জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক

31-22বাংলাদেশের হৃদরোগ চিকিৎসার পথিকৃৎ জাতীয় অধ্যাপক ব্রিগেডিয়ার (অব.) ডা. আব্দুল মালিক ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ১ ডিসেম্বর দক্ষিণ সুরমা উপজেলার কুচাই ইউনিয়নের পশ্চিমভাগ (নোয়াগাঁও) গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। খুব অল্প বয়সে তিনি তাঁর পিতা মো. ফুরকান আলীকে হারান। মাতা সৈয়দা নূরুন্নেছা খাতুনের ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই আজ তাঁর এতদূর আসা! মায়ের পূর্বপুরুষ সৈয়দ আফজল খন্দকার (রহ.) ছিলেন হজরত শাহজালাল (রহ.)-এর ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম। তাঁর মাজার সিলেট জেলার দক্ষিণ সুরমার জালালপুর, মিরারগাঁও এ অবস্থিত।
১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে এম.বি.বি.এস পাস করেন। মেধাবী ছাত্র হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে সকল পরীক্ষায় তিনি সরকারি বৃত্তি লাভ করেন। পরবর্তীকালে তিনি এম.আর.সি.পি (ইউ.কে), এফ.আর.সি.পি (গ্লাসগো), এফ.আর.সি.পি (এডিনবার্গ), এফ.সি.পি.এস (বিডি), এফ.সি.সি.পি (ইউ.এস.এ), এফ.এ.সি.সি (ইউ.এস.এ) ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে তিনি পাকিস্তান আর্মি মেডিকেল কোরে যোগ দেন। চাকুরিতে পেশাগত দক্ষতার কারণে সরকারি খরচে পরিবারসহ ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিলাতে যান। ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি এম.আর.সি.পি পাস করেন এবং হ্যামার স্মিথ হসপিটাল অ্যান্ড পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিকেল স্কুল, লন্ডন থেকে কার্ডিওলজিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি দেশে ফেরেন এবং তখন থেকে ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত মিলিটারি হসপিটাল এবং আর্মডফোর্সেস মেডিকেল কলেজ রাওয়ালপিন্ডিতে শিক্ষক এবং কার্ডিওলজিস্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি এম.এইচ রাওয়ালপিন্ডিতে কার্ডিওলজি ইউনিট স্থাপন করেন, যেখানে মার্চ ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি করা হয়। এজন্য পাকিস্তান সরকার তাঁকে টি.আই পদবিতে ভূষিত করেন।
তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে হৃদরোগের কোনও আধুনিক চিকিৎসা সুবিধা ছিল না। এজন্য তিনি ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন আই.পি.জি.এম.আর, ঢাকাতে (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) প্রফেসর অব কার্ডিওলজি হিসেবে যোগ দেন এবং কার্ডিওলজি ইউনিট স্থাপন করেন। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি সেখানে কর্মরত ছিলেন। তাঁরই প্রচেষ্টায় ঢাকায় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়, সেখানে তিনি ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক কাম অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই ইনস্টিটিউটে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের প্রথম ওপেন হার্ট সার্জারি হয়। ১৯৮৮ থেকে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি জাতীয় বাতজ্বর ও হৃদরোগ নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ছিলেন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে সরকারি চাকুরি থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেন।
২০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এবং ধর্মবিষয়ক মন্ত্রণালয় এর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ কার্ডিয়াক সোসাইটি, সার্ক কার্ডিয়াক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থা এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি জড়িত আছেন।
তিনি কিছু ডাক্তার এবং অন্যান্য পেশার সমাজ সেবকদের নিয়ে ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশ গঠন করেন। এই ফাউন্ডেশন একটি অলাভজনক, সেবামূলক, সরকার কর্তৃক অনুমোদিত ও সাহায্যপুষ্ট বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এটি ডড়ৎষফ ঐবধৎঃ ঋবফবৎধঃরড়হ (ডঐঋ) এবং ডড়ৎষফ ঐুঢ়বৎঃবহংরড়হ খবধমঁব (ডঐখ) এর সদস্য। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট এই ফাউন্ডেশনের একটি প্রকল্প। বর্তমানে এই হাসপাতালটি ৩০০ শয্যাবিশিষ্ট একটি আন্তর্জাতিক মানসস্পন্ন আধুনিক হৃদরোগ হাসপাতাল। এই হাসপাতালে হৃদরোগের সব ধরনের সর্বাধুনিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও চিকিৎসা অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে করা হয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে এর ৩৩টি এফিলিয়েটেড বডি আছে। তিনি ফাউন্ডেশনের অনারারি মহাসচিব হিসেবে অত্যন্ত নিষ্ঠা এবং সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন।
কর্ম সুবাদে তিনি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সভা ও সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর রচনাবলি বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। তিনি ‘জীবনের কিছু কথা’ নামক একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন; যার বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ গরিব রোগীদের জন্য গঠিত ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালের লিল্লাহ ফান্ডে জমা হয়। হৃদরোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা ক্ষেত্রে অসাধারণ অবদান রাখার জন্য তিনি বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন। ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কার এবং ২০০৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় অধ্যাপক পদে ভূষিত হন।
ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সুখি এবং সফল মানুষ তিনি। তাঁর স্ত্রী মিসেস আশরাফুন্নেসা খাতুন একজন সমাজসেবিকা, এক কন্যা প্রফেসর ফজিলা-তুন-নেছা মালিক বাংলাদেশের খ্যাতনামা কার্ডিওলজিস্ট, এক পুত্র মাসুদ মালিক ব্যবসায়ী এবং দ্বিতীয় পুত্র মনজুর মালিক কানাডায় চাকুরিরত।

Developed by: