে যে, মোহাম্মদ নওয়াব আলীর দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থটি এই জনপদের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসের নির্মাণের এক বিশাল ও মহাকাব্যিক আয়োজন। এর কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে গ্রন্থের প্রায় অর্ধেক কলেবর জুড়ে ২২০ পৃষ্ঠা ব্যাপ্ত এই অধ্যায়ে অসংখ্য তথ্য ও বর্ণনার সমাবেশে এই জনপদের নানা পর্যায়ের অনেক ব্যক্তিত্বের ছবি ও সংক্ষিপ্ত জীবনী পরিবেশনের আয়োজন থেকে। এ ব্যাপারে একটি সাধারণ ধারণা দেওয়ার জন্যে আমি বিষয়-বিভাজন অনুযায়ী ভুক্তির সংখ্যাগুলো শুধু উল্লেখ করতে চাই। শিক্ষা পর্যায়ে ২৩ জন ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্মের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে, তেমনি সাহিত্য পর্যায়ে ৬৯ জন, সংস্কৃতি পর্যায়ে ৪২ জন, সাংবাদিকতায় ৪০ জন, রাজনীতি ও সমাজসেবায় ২৫ জন, ক্রীড়াক্ষেত্রে ৪৩ জন, আইন বিচার ও প্রশাসন পর্যায়ে ১২ জন, কৃষি শিল্প ব্যবসাবাণিজ্যে ১৪ জন, তথ্যপ্রযুক্তিতে ১১ জন, সরকারি বেসরকারি পদস্থ ব্যক্তিবর্গের তালিকায় ৪১ জন, চিকিৎসায় ৩২ জন এবং প্রবাস পর্যায়ে ৫৪ জনের জীবন ও কৃতি তুলে ধরা হয়েছে। তাছাড়া সিলেট বারে পেশাগত দায়িত্ব পালনরত দক্ষিণ সুরমার আইনজীবীদের একটি তালিকা সংযুক্ত করা হয়েছে, যেখানে ১০০ জন আইনজীবীর নাম ও পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। ব্যক্তিত্ব পর্যায়ের এই অলোচনায় সমসাময়িক বাংলা কবিতার এক প্রধান পুরুষ কবি দিলওয়ার, সিলেটের অন্যতম প্রধান মরমী কবি সুফি সাধক আরকুম শাহ, আসাম প্রাদেশিক পরিষদের স্পীকার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের প্রথম মন্ত্রীসভার সদস্য বসন্ত কুমার দাস, বাংলাদেশের প্রগতিশীল রাজনীতির এক বরেণ্য ব্যক্তিত্ব পীর হবিবুর রহমান, দেশের মহিলা দাবার ক্ষেত্রে এক কিংবদন্তী নাম রাণী হামিদ, সিলেট ও মুসলিম বঙ্গের প্রথম আইসিএস গজনফর আলী খান, রিয়ার এডমিরেল মাহবুব আলী খান, ড. ক্ষণদামোহন দাশ, জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আবদুল মালিক, মানবাধিকার সংস্থা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল-এর সপ্তদশ মহাসচিব আইরিন খান প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। সপ্তম অধ্যায় বর্তমান জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে। এখানে সংসদ সদস্য, উপজেলার চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান, ইউনিয়নসমূহের চেয়ারম্যান এবং সিটি ওয়ার্ড কাউন্সিলারবৃন্দের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। অষ্টম অধ্যায়ে আছে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের খবর। দক্ষিণ সুরমা অঞ্চলে উপজেলা সদর ও তৎসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছাড়াও রয়েছে বিভাগীয় ও জেলার অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও দপ্তর। এগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলো সিলেট বিভাগীয় সদর দপ্তর, ডিআইজি অফিস, সিলেট শিক্ষাবোর্ড, সিলেট রেলস্টেশন, সিলেট বিসিক শিল্পনগরী, কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় রিজিওনাল রিসোর্স সেন্টার, মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট, সিলেট ফরেন পোস্ট অফিস, সিলেট পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, সিলেট সরকারি বাণিজ্যিক মহাবিদ্যালয়, সিলেট সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, সিলেট সরকারি মহিলা কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ইত্যাদি। নবম অধ্যায়ে শীর্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শিরোনামে ১১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। দশম অধ্যায় সাজানো হয়েছে দক্ষিণ সুরমার ৩০টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দিয়ে। আর একাদশ অধ্যায় জুড়ে আছে মাদ্রাসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বর্ণনা। ফাজিল মাদ্রাসা, আলিম মাদ্রাসা, দাখিল মাদ্রাসা, হাফিজিয়া মাদ্রাসা এবং কওমি মাদ্রাসা শিরোনামে বিভক্ত করে দক্ষিণ সুরমার বিভিন্ন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠানের সংক্ষিপ্ত পরিচয় তুলে ধরা হয়েছে এই অধ্যায়ে। একইভাবে প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তালিকা ও বর্ণনা দিয়ে সাজানো হয়েছে দ্বাদশ অধ্যায়। এই অধ্যায়ে ইউনিয়নওয়ারী তালিকা দিয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, কমিউনিটি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়, বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন স্কুল ও ব্র্যাক শিক্ষা কার্যক্রম সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। ত্রয়োদশ অধ্যায় সংসদ, উপজেলা ও সিটি নির্বাচন নিয়ে। এই পর্যায়ে বিভিন্ন সময়ে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের তালিকা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের নাম ও তাঁদের প্রাপ্ত ভোটের বিবরণ যেমন দেওয়া হয়েছে, তেমনি উপজেলা নির্বাচন ও সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের প্রার্থী ও তাঁদের প্রাপ্ত ভোটের তথ্যও সংযোজিত হয়েছে। চতুর্দশ অধ্যায়ের শিরোনাম ওলি আউলিয়া ফকির দরবেশ। আমাদের এই অঞ্চলে ইসলামের বাণী প্রচার করেছিলেন ওলিকুল শিরোমণি হযরত শাহজালাল (র.)। তিনি তাঁর অনুগামী ৩৬০ আউলিয়াকে নিয়ে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীহট্ট বিজয় করেছিলেন বলে ইতিহাসে উল্লেখ মেলে। আর একারণেই সিলেটকে তিনশত ষাট আউলিয়ার দেশও বলা হয়। মোহাম্মদ নওয়াব আলীর এই গ্রন্থে ‘শাহজালাল (র.) ও তিনশ’ ষাট ওলির বিবরণ’ শিরোনামে হযরত শাহজালালের (র.) শ্রীহট্ট বিজয়ের ঘটনাকে ১৩০৩ বঙ্গাব্দের বলে উল্লেখ করা হয়েছে; এটি বড় ধরনের এক মুদ্রণবিভ্রাট। আসলে এই সাল হবে ১৩০৩ খ্রিষ্টাব্দ। শাহজালালের (র.) সফরসঙ্গী ওলির সংখ্যা ৩৬০ জন বলা হলেও লেখকের ভাষায় ‘৩৬০ ওলির নির্ভরযোগ্য একটি তালিকা পাওয়া দুর্লভ। সৈয়দ মর্তুজা আলী’র ‘সুহেলে ইয়ামেনী’ অবলম্বনে হজরত শাহজালাল ও সিলেটের ইতিহাসে ২৫২ জন ওলির নাম উল্লেখ রয়েছে। প্রাচীন পত্রিকা ‘আল ইসলাহ’ ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দে হজরত শাহজালাল (র.) সংখ্যায় মুহম্মদ নূরুল হক ৩২২ জন ওলির নামের তালিকা প্রদান করেছেন।’ লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলীও হযরত শাহজালালের (র.) সফরসঙ্গী সেই ৩২২ জন আউলিয়ার নামতালিকা এই অধ্যায়ে সংযোজন করেছেন। হযরত শাহজালালের (র.) সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে ২২ জন আউলিয়ার মাজার দক্ষিণ সুরমা এলাকায় অবস্থিত বলে উল্লেখ করে লেখক তাঁদের তালিকা সন্নিবেশনের পাশাপাশি অলোকচিত্রসহ মাজারগুলোর পরিচিতি তুলে ধরেছেন। তবে উল্লেখ করা আবশ্যক যে, লেখক শাহজালালের সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম বলে যে ২২ জন আউলিয়ার নামের উল্লেখ ও মাজারের বিবরণ দিয়েছেন, তার মধ্যে অনেকেরই নাম ইতোপূর্বে উল্লেখিত ৩২২ জন আউলিয়ার তালিকার মধ্যে নেই। আসলে, হযরত শাহজালাল (র.)