ইউনেস্কোর ‘শান্তিবৃক্ষ’ সম্মাননা পেলেন প্রধানমন্ত্রী

a2ede62f274c5afc8e880ee125ba7d4fনারী ও কন্যাশিশুদের স্বাক্ষরতা ও শিক্ষা প্রসারে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘শান্তির বৃক্ষ’ (ট্রি অব পিস) স্মারক উপহার দিয়েছে ইউনেস্কো।
 সোমবার সকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে এ স্মারক তুলে দেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা।
শেখ হাসিনা স্মারকটি গ্রহণ করে সংস্থাটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন এবং উপহারটি বাংলাদেশ ও বিশ্বের সব কন্যা শিশু ও নারীদের প্রতি উত্সর্গ করেন। একই সঙ্গে তিনি রূপকল্প-২০৪১’র ভিত্তিতে একটি উন্নত, সুশিক্ষিত ও বিজ্ঞানমনস্ক সমাজ গঠনের সোপান রচনায় বাংলাদেশের দৃঢ় প্রতিজ্ঞার কথা পুনর্ব্যক্ত করেন।
জাতিসংঘ মহাসচিবের গ্লোবাল এডুকেশন ফার্স্ট ইনিসিয়েটিভ (জিইএফআই)’র সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার ও ইউনেস্কো’র উদ্যোগে ‘নারী ও কন্যাশিশুদের স্বাক্ষরতা ও শিক্ষা: টেকসই উন্নয়নের ভিত্তি’ শীর্ষক এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। নারী ও কন্যাশিশুদের শিক্ষা প্রসারে স্বীকৃতি স্মারক ‘শান্তির বৃক্ষ’ দেয়ার সময় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে ইউনেস্কোর মহাপরিচালক বলেন, সমঝোতা শান্তি এবং স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে ‘ট্রি অব পিস’ প্রদানের মাধ্যমে আপনার অবদানের স্বীকৃতি দেয়া হলো।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একজন সাহসী নারী। বিশ্ব পর্যায়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নারী ও কন্যাশিশুদের ক্ষমতায়নে রয়েছে জোরালো কণ্ঠ। এ সময় তিনি শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে বলেন, আপনি (শেখ হাসিনা) ইউনেস্কার একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। ২০১১ সালে যখন বৈশ্বিক অংশীদারিত্বে নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য শিক্ষার কাজ শুরু করি তখন আপনার অংশগ্রহণে বিশেষভাবে সম্মানিত হয়েছিলাম।
ইরিনা বোকোভা বলেন, ভিন্ন ধরনের নেতৃত্বের কারনেই বাংলাদেশ ‘গ্লোবাল এডুকেশন ফার্স্ট ইনিশিয়েটিভ’র অন্যতম ‘চ্যাম্পিয়ন’ দেশ হয়। ইরিনা বোকোভা বলেন, ইউনেস্কো মনে করে টেকসই শান্তি ও স্বাধীনতা তখনই অর্জন করা সম্ভব হবে যখন নারী ও কন্যাশিশুর ক্ষমতায়ন হবে এবং পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে তারা অবদান রাখতে পারবে। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এই কাজটিই করছেন।
সম্মেলনের উদ্বোধীন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের এই সফলতা ধরে রাখতে প্রয়োজন জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতা। তিনি বলেন, আমরা চাই শিক্ষার্থীরা নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির আলোকে বেড়ে উঠবে। নিজেদের মেধা ও দক্ষতা দিয়ে বিশ্বজুড়ে তাদের সমসাময়িক প্রজন্মের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে এগিয়ে যাবে। তিনি বলেন, মেয়েদের জন্য বাংলাদেশে দ্বাদশ শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়েছে। ফলে মাধ্যমিক পর্যায় পর্যন্ত জেন্ডার সমতা নিশ্চিত হয়েছে। নারী শিক্ষায় সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ ২০১২ সালে ইউনেস্কো শিক্ষা পুরস্কার লাভ করেছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমি মনে করি, উপযুক্ত শিক্ষাই পারে একটি মেয়েকে সামাজিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে। যে কোনো ধরনের অন্যায় ও বৈষম্যমূলক আচরণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহসও শিক্ষাই দিতে পারে। আমরা সে কাজটিই করে যাচ্ছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতিসংঘের ২০১৫ পরবর্তী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে তার সরকার প্রণয়ন করেছে রূপকল্প-২০৪১। আর তা অর্জন করতে নারী ও শিশুদের সবসময়ই বিবেচনার অগ্রভাগে নেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ২০১৫ পরবর্তী উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আলোকে অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন ও প্রতিটি শিক্ষার্থীকে যোগ্য বিশ্ব নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে গৃহীত উদ্যোগটি নারী ও কন্যা শিশুদের স্বাক্ষরতা ও শিক্ষার সার্বজনীন প্রসারে মূল চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
