প্রভাবশালী লঞ্চ মালিকদের অর্থলিপ্সা আর সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের অনৈতিক অর্থোপার্জনের কারণে নৌপথে বার বার দুর্ঘটনা ঘটছেই। অকালে অসংখ্য প্রাণহানির পাশাপাশি ভেঙে যাচ্ছে বহু পরিবারের স্বপ্ন।
একমাত্র আয়ক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে অনেক পরিবার নাম লেখাতে বাধ্য হচ্ছে অসহায়-দুঃস্থদের তালিকায়। সোমবার পদ্মার মাওয়া-চরজানাজাত নৌপথে এমএল পিনাক-৬ লঞ্চ দুর্ঘটনার পেছনেও রয়েছে মালিকের অবৈধ প্রভাব ও স্বেচ্ছাচারিতা। সেই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক সরকারি কর্মকর্তার দায়িত্বহীনতা ও অর্থলিপ্সা।
দুর্ঘটনাকবলিত লঞ্চটির বৈরী আবহাওয়ায় চলাচলের অনুমতি ছিল না। এছাড়া নৌযানটির ধারণক্ষমতা নির্ধারিত ছিল সর্বোচ্চ ৮৫ জন। অথচ তিন শতাধিক যাত্রী বোঝাই করে মাদারীপুরের চরজানাজাত (কাওড়াকান্দি) ঘাট থেকে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া ঘাটের উদ্দেশে ছেড়ে আসে লঞ্চটি। ফলে অতিরিক্ত যাত্রীর চাপে ও বৈরী আবহাওয়ায় প্রবল স্রোতে প্রমত্তা পদ্মায় নিমজ্জ্বিত হয় দোতলা লঞ্চ এমএল পিনাক-৬। এ ঘটনায় এক শিশু ও এক তরুণীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এখনো নিখোঁজ রয়েছে প্রায় দেড়শতাধিক যাত্রী।
বিধিসম্মতভাবে নৌযান চলাচল করছে কি না- তা তদারকির জন্য ঈদুল ফিতরের আগে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের একজন সার্ভেয়ারকে মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌপথে বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। কিন্তু তিনি সে দায়িত্ব পালন করেননি। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্রে এবং ‘অভিশপ্ত’ লঞ্চটির বেঁচে যাওয়া একাধিক যাত্রী এবং চরজানাজাত (কাওড়াকান্দি) ও মাওয়া ঘাটের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী নৌযান চালকের বক্তব্যে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর (ডস) সূত্রে জানা গেছে, সর্বশেষ গত জুলাই মাসে এমএল পিনাক-৬ এর বার্ষিক সার্ভে করে (ফিটনেস পরীক্ষা) চলাচলের অনুমতি দেয়া হয়। ডসের ঢাকাস্থ সদরঘাট কার্যালয়ের ‘প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক’ মির্জা সাইফুর রহমান নৌযানটির ফিটনেস সনদ প্রদান করেন। এরপর বিআইডব্লিউটিএ রুট পারমিট দেয়। তবে এর আগে ডকইয়ার্ডে নৌযানটির যান্ত্রিক ও অবকাঠামোগত ত্রুটিগুলো সংশোধনের পরই ফিটনেস প্রদান করা হয়।
অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী একেএম ফখরুল ইসলাম জানান, লঞ্চটির ফিটনেস প্রদানকালে সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ার দু’টি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত জুড়ে দেন। এর একটি হচ্ছে- দিনের বেলা শান্ত পানিতে সর্বোচ্চ ৮৫ জন যাত্রী বহন করা যাবে। অপর শর্তে বলা হয়, আবহাওয়া অধিদপ্তর সমুদ্রবন্দর অথবা নৌবন্দরে কোনো ধরনের সতর্কতা সংকেত দেখাতে বললে লঞ্চটি চলাচল করতে পারবে না। অথচ দুর্ঘটনার সময় আবহাওয়ার এই সতর্ক বার্তা বহাল থাকা সত্ত্বেও তা উপেক্ষা করে লঞ্চটি চলাচল করছিল এবং ধারণ ক্ষমতার অনেক বেশি যাত্রী বহন করা হয়েছিল বলে ফখরুল ইসলাম জানান।
অভ্যন্তরীণ নৌ চলাচল অধ্যাদেশ (আইএসও)-১৯৭৬ এর বরাত দিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর সূত্র জানায়, যে কোনো নৌযানের ফিটনেস প্রদানকালে সংশ্লিষ্ট সার্ভেয়ারের আরোপিত শর্তগুলো লঞ্চমালিক, মাস্টার (চালক), বন্দর কর্মকর্তা ও পরিদর্শকসহ সংশ্লিষ্ট এলাকায় নৌযান চলাচল তদারকির দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তার ওপর প্রযোজ্য।
এসব শর্ত অমান্য করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু লঞ্চমালিক কিংবা লঞ্চটির চালক, বিআইডব্লিউটিএ’র মাওয়া নদীবন্দরের কাওড়াকান্দি ঘাটের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের পরিদর্শক- কেউই এমএল পিনাক-৬ এর ওপর আরোপিত শর্ত দু’টি মানেননি। এমনকি মাওয়া অঞ্চলে নৌচলাচল তদারকির বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের ‘প্রকৌশলী ও জাহাজ জরিপকারক’ মো. মুঈনউদ্দিন জুলফিকারও এ ব্যাপারে উদাসীনতা ও গাফিলতি দেখিয়েছেন।
অভিযোগ উঠেছে, ঈদে মানুষের নির্বিঘ্ন যাতায়াতের জন্য নৌ পরিবহনমন্ত্রীর সম্মতিক্রমে সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর তাকে গুরুত্বপূর্ণ এ দায়িত্ব দিলেও তিনি জনস্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়ে অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই লঞ্চটিকে বৈরী আবহাওয়ায় চলাচলের সুযোগ করে দিয়েছেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, সার্ভেয়ার মুঈনউদ্দিন জুলফিকার কার্যত মাওয়া অঞ্চলে দায়িত্ব পালন না করে নিয়মিত ঢাকায় অবস্থান করছেন।
প্রসঙ্গত, মাওয়া-কাওড়াকান্দি নৌপথে শতাধিক লঞ্চ চলাচল করে। এর মধ্যে ৮৭টির নিবন্ধন থাকলেও নিয়মিত বার্ষিক ফিটনেস সনদ নিয়ে চলাচল করে প্রায় ৭০টি। তবে সেগুলোর অধিকাংশই অনেক পুরানো এবং এগুলোর অবকাঠামোগত যথেষ্ট ত্রুটি রয়েছে। সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর এসব লক্কড়-ঝক্কড় লঞ্চকে বিশেষ ডকিংয়ের মাধ্যমে চলাচলের উপযোগী করার জন্য বার বার তাগিদ দিয়ে আসলেও প্রভাবশালী লঞ্চমালিকরা তা আমলে নিচ্ছেন না।
উল্লেখ্য, লঞ্চ দুর্ঘটনায় গত দুই দশকে পাঁচ হাজার ২৯৩ জনের মৃত্যু হয়েছে (সোমবার পর্যন্ত)। ১৯৯৪ সাল থেকে সোমবার পর্যন্ত সংঘটিত ৬৫৬টি দুর্ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন ১ হাজার ২৩৬ জন। সব সদস্যের মৃত্যুর কারণে নিশ্চিহ্ন হয়েছে ৩৯৩টি পরিবার। একমাত্র উপার্জনক্ষম সদস্যকে হারিয়ে ৬৫৬টি পরিবার উদ্বাস্তু-ছিন্নমূল হয়েছে।
দেশের বিশিষ্ট নাগরিকরা বলেন, বিভিন্ন সরকারের উদাসীনতার কারণে নৌ পরিবহন খাতের আশানুরূপ উন্নয়ন হচ্ছে না। বেপরোয়া নদী দখল ও দূষণের কারণে নৌপথ বিলুপ্তসহ প্রতিবছর লঞ্চ দুর্ঘটনায় ব্যাপক প্রাণহানি ঘটছে। এজন্য সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সব মহলকে অধিক মনোযোগী ও তৎপর হতে হবে। তবে সরকারকেই পালন করতে হবে মূখ্য ভূমিকা।
জল পরিবেশ ইনস্টিটিউটের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ম. ইনামুল হক বলেন, ‘বাংলাদেশে নৌ পরিবহন ব্যবস্থাই যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম হওয়া উচিৎ ছিল। কিন্তু তা না হওয়ার কারণে নৌ-খাতের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি।’
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর তারিক আলী বলেন, ‘নৌ-দুর্ঘটনা কমাতে হলে নৌযানের নকশা যথাযথভাবে প্রণয়নের পাশাপাশি নির্মাণ কাজও কঠোরভাবে তদারকি করতে হবে; যাতে ত্রুটিপূর্ণ নৌযান চলাচল করতে না পারে।’
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) কেন্দ্রীয় নেতা রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘লঞ্চ দুর্ঘটনারোধ এবং নৌ-খাতের উন্নয়নে পুরো প্রক্রিয়াকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি সরকারি কর্মকাণ্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হওয়া আবশ্যক।’