-এর সঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার নাম ও তাঁদের মাজার নিয়ে এ জাতীয় বিভ্রম প্রায়শই লক্ষ করা যায়। সুতরাং, এ ব্যাপারে আরো অনুসন্ধান এবং গবেষণার মাধ্যমে সঠিক তালিকা প্রণয়ন আবশ্যক বলে আমি মনে করি। এছাড়াও লেখক এই অধ্যায়ে দক্ষিণ সুরমা এলাকায় অবস্থিত অন্যান্য ৬৬ জন ওলি আউলিয়া বুজুর্গদের নামতালিকা এবং সচিত্র মাজার পরিচিতিও তুলে ধরেছেন। এক্ষেত্রে লেখক নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়ভাবে অনেক শ্রম ও অভিনিবেশ যুক্ত করেছেন। গ্রন্থের শেষ ও পঞ্চদশ অধ্যায়ের শিরোনাম বিবিধ। এই পর্যায়ে বেসরকারি বৃত্তি পরীক্ষা, রেজিস্ট্রিকৃত সমাজকল্যাণ সমিতি, বহুমূখী সমবায় সমিতি, কৃষি সমবায় সমিতি, মৎসজীবী সমবায় সমিতি, যুব সমবায় সমিতি, সার্বিক গ্রাম উন্নয়ন সমবায় সমিতি, ব্যাংকসমূহ ও কমিউনিটি সেন্টার সংক্রান্ত তথ্য ও উপাত্তের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। এছাড়া এই গ্রন্থ প্রণয়নে এবং তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের ক্ষেত্রে যাঁরা নানাভাবে সহায়তা করেছেন তাঁদের একটি দীর্ঘ তালিকা যেমন লেখক দিয়েছেন, তেমনি সহায়কগ্রন্থের বেশ দীর্ঘ একটি তালিকাও সন্নিবেশিত হয়েছে। যে কোনো সহায়তার জন্যে লেখকের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ বা ঋণ স্বীকারের এই মহৎ ঔদার্য নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
আমি আগেই বলেছি, মোহাম্মদ নওয়াব আলীর ‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থখানি ঐতিহ্যবাহী দক্ষিণ সুরমা জনপদের কাঙ্খিত ইতিহাস নির্মিতির এক বিশাল আয়োজন। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে ইতিহাস নির্মাণের বিচারে কিছু কিছু ন্যূনতা বা অসম্পূর্ণতা থেকে গেছে; কিন্তু তথ্য-উপাত্তের সমাবেশে, কাহিনী বা ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহে, বিভিন্ন মানচিত্র ও আলোকচিত্রের বিন্যাসে যে মহাকাব্যিক আয়োজন সম্পন্ন করেছেন গ্রন্থকার মোহাম্মদ নওয়াব আলী; তা নিঃসন্দেহে বিস্ময়জাগানিয়া। এই জনপদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাথে সংশ্লিষ্ট কোনো তথ্য বা বিষয়ই বাদ পড়েনি মোহাম্মদ নওয়াব আলীর অনুসন্ধানী দৃষ্টির সীমানা থেকে। এজন্যে তাঁকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে, প্রযুক্ত করতে হয়েছে মেধা ও মননের স্বেদবিন্দু। শ্রমসাধ্য অনেক তথ্যানুসন্ধানের পাশাপাশি লেখককে কষ্টকর গবেষণাকর্মেও সক্রিয় হতে হয়েছে। মোহাম্মদ নওয়াব আলীকে এতোদিন আমরা কবি, সম্পাদক ও সংগঠক হিসেবেই চিনতাম; এখন দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস-ঐতিহ্যের এক আকরগ্রন্থ হিসেবে বিবেচ্য এই বিপুলায়তন গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে তাঁর গবেষক পরিচয়টিও সুস্পষ্ট হলো আমাদের সামনে।
মোহাম্মদ নওয়াব আলীর ‘দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য’ গ্রন্থটি সামগ্রিকভাবে খুবই শোভনÑসুন্দর। দক্ষিণ সুরমার মানচিত্রের নিচে সিলেটের হৃদয় ছুঁয়ে বয়ে যাওয়া নদী কল্লোলিনী সুরমার উপর স্থাপিত ঐতিহাসিক কীন ব্রীজের দক্ষিণপ্রান্ত, যা ছুঁয়ে আছে দক্ষিণ সুরমার ভ‚মিকে, এই চিত্ররূপকে প্রেক্ষাপটে রেখে প্রখ্যাত প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রæব এষের করা প্রচ্ছদ যেমন নান্দনিক ও ব্যঞ্জনাময়, তেমনি গ্রন্থভুক্ত বিষয়ের বিশাল প্রেক্ষাপটকে সুবিন্যন্তভাবে সাজানো, পরিচ্ছন্ন মুদ্রণ, চমৎকার বাঁধাইÑসমস্ত কিছুই প্রথম দর্শনে পাঠককে বিমোহিত করার মতো। সরল বাক্যবিন্যাসে গ্রন্থের ভাষা ঝরঝরে ও আকর্ষণীয়।
কিছু কিছু জায়গায় সামান্য ত্রæটি-বিচ্যুতি থাকলেও মুদ্রণপ্রমাদ প্রায় নেই বললেই চলে। ৪৮০ পৃষ্ঠার এই বিশাল ও গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৫০০ টাকা, যা খুবই সহনীয় পর্যায়ে। এই মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করে বাসিয়া প্রকাশনী নিঃসন্দেহে বিদ্বৎসমাজের প্রশংসাধন্য হয়েছেন। দক্ষিণ সুরমার ইতিহাস ও ঐতিহ্য গ্রন্থখানি পাঠকপ্রিয়তায় পাবে এবং এর লেখক মোহাম্মদ নওয়াব আলী কালের প্রসেনিয়ামে এক উজ্জ্বল কুশীলব হয়ে দীর্ঘদিন বেঁচে থাকবেন এই প্রত্যাশা আমি লালন করছি প্রবল প্রত্যয়ে।
লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ জাতীয় কবিতা পরিষদ, সিলেট