‘গাহি সাম্যের গান/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-খ্রিস্টান’…
আজ বুধবার ২৫ মে, ১১ জ্যেষ্ঠ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১১৭তম জন্মবার্ষিকী। দ্রোহ, প্রেম ও সাম্যের কবি হিসেবেও বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভা নজরুল ইসলামকে অভিহিত করা হয়।
১৮৯৯ সাল, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এইদিনে বর্ধমান জেলার (বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গে) আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে কাজী পরিবারে নব জাগরণের এ কবির জন্ম।
জাতীয় পর্যায়ে জাতীয় কবির ১১৭তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনে নানা কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। এ বছর জাতীয় পর্যায়ের এই অনুষ্ঠান হচ্ছে চট্টগ্রামের এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে। কবির জন্মদিনের এ অনুষ্ঠান উদ্বোধন করবেন রাষ্ট্রপতি অ্যাডভোকেট আবদুল হামিদ।
জাতীয় পর্যায়ের অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত ত্রিশাল, কুমিল্লায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। দেশের অন্যান্য জেলায়ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে নজরুলের জন্মবার্ষিকীতে।
বেসরকারি উদ্যোগেও রয়েছে নানা আয়োজন। ভোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে কবির সমাধিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন, আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রয়েছে।
জাতীয় কবির জন্মদিনে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। জাতীয় সব দৈনিক কবির জন্মদিনে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। টেলিভিশন ও রেডিও প্রচার করছে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা।
বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলাম জনপ্রিয় হয়েছেন কবিতা ও গানে। ব্রিটিশ শাসকদের শোষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে কবিতা ও গান লিখে বিদ্রোহী কবি হিসেবে জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে আসেন নজরুল ইসলাম। রচনা করেন ‘বিদ্রোহী’ ও ‘ভাঙ্গার গান’র মতো কবিতা। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ব্রিটিশ সরকার কবিকে জেলে পাঠায়। সেখানে বসে কবি রচনা করেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’। বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের আবির্ভাবকে ধুমকেতুর আত্মপ্রকাশ হিসেবেও দেখেন অনেকে।
বহুমুখী প্রতিভার এ কবি বাংলা সাহিত্যের বিশাল অঙ্গনে ভূমিকা রাখেন ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক হিসেবে। সাহিত্যকর্মের উল্লেখযোগ্য অংশ জুড়ে রয়েছে তার গান। প্রায় ৩ হাজার গান রচনা করেন নজরুল ইসলাম। ইসলামি গজল লিখে বাংলা গানে নতুন এক ধারার সৃষ্টি করেন তিনি। গান রচনার পাশাপাশি সেগুলোতে সুরারোপ করে সমৃদ্ধ করেছেন সঙ্গীতাঙ্গনকে।
নাটক লিখেছেন, ছেলেবেলায় লেটো দলে যোগ দিয়ে নাটকে অভিনয় করেছেন, পরিণত হয়ে লিখেছেনও নাটক। চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লিখেছেন, পরিচালনা এবং অভিনয়ও করেছেন।
বিশ্লেষকদের মতে, ছেলেবেলায় লেটো দলে শুরু হয় নজরুলের সাহিত্যচর্চা, যা পরিণতি পায় সৈনিক জীবন থেকে ফেরার পর। সৃষ্টির সময় মাত্র দুই দশক। যুদ্ধ থেকে ফিরে ১৯২২ থেকে ১৯৪২ সাল। স্বল্প এ সময়ে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় নজরুলের অবদান অনন্য বলেও মত তাদের।
বরেণ্য এ কবি নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠেছেন। মাত্র ৯ বছর বয়সে পিতা কাজী ফকির আহমেদকে হারিয়ে এলামেলো হয়ে যায় সামনে চলার পথ। আর্থিক অনটনে পড়ে বই-খাতা রেখে রোজগারে নেমে পড়তে বাধ্য হন নজরুল। কখনও মসজিদের ইমামতি, মাজারের খাদেমগিরি, চায়ের দোকানে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছে তাকে। ছেলেবেলায় তার নাম রাখা হয় ‘দুখু মিয়া’।
আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটির কাজ করার সময় সেখানে কর্মরত দারোগা রফিজ উল্লাহ’র সঙ্গে পরিচয় হয় নজরুলের। তিনি কিশোর নজরুল নিয়ে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দেন। এটা ১৯১৪ সালের কথা। মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষা না দিয়ে ১৯১৭ সালে সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন নজরুল ইসলাম। অংশ নেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধে।
১৯৪২ সালে আকস্মিক অসুস্থ হয়ে পড়েন নজরুল। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর চিকিৎসকরা জানান, বাংলা সাহিত্যের অনন্য প্রতিভার এ কবি পিকস ডিজিজে আক্রান্ত। এক পর্যায়ে মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন চিরবিদ্রোহী এ কবি। এতে তার সাহিত্যচর্চা পুরোপুরি থেমে যায়।
কোলকাতায় পারিবারিক তত্ত্বাবধানে থাকা বাকরুদ্ধ এ কবিকে ১৯৭২ সালের ২৪ মে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এখানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় রাখা হয় নজরুল ইসলামকে। অভিসিক্ত করা হয় বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদায়।
চিরবিদ্রোহী এ কবি ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট সকাল ১০টা ১০ মিনিটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। ‘আজান’ কবিতায় চাওয়া শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয় চির জাগরণের এ কবিকে, যা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ সংলগ্ন।