গত চার দশকে দেশে নৌ-দুর্ঘটনায় দশ সহস্রাধিক মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় পাঁচ শতাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও মাত্র ৫টি’র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাকি ৯৯ ভাগ প্রতিবেদনই আলোর মুখ দেখেনি। আবার প্রকাশিত তদন্ত কমিটির সুপারিশও কার্যকর হয়নি। এসব দুর্ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার। এর মধ্যে মাত্র ২০০টি মামলা নিষ্পত্তি হলেও অভিযুক্ত কারোরই শাস্তি হয়নি। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) সমীক্ষা ও সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান ইত্তেফাককে বলেন, প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। তবে ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ নৌ-যান চলাচলের কারণে নৌ-দুর্ঘটনা বাড়ছে। তিনি জানান, নৌ-দুর্ঘটনা রোধে সকল নৌ-যানকে জরিপের আওতায় আনা হচ্ছে। ফিটনেসবিহীন ও ত্রুটিপূর্ণ নৌ-যানের বিরুদ্ধে শিগগিরই অভিযান পরিচালনা করা হবে।
এদিকে নৌ-দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে বহুল আলোচিত ‘নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রকল্প’টি দীর্ঘদিনেও বাস্তবায়ন হয়নি। প্রায় ৪০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের ফাইলটি অজানা কারণে কয়েক বছর ধরে লাল ফিতায় আটকে আছে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে নৌ-দুর্ঘটনা অনেকাংশে কমবে বলে জানিয়েছেন নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা। বিআইডব্লিউটিএ’র সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ১৯৭১ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত গত ৪৩ বছরে নৌ-দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে ১০ হাজার ৩১৬ জন যাত্রীর। এর মধ্যে বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটেছে শতাধিক। সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয় ২০১৩ সালে। এ বছর তিনটি বড় দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় ১ হাজার ১০৫ জনের। সর্বশেষ গত সোমবার মুন্সিগঞ্জের মাওয়া ঘাটের কাছে পদ্মা নদীতে এম এল পিনাক-৬ নামের একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবে নিখোঁজ হন ১৫০ যাত্রী। গত দুই দিনে ৪ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ নৌ-পথে চলাচলকারী শতকরা ৮০ ভাগ নৌ-যানেরই ফিটনেস নেই বলে ওই সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে প্রায় ২০ হাজার। দুইশ’ মামলা নিষ্পত্তি হলেও দোষী কাউকেই শাস্তি দেয়া যায়নি বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। নৌ-মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত সংঘটিত নৌ-দুর্ঘটনা তদন্তে ৫ শতাধিক কমিটি গঠিত হয়েছে। এরমধ্যে মাত্র ৫টি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেও সুপারিশসমূহ বাস্তবায়ন হয়নি। সর্বশেষ লঞ্চডুবির ঘটনায়ও ২টি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
লঞ্চ দুর্ঘটনার পাঁচ কারণ: যে ৫টি তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তার মধ্যে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে ঝড়ের কবলে পড়া এমভি মিরাজ-৪ যাত্রীবাহী লঞ্চ দুর্ঘটনার প্রতিবেদন অন্যতম। গত ১৫ মে দুই শতাধিক যাত্রী নিয়ে লঞ্চটি ডুবে যায়। মর্মান্তিক এই দুর্ঘটনায় ৫৭ ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় একজন যুগ্ম-সচিবকে প্রধান করে ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। মন্ত্রণালয় গঠিত ওই তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে পাঁচ কারণে নৌ-দুর্ঘটনা ঘটছে বলে উল্লেখ করা হয়। কারণগুলো হচ্ছে এক. নৌযানের কাঠামোগত ও কারিগরি ত্রুটি ও দুর্বলতা, দুই. নৌযান চালকের দুর্বলতা বা ত্রুটি, তিন. নৌযানের স্থিতিশীলতা বিনষ্টকারী পদ্ধতিতে যাত্রী ও মাল বোঝাই করা, চার. ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাই করা এবং পাঁচ. ঝড় বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
অন্য একটি তদন্ত কমিটির মতে, লঞ্চ দুর্ঘটনার জন্য প্রধানত দায়ী নৌ-যানের ত্রুটিপূর্ণ নকশা, অদক্ষ চালক, অতিরিক্ত যাত্রী ও পণ্যবোঝাই এবং আবহাওয়ার পূর্বাভাস না মানা। আবার বেশির ভাগ নৌ-যানে প্রাণরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থাও থাকে না। বিভিন্ন তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে করা এসব সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়েছে সামান্যই। দেখা গেছে, মন্ত্রণালয় থেকে নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নের ঘোষণা দিলেও তা আর কার্যকর হয়নি।
এ প্রসঙ্গে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ইত্তেফাককে বলেন, লঞ্চ মালিকদের প্রভাবসহ নানা কারণে তদন্ত রিপোর্টের সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে না। তিনি বলেন, সামপ্রতিক বছরগুলোতে বহুল আলোচিত বেশ কয়েকটি দুর্ঘটনার কারণ হচ্ছে যাত্রীবাহী লঞ্চের কাঠামোগত ও কারিগরি ত্রুটি। অনেক ক্ষেত্রে এটাই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ বিষয়ে মেরিন প্রকৌশলী ড. এনামুল হক ইত্তেফাককে বলেন, মূল ডিজাইন পরিবর্তন করার পরও ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয়েছে এমন অসংখ্য নৌ-যান দেশের বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। এ ধরনের ‘ইন্সপেকশন রিপোর্ট’ প্রচুর থাকা সত্ত্বেও প্রভাবশালী মহলের কারণে মন্ত্রণালয় কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছে না। তিনি জানান, মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত ছিল, যাত্রীবাহী নৌ-যানের খোলকে ‘ওয়াটার টাইট’ না করা পর্যন্ত ফিটনেস সনদ দেয়া হবে না। ‘হাইড্রোলিক স্টিয়ারিং’ ও ‘ইকো সাউন্ডার’ সংযোগ করে যারা লঞ্চ চালাবেন কেবলমাত্র তাদেরই রুট পারমিট দেয়া হবে।
ফিটনেস নেই অধিকাংশ নৌ-যানের: দেশের নৌ-পথে চলাচলকারী শতকরা ৮০ ভাগ নৌ-যানই ফিটনেসবিহীন বলে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, বিআইডব্লিউটিএ’র এক শ্রেণীর অসত্ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহায়তায় এসব ফিটনেসবিহীন লঞ্চ চলাচল করছে। শুধু ঈদ নয়, সারা বছরই চলে এসব নৌযান। তবে ঈদের সময় এদের চলাচল বেড়ে যায়।
জানা গেছে, চলাচলের অনুপযোগী ‘সি’ ক্যাটাগরির যাত্রীবাহী লঞ্চগুলো আগের মতোই ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে। বর্তমান ও বিগত সরকারের আমলে এ লঞ্চগুলো চলাচলের ওপর একাধিকবার বিধি-নিষেধ আরোপের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে নৌ-মন্ত্রণালয়। প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপে মন্ত্রণালয়ের চেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত শত যাত্রীর করুণ মৃত্যু হলেও লঞ্চ মালিকেরা সবসময় পার পেয়ে গেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে লঞ্চ দুর্ঘটনার নেপথ্যে মন্ত্রণালয় পাঁচ কারণ চিহ্নিত করলেও এখন পর্যন্ত এগুলো সমাধানে জোরালো কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রকল্পে যা রয়েছে: নৌ-দুর্ঘটনা প্রতিরোধ প্রকল্পে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—স্থানীয়ভাবে আবহাওয়া বার্তা সংগ্রহ করে নৌযানগুলোকে সতর্কীকরণের জন্য ১১টি স্থানে আবহাওয়া কেন্দ্র স্থাপন, নিরাপদ জাহাজ নির্মাণের জন্য ‘টোয়িং ট্যাংক’ (নৌ-যানের নদী বা সমুদ্রের স্রোত প্রতিরোধ ক্ষমতা পরীক্ষা) স্থাপন ও ‘ইনক্লাইনিং টেস্ট’ (স্থায়িত্ব পরীক্ষা) এর ব্যবস্থা এবং বিদ্যমান নৌ-যানগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করতে একটি রিভলভিং ফান্ড গঠন।
গুরুত্বপূর্ণ যে ১১টি স্থানে আবহাওয়া স্টেশন স্থাপন করার পরিকল্পনা রয়েছে সেগুলো হচ্ছে আশুগঞ্জ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, চাঁদপুর, বরিশাল, কাউখালী, পটুয়াখালী, রামগতি, পাটুরিয়া, বাঘাবাড়ী ও মাওয়া। এছাড়া যেখানে সেখানে লঞ্চ তৈরি করা যাবে না। শুধু সরকারের তালিকাভুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন ডকইয়ার্ডগুলোতেই লঞ্চ তৈরি করা যাবে বলে প্রকল্পে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে এ প্রকল্পটির কাজ এখনো শুরু করা যায়নি বলে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।