প্রধানমন্ত্রী তার সরকারের সফলতা তুলে ধরে বলেন, সরকার শিক্ষার মানোন্নয়নে নতুন কারিকুলাম প্রণয়ন করেছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে জুনিয়র স্কুল, মাধ্যমিক স্কুল ও উচ্চমাধ্যমিকসহ সকল প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় শিক্ষার্থীদের আত্মবিশ্বাস বেড়েছে। এখন ৯২ শতাংশ পাশ করছে। এ হার ৯৮ ভাগে নিয়ে আসাই আমাদের লক্ষ্য। শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বের প্রতিটি শিশু বিশেষ করে কন্যাশিশুকে শিক্ষাদান আমাদের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। আজও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে মেয়েরা স্কুলে যেতে বিভিন্ন প্রতিকূলতার শিকার হয়। তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা এর অবসান চাই। এটাই হোক আজকের এই সম্মেলনে আমাদের দৃপ্ত শপথ।
 শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে এসেছে। এখন প্রতিটি শিশু স্কুলে যেতে পারছে। দরিদ্র পরিবারের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, স্নাতক পর্যায়ে নারী শিক্ষাকে উত্সাহিত করতে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেছি। এই ফান্ডে সরকার এক হাজার কোটি টাকা সীড মানি প্রদান করেছে। ইতিমধ্যেই এই ফান্ড থেকে স্নাতক ও সমপর্যায়ের ১ লক্ষ ২৯ হাজার ৮১০ জন ছাত্রীকে প্রায় ৭৩ কোটি টাকার উপবৃত্তি প্রদান করা হয়েছে। এতে নারীরা স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। ছাত্রদের তালিকাও করা হয়েছে। আগামীতে ছাত্রদেরও উপবৃত্তি দেয়া হবে। ঝরেপড়া রোধে স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে মিড-ডে মিল চালু করার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে সাক্ষরতার হার ছিল ৪৫ শতাংশ। সেটাকে ২০০১ সালে আমরা ৬৫ ভাগে নিয়ে যাই। কিন্তু পরবর্তীতে বিএনপি-জামায়াত সরকার সেই অর্জন ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়। ২০০৬ সালে সাক্ষরতার হার ৪৪ শতাংশে নেমে আসে। তবে পরবর্তীতে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ২০১১ সালের মধ্যেই বিদ্যালয়ে গমনোপযোগী শতভাগ শিশুর বিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করে। নারী কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সরকারের পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা মেয়েদের নতুন নতুন পেশায় যুক্ত হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছি। সব পেশায়ই মেয়েদের সংখ্যা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। বেকার নারীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। আত্মকর্মসংস্থানের লক্ষ্যে তাদেরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা সৃজনে জামানতবিহীন ঋণ দেয়া হচ্ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে নারীদের জন্য ৬০ শতাংশ কোটা বরাদ্দ রাখার বিষয়টিও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষার উপরও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। মেয়েদের জন্য ৬টি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শিক্ষায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তথ্য প্রযুক্তিকে শিক্ষার মাধ্যম হিসেব ব্যবহার করা হচ্ছে। মাধ্যমিক স্তরে আইটি শিক্ষা প্রসারের লক্ষ্যে আমরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম ও কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছি। ইউনিয়ন তথ্য সেবা কেন্দ্র চালু করেছি। এখান থেকে গ্রামের নারীরাও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি সেবা গ্রহণ করতে পারছে। উচ্চ শিক্ষা প্রসারে সরকারের উদ্যোগের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, উচ্চশিক্ষা প্রসারে আমরা পাঁচটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও ২৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছি। আরও ৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। দেশের প্রতিটি জেলায় সরকারি বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। মূলধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মাদ্রাসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।
অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, প্রথামিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