বিভাগ: মুক্তিযুদ্ধ

তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক জেবউননেছা

55813667_257771258342570_1786844521284239360_nমুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও স্মৃতি সংরক্ষণ এবং অন্ধকারে থাকা মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় আলোতে আনতে মুক্তিযুদ্ধের উপর গবেষণায় ইতিমধ্যে সাড়া জাগিয়েছেন নারায়ণগঞ্জের মেধাবী সন্তান ড. জেবউননেছা। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারপার্সন এই শিক্ষকের জন্ম যদিও মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রায় দশ বছর পরে। তবে ইতিমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস ও অজানা অনেকগুলো বিষয় আলোতে এনেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লোক প্রশাসন বিভাগের এই শিক্ষক দেশের নানা প্রান্ত থেকে মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ ঘটনা ও ইতিহাস সংগ্রহ ও গবেষণার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জের বিষয়গুলোও তিনি বেশ গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের প্রকাশিতব্য ‘এনসাইক্লোপেডিয়া অব বাংলাদেশ ওয়ার অব লিবারেশনে’র বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতিকথা এন্ট্রি লেখক হিসেবে লিখেছেন এই তরুণ গবেষক। ২০০৯ সনে তাঁর সম্পাদিত প্রথম গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধ: বুদ্ধিজীবির দৃষ্টিকোণ ও অভিজ্ঞতা’ গ্রন্থের মুখবন্ধের এক পর্যায়ে তিনি লিখেন, ‘পারিবারিকভাবে বাবার কাছ থেকে শিখেছি কিভাবে ভালোবাসতে হয় দেশকে। কিভাবে শ্রদ্ধা করতে হয় মুক্তিযোদ্ধাকে। আশি দশকের শেষের দিকে আমার বাবা কবি ও নাট্যকার মুঃ জালাল উদ্দিন নলুয়া রচিত ‘টাকার পাহাড় চাই’ নাটকের একটি সংলাপ ছিল ‘জন্মদাতা, কর্মদাতা, শিক্ষাদাতার মতোই আমি ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি দেশের মুক্তিদাতা ও মুক্তিযোদ্ধাদের’। এই সংলাপটি তাঁর মনের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা সৃষ্টি করেছিল।’ তবে ১৯৯৫ সনের দিকে নিজ এলাকা নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।শিশু শিল্পী হিসেবে ছোটবেলা থেকেই মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক কবিতা এবং নাটক পরিবেশন করে বেশ কিছু পুরস্কার কুঁড়িয়েছেন। তাঁর রচিত গবেষণাগ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধে নারী’ নামক গ্রন্থটি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর রচিত ‘মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা’ প্রবন্ধ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ‘অগ্রপথিক’ মার্চ, ২০১৪ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘একাত্তুরের যাত্রী’ নামক সংগঠন থেকে প্রকাশিত ‘একাত্তুরের নারী’ ম্যাগাজিনে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নারীদের নিয়ে লেখা ‘তোমাদেরকে জানাই সালাম’ লেখা প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নানা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক ‘টক শো’তে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সংগঠন থেকে আমন্ত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বক্তব্য এবং সেমিনারে লেখা পাঠ করেন। তিনি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে আয়োজিত সেমিনারে ‘মুক্তিযুদ্ধে নারীর ভূমিকা’ নামক গবেষণাভিত্তিক লেখা পাঠ করেন। জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকায় তাঁর মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একাধিক লেখা প্রকাশিত হয়েছে। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের নেটওয়ার্ক শিক্ষক হিসেবে গত ১০ বছর যাবৎ দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষার্থীদের মাঝে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছড়িয়ে দেবার জন্য শিক্ষার্থীবৃন্দদের নিয়ে তিনি ‘মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ পরিদর্শন করেন। তিনি প্রতিবছর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর ও অভিযাত্রী আয়োজিত “অদম্য পদযাত্রা”য় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের “সমন্বয়ক” হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা সম্পর্কে সর্ম্পকে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভবিষ্যতে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সত্যিকারের কাহিনী নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এবং ডকুমেন্টারী ফ্লিম করার পরিকল্পনা রয়েছে। তিনি জানান, ধানমন্ডি সরকারী বালিকা বিদ্যালয়ের ‘টর্চার সেল’ মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক স্থান সংরক্ষণ প্রকল্পে অন্তভূর্ক্ত করা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যালয়টিতে একনেকের অর্থায়নে একটি শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়েছে। ড. জেবউননেছার প্রকাশিত গ্রন্থ-‘আলোকিত নারীদের স্মৃতিতে মুক্তিযুদ্ধ’ নামক গ্রন্থটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ‘পাঠাভ্যাস উন্নয়ন কর্মসূচী’র অন্তর্ভূক্ত। বর্তমানে নারায়ণগঞ্জের মাসদাইরের রংপুর হাউসে অবস্থিত দু’জন শহীদ জালাল উদ্দিন হায়দার রানা এবং তৌফিক সাত্তার চুন্নার কবরকে শহীদের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার জন্য কাজ করছেন। তিনি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধের স্মৃতিকথা সম্বলিত ‘সূর্য সন্তানদের ৭১ এর স্মৃতি’ নামক গ্রন্থ সম্পাদনা করেন। তিনি ১৯৫২ এর সত্যিকারের ইতিহাস নিয়ে মুঃ জালাল উদ্দিন নলুয়া রচিত ‘বাংলা আমার বাংলা’ নামক একুশভিত্তিক নাটক সম্পাদনা করেন। উক্ত দুটি গ্রন্থ স্বনামধন্য প্রকাশনী “অনন্যা প্রকাশনী” থেকে প্রকাশিত হয়েছে।তিনি মুঃ জালাল উদ্দিন নলুয়া রচিত ‘বঙ্গবন্ধু একুশ নির্বাচিত কবিতা’ নামক কাব্যগ্রন্থ সম্পাদনা করেন। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি তরুণ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক হিসেবে বিনোদনধারা পারফরম্যান্স এ্যাওয়াড, বিশেষ সম্মাননা-২০১৪,আমরা কুঁড়ি পদক-২০১৪, বঙ্গবীর ওসমানী স্মৃতি পুরষ্কার -২০১৩ এবং বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক পরিষদ (বাসাপ এ্যাওয়ার্ড)-২০১৩ অর্জন করেন।

একান্ত সাাৎকারে প্রবাসী মুক্তিযুদ্ধা মো. কাচা মিয়া সাাৎকার গ্রহণ: মোহাম্মদ নওয়াব আলী

Kasa Miah-4Kasa Miah-2মো. কাচা মিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রবাসী সংগঠক। ১৯৭১ সালে রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধে পরাধীন দেশ জাতির স্বাধীনতার সোনালি স্বপ্ন নিয়ে বহির্বিশ্বে যে সব স্বদেশ প্রেমিকরা সংগঠিত হয়ে বিভিন্নভাবে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার্জনের বন্ধুর পথকে সুগম করার সার্থক প্রয়াস পেয়েছিলেন, ঐতিহ্যবাহী বিশ্বনাথ উপজেলার কৃতীসন্তান মো. কাচা মিয়া তাদের একজন, এমনকি অগ্রগণ্য বলা যায়। স্বদেশ স্বজাতি যখন পাকহানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে দিশেহারা, পাকিস্তানী দুর্বৃত্তদের বহুজাতিক নির্মম অত্যাচারে আবহমান বাঙালি জাতি যখন অতিষ্ট ঠিক তখন নির্যাতিত দেশ জাতির পে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন মো. কাচা মিয়া। তিনি স্বাধীনতাকামী কতিপয় হৃদয়বান প্রবাসী বাঙালি বন্ধুদের নিয়ে যুক্তরাজ্যের ওল্ডহ্যাম শহরে ওল্ডহ্যাম-বাংলাদেশি ইয়ুথলীগ নামে একটি ব্যতিক্রমধর্মী সংগঠনের রূপায়ন করেন এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সম্পূর্ণ অভিনব দতার সাথে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। উল্লেখিত সংগঠনটি বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পে সর্বপ্রথম সংগঠন। ওল্ডহ্যাম-বাংলাদেশি ইয়ুথলীগের ল্য ছিল প্রবাসী বাঙালিদের নিকট থেকে সাপ্তাহিক চাঁদা সংগ্রহ করে ওইসব মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দান করা। স্বদেশ প্রেমিক কাচা মিয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সুদ নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী ওল্ডহ্যামবাসী বাঙালিরা বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা জমা করেন। ওইসব মুদ্রা অস্ত্র কেনার কাজে ব্যবহৃত হয়। সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব মো. কাচা মিয়া বিশ্বনাথ উপজেলার ৫নং দৌলতপুর ইউনিয়নের নয়াগাঁও গ্রামে ১৯৩৮ খ্রি. ১লা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মো. ছিদ্দেক আলী ও মাতা আফতেরা বিবি। তিনি ১৯৬২ খ্রি. যুক্তরাজ্য গমন করেন। মো. কাচা মিয়া একজন সফল সংগঠক এবং বিশ্বস্ত সমাজসেবক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির ধারক মো. কাচা মিয়া ওল্ডহ্যাম শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের প্রাণ পুরুষ। এক সময় বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। প্রগতিশীল রাজনীতিতে আস্থাশীল মো. কাচা মিয়া দীর্ঘদিন ওল্ডহ্যাম আওয়ামীলীগের সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক কর্মকাণ্ডের সাথে তাঁর গভীর সম্পৃক্ততা রয়েছে যথারীতি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বইপত্রে উজ্জ্বল অরে লিপিবদ্ধ রয়েছে তার সংগ্রামী ভূমিকার কথা। বিশ্বনাথের অহংকার, মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সংগঠক মো. কাচা মিয়ার একটি সংপ্তি সাাৎকার মাসিক বাসিয়ায় প্রকাশিত হলো। এটা মননশীল পাঠকের নিকট প্রিয়পাঠ্য হলে আমাদের পরিশ্রম সার্থক মনে করবো।
বাসিয়া: সুদূর প্রবাসে থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনি বিরাট অবদান রাখার প্রয়াস পেয়েছেন। তো এ েেত্র কাজ করার আপনার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
কাচা মিয়া: বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। এখানকার মাটিতে আমার নাঁড়ি প্রোথিত। সঙ্গতকারণে এদেশ ও দেশের মাটির সাথে আমি আত্মিকভাবে সম্পর্কিত। স্বদেশ স্বজাতির সমস্যাকে আমি আমার নিজের সমস্যা মনে করি। দেশজাতির অগ্রগতি-উন্নয়নের সংবাদে যে রকম পুলকিতবোধ করি তদ্রপ অবনতি ও অশান্তির সংবাদে ও মর্মাহত হয়ে থাকি। ’৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার্জনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পরবর্তীতে ২৬ শে মার্চ যখন পাকহানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালাতে শুরু করলো তখন গোটা বিশ্ব বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করলো তাদের পৈচাশিক কর্মকাণ্ডের দিকে। বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শুরু হলো প্রতিরোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ। যেটা সুদীর্ঘ ন’মাস চলমান ছিল। পাকিস্তানী স্বৈরাচারীদের প্রতি আমরা প্রবাসীদের মনোভাব বেশ অসন্তুষ্ট ছিল সেই ’৭০ সালের নির্বাচন থেকে। ওই সময়ের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের বিজয় হলে মতা হস্তান্তরে কর্তৃপরে গড়িমসি আমাদেরকে সীমাহীন হতাশ করে। তখন থেকে আমাদের আর বুঝতে অবশিষ্ট থাকলো না যে বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতা আসবে না। সেই উপলব্ধিকে কেন্দ্র করে মোট ৩৬ জন সহকমীদের নিয়ে আমি ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশি ইয়ূথলীগ নামে বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে সংগঠন করি।
বাসিয়া: বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আপনি। এটা বিরাট এক অহংকারের বিষয়। এ প্রসঙ্গে আপনার অনুভূতি জানতে চাই?
কাচা মিয়া: বহির্বিশ্বে ওল্ডহ্যাম শহরে আমার উদ্যোগে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতায় ওল্ডহ্যাম-বাংলাদেশি ইয়ূথলীগ গঠন করি। আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সে বাস্তবতায় বহির্বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। পরবর্তীতে বিশেষ করে ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপে বিভিন্ন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটা এক বিরাট গৌরবের বিষয়। আমি সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলাম। এক সময় স্বাধীনতা অর্জিত হলে আমি আমার স্বপ্নকে সফল মনে করলাম।
বাসিয়া: কিছুদিন পূর্বে আমরা জানতে পারলাম যে, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য আপনাকে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিলম্বের কারণ কী মনে করেন।
কাচা মিয়া: কিছুদিন পূর্বে যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের উদ্যোগে আমাকে সম্মান প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সংবাদে আমিও আশাবাদী হই। অতপর কর্তৃপরে পিছুটানের প্রকৃত কারণ খুঁজে পাইনি। হয়তো সময় সুযোগের অপোয় তারা রয়েছেন। এ ব্যাপারে আমার করণীয় কিছু আছে বলে মনে করি না। বাংলাদেশ সরকারের ডাক এলে আমি সে ডাকে তাৎণিক সাড়া দিতে দ্বিধাবোধ করবো না।
বাসিয়া: স্বাধীনতার্জনের পর বাঙালি জাতি কতোটুকু উপকৃত হয়েছে বলে মনে করেন?
কাচা মিয়া: স্বাধীনতা বাঙালি জাতিকে যথার্থ উচ্চতায় প্রতিস্থাপিত করেছে। বাঙালি আর পরাধীন নয়। একটি স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবদীপ্ত পরিচিতি আজ বিশ্বময়। আমরা এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই- এমনকি কচুপাতার পানিও নই। স্বাধীনতার্জনের পর বাঙালি বহুপ্রকার বিজয়ের অসংখ্য মাইলফলক অতিক্রম করেছে। আমরা যে সীমাহীন উপকৃত হয়েছি তা বলার অপো রাখে না।
বাসিয়া: জাতির জনক শেখ মুজিব সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?
কাচা মিয়া: শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। বিশ্বসেরা যে ৫/৭ জন নেতা রয়েছেন শেখ মুজিব তাদের একজন। আমি যখন ওল্ডহ্যাম শহরস্থ মাপল মিলে চাকরি করি তখন মঞ্জুর আহমদ নামধারী আমার এক সহকর্মী কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে একটা টাইগার আছেন যার নাম শেখ মুজিব।’ কিউবার প্রেসিডেন্ট যাকে হিমালয়ের সাথে তুলনা করেছেন তার মূল্যায়ন ও কী করবো। শেখ মুজিব একজন আন্তর্জাতিক মানের নেতা। সাহস, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, বিচণতা দূরদর্শিতা ইত্যাদি কোনো কিছুর কমতি ছিল না শেখ মুজিবের।
বাসিয়া: একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আপনি কীভাবে দেখেন?
কাচা মিয়া: সূচনালগ্ন থেকেই গণতন্ত্র নানা ঘাত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়ে আসছে। ’৭৫ এর পনোরো আগস্ট জাতির জনক ট্রাজেডি গণতন্ত্রের ভিত্তিকে প্রকম্পিত করেছে। পঁচাত্তর পরবর্তীতে অনেক স্বৈরাচারীদের করতলগত হয়েছে এদেশের মসনদ। তারা খেয়াল খুশী মত মূল চার নীতির শল্য চিকিৎসা করেছেন। আমার মতে জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের ধারাকে বাধাগ্রস্থ করেছে। ফলে তিগ্রস্থ হয়েছে গণতন্ত্র। ওই সব না হলে এতদিনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিশ্ব দহলিজে আদর্শ হয়ে যেতো। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এখনও আমাদের স্বপে অবস্থান করতে পারছে না। একাত্তরে তাদের ভূমিকা যেরূপ ছিল বর্তমানে সেরূপ রয়েছে বলে মনে হয়। তারা চায় না বাংলাদেশ অগ্রগতির ধারায় আবর্তিত হোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার ৭ম নৌবহরের সংবাদ কার অজানা? রাশিয়া, ভারত আমাদের পাশে না থাকলে এত কম সময়ে স্বাধীনতার্জন সম্ভব হতো না। ইউরোপ-আমেরিকা চায় বাংলাদেশ তাদের দিকনির্দেশনায় চলুক পান্তরে শেখ মুজিবের মেয়ে চান স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে চলতে। পশ্চিমারা শেখ হাসিনার নীতি আদর্শের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারছে না। শেখ হাসিনার গঠনমূলক নেতৃত্ব দেশজাতিকে আলাদা উচ্চতায় উপনীত করেছে। তাঁর ব্যতিক্রমী অগ্রযাত্রা প্রতিরোধকল্পে আন্তজার্তিক অসংখ্য ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল রয়েছে। কোনো মোড়ল রাষ্ট্রের করুণায় নয়; আপন বুদ্ধিমত্তার বলে শেখ হাসিনা এখন বিশ্বনেত্রী। এ গৌরব গোটা বাঙালি জাতির। উচ্চ মতাসম্পন্ন কোনো অস্ত্র নয়, জনপ্রিয়তাই ছিল শেখ মুজিবের মোম হাতিয়ার। ১৯৭৪ সালের দুর্ভি ছিল অনেকটা মানব সৃষ্ট। আমেরিকা সময় মতো ত্রাণ জাহাজ প্রেরণ করলে দুর্ভিরে মাত্রা এত সীমাহীন হতো না। ওই সময় পাক প্রেসিডেন্ট, ’৭১ এর পরাজিত মুখ, ইয়াহিয়া চীন সফরে যাওয়ার সময় দুর্ভি পীড়িত বাংলাদেশের করুণ চিত্র দেখে রুমাল দিয়ে মুখ ডেকে ছিলেন।
বাসিয়া: অনেক বাঙালি যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাদেশ সম্পর্কে কীরূপ ধারণা পোষণ করে থাকে?
কাচা মিয়া: গণতন্ত্রের দৌড়ে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগামী। শেখ হাসিনার মতো নেতার নেতৃত্ব অব্যাহত থাকলে অচিরেই গণতান্ত্রিক বিকাশ ঘটবে তা মনে করা যায়। আমি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিজয়ে সম্পূর্ণরূপে আশাবাদী। যে যেখানে জন্মগ্রহণ করে সে স্থানই তার জন্মভূমি। যুক্তরাজ্যে অসংখ্য বাঙালি স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত করছে। খুঁজে নিচ্ছে সুখ সমৃদ্ধজীবন তাদের উত্তরসূরীরা বাংলাদেশকে তাদের পিতার কিংবা দাদার দেশ বলে ভালো জানে। তারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে মনে প্রাণে। দেশের উন্নয়নের সংবাদে খুশী হয়, আনন্দবোধ করে থাকে। তাদের অধিকাংশরা সময় সুযোগে বাংলাদেশ সফর করে এমন কি করবেও। বাংলাদেশ সুখী সমৃদ্ধ একটি আত্ম নির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভে ধন্য হোক ওই প্রত্যাশা আমারও।
ধন্যবাদ আপনাকে।

গোলাম আযম আইসিউতে

1414075710জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির ও মানবতা-বিরোধী অপরাধের দায়ে ৯০ বছরের কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি গোলাম আযমকে বৃহস্পতিবার আবার আইসিউতে নেয়া হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে তার রক্তচাপ কমে যাওয়ায় তাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রিজন সেল থেকে কার্ডিয়াক আইসিউতে স্থানান্তর করা হয়। তাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছে। এর আগেও তাকে দুবার হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিত্সা দেয়া হয়েছিল।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক আব্দুল মজিদ ভুঁইয়া জানিয়েছেন— বুধবার বিকাল থেকেই গোলাম আযমের শারীরিক অবস্থার কিছুটা অবনতি ঘটে। তবে তিনি সংকটাপন্ন নন।

শহিদ নেওয়ার আলী

2-11১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন শহিদ নেওয়ার আলী ছিলেন টকবগে কিশোর। দেশমাতৃকার টান ছিল তাঁর রক্তকণিকায়। তাই সকলের অজান্তে মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতে চলে যান এবং ট্রেনিং গ্রহণ করে দেশে এসে সম্মুখ সমরে যোগ দেন। মেজর সি.আর দত্তের অধীনে ফেঞ্চুগঞ্জ, কুলাউড়া সীমান্তে যুদ্ধ করে পাকসেনাদের ঘায়েল করতে থাকেন। তিনি শ্যামবাজারে পাক সেনাদের অবস্থান জানতে পেরে তাঁর বন্ধু মানিককে নিয়ে শ্যামবাজারে পাশে একটি ব্রিজ উপড়ে ফেলার প্রস্তুতকালে একজন বিশ্বাসঘাতক মুক্তিযোদ্ধার গোপন আতাঁতে তারা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়ে যান। পাক সেনারা তাদেরকে আটক করে নির্যাতন করতে থাকে এবং এক পর্যায়ে মেরে ফেলে। তাদের সমাধিস্থল পাওয়া যায়নি। তাঁর গেজেট নং ২১৫, মুক্তিবার্তা নং ০৫০১০১০৩৫৮। মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় নং ২২৩৮৯।
শহিদ নেওয়ার আলী মোগলাবাজার ইউনিয়নের সরিষপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা (মরহুম) হাজি আকবর আলী ও মাতা সোনাবান খানম। সাত ভাইয়ের মধ্যে নেওয়ার আলী দ্বিতীয়।

শহিদ নায়েক ইব্রাহিম আলী

2-12আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় নায়েক ইব্রাহিম আলী রংপুরে ই.আর.পিতে চাকরিরত ছিলেন। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতার পে কথা বলায় তাঁকে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল পাকিস্তানের পাকআর্মি তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
কুচাই ইউনিয়নের গংগানগর গ্রামের বাসিন্দা ইব্রাহিম আলী। পিতা (মরহুম) ইউসুফ আলী ও মাতা পাতাই বিবি। তাঁর ব্যক্তিগত নং ছিল ১০৯২।

শহিদ এনামুল হক মনু

১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে জগন্নাথপুর থানার শ্রীরামসী উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্র শহিদ এনামুল হক মনু। সেদিন চোখের সামনেই ঘটে গেল এক বর্বরোচিত তাণ্ডবলীলা। পাক হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতার শিকার হলেন তাঁর শিক্ষক সহ শ্রীরামসী গ্রামের প্রায় আড়াই শত লোক। তাঁদের প্রাণ বলিদানের ঘটনায় তিনি মুচড়ে পড়েন। প্রতিশোধের শিখায় জ্বলে ওঠে তাঁর বিদ্রোহী অন্তর। তিনি মুক্তিযুদ্ধের ট্রেনিং আয়ত্ত করতে থাকেন এবং এক সময় ঝাঁপিয়ে পড়েন প্রতিপক্ষের ওপর। ৯ মাসের যুদ্ধের শেষের দিকে তিনি সুযোগসুবিধা মতো বাড়ি ফিরে আসেন। উদ্দেশ্য ছিল বৃদ্ধ দাদি মাকে একনজর দেখে যাবেন। কিন্তু বিদায় বেলায় বাধ সাধলেন মা-বাবা, ভাইবোন সকলে। দেশমাতৃকার টানে যিনি মাতাল, তাঁকে কি ধাবিয়ে রাখা যায়। তিনি চলে গেলেন সকলের চোখে ধূলি দিয়ে। শহিদ এনাম একজন মাত্র সঙ্গী নিয়ে হানাদারের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং শত্র“দের নিশ্চিহ্ন করতে থাকেন। যখন বিজয়ীর বেশে ফিরে এলেন তখন তিনি শত্র“দের কাছে ধরা পড়ে যান। তারা এনামকে নিয়ে আসে সিলেট সার্কিট হাউসে। সেখানে ৪/৫ দিন বর্বোরচিত নির্যাতনের পর শত্র“ বাহিনীর পাষণ্ড জল্লাদদের এস.এল.আর এর গুলিতে তার প্রতিটি অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যান। হাসিমুখে মৃত্যুকে বরণ করে নিলেন তিনি।
সিলেটের দক্ষিণ সুরমার বর্তমান কামালবাজার ইউনিয়নের পুরানগাঁও গ্রামের সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে শহিদ এনাম জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মো. ওয়ারিছ আলী ও মাতা মোছা. আলফিনা বেগম। শহিদ এনামুল হক মনুর মুক্তিবার্তা নং ০৫০১০১০১৪১।

শহিদ বুদ্ধিজীবী ড. আব্দুল মুক্তাদির

27-7-2ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক শহিদ বুদ্ধিজীবী ড. আব্দুল মুক্তাদির সিলেটের দক্ষিণ সুরমার সিলাম ইউনিয়নের পশ্চিমপাড়া গ্রামে ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ১৯ ফেব্র“য়ারি এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা (মরহুম) মৌলবি আব্দুল জব্বার (এফ.এম) একজন সমাজসেবী ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তাঁরই অক্লান্ত পরিশ্রমে প্রতিষ্ঠিত হয় সিলাম পদ্মালোচন জুনিয়র উচ্চবিদ্যালয় এবং তিনি বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও সম্পাদক ছিলেন।
ড. মুক্তাদিরের ৩ ভাই, ৪ বোন। ভাইবোনদের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। গ্রামেই কাটে শহিদ ড. মুক্তাদিরের শৈশবকাল। তিনি সিলাম চকবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক শিক্ষাসম্পন্ন করে সিলাম জুনিয়র উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীকালে শহরের ঐতিহ্যবাহী রাজা জি.সি উচ্চবিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সঙ্গে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে তিনি সিলেট এম.সি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে ইন্টারমিডিয়েট এবং ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর অব সায়েন্স ডিগ্রি লাভ করেন।
তিনি ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভূতত্ত্বে এম.এসসি ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন সরকারের আমলে সহকারী ভূতত্ত্ববিদ হিসেবে পানি উন্নয়ন বোর্ডে চাকরি নেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দের ১৯ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। ভূতত্ত্বে কৃতিত্বের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ পিএইচ.ডি ডিগ্রির জন্য লন্ডন পাঠান। তিনি লন্ডন থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ভূতত্ত্বে পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন। ড. মুক্তাদির ভূতত্ত্বে আরও উচ্চতর গবেষণার জন্য আমেরিকা যাবার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিমা শাসকদের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দালালরা তাঁর স্বপ্নপূরণ হতে দেয়নি। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হানাদার বাহিনীর প্রথম নির্মমতার শিকার হন যে ক’জন অধ্যাপক তাঁদের অন্যতম ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মুক্তাদির। ২৫ মার্চ সেই ভয়াল কালো রাতে যখন ড. মুক্তাদির ফজরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখনই হঠাৎ দরজার কড়া নড়ে। বাথরুম থেকে অজু শেষ করে দরজা খুলে দেন তিনি। দরজা খুলতেই অস্ত্রধারী কয়েকজন প্রবেশ করে তাঁকে জোর করে ধরে নিয়ে যায় ঘরের বাইরে। তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামীকে রক্ষার জন্য চেষ্টা চালান নিজের জীবনবাজি রেখে। ২বার তাক করা অস্ত্রের সামনে দাঁড়ান। বার বার হানাদাররা তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। ৩ বারের সময় তিনি মাটিতে পড়ে উঠার আগেই হানাদাররা গুলি চালায় তাঁর স্বামীর বুকে। স্ত্রীর শেষ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। মুক্তাদির মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। হানাদাররা শহিদ ড. মুক্তাদিরের লাশ রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে যায়। পরে আত্মীয়স্বজনরা বহু কষ্টে তাঁর লাশ সংগ্রহ করেন। ড. মুক্তাদির পুরানা পল্টনের ৭৮/এ লাইনের বাসভবনের পাশের মসজিদের নিকটই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।
শহিদ বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে সরকার ডাক টিকেট প্রকাশ করেছেন। তাতে ড. মুক্তাদিরেরও স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের একটি বিভাগের কক্ষের নাম শহিদ ড. মুক্তাদির জাদুঘর নামকরণ করেছে।
এছাড়া শহিদ ড. মুক্তাদিরকে হানাদার বাহিনী যে অধ্যাপক কোয়ার্টার থেকে ধরে নিয়ে হত্যা করে সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ একটি স্মৃতিফলক স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। এছাড়া শহিদ ড. মুক্তাদিরের জন্মস্থান সিলামে সুরমা সমাজ কল্যাণ সংঘ শহিদ ড. মুক্তাদির গণশিক্ষা কেন্দ্র চালু করার মহতী ্উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় স্বাধীনতার বেশক’টি বছর পেরিয়ে গেলেও এই কৃতী সন্তানের নামে সিলেটে কিছুই করা হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর সিলেট সুলতানপুর সড়কের চণ্ডিপুলে শহিদ ড. মুক্তাদির রোড নাম দিয়ে একটি সাইন বোর্ড টাঙানো হয়েছিল। সাইনবোর্ড নষ্ট হয়ে গেলে এই নামটি মুছে যায়।
সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো ড. মুক্তাদির যখন শহিদ হন তখন তাঁর স্ত্রী অন্তঃসত্ত্বা। তাঁর একমাত্র মেয়ে সামছিয়া মুক্তাদির ইলোরা তাঁর বাবার স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছে। সে বাবা বলে ডাকতে পারেনি। বাবার আদর তাঁর ভাগ্যে জোটেনি। তবু বাবার স্মৃতি ধরে রাখার মানসে বাবাকে অমর করে রাখতে চায়। তাঁর গর্ব বাবা দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন।

Developed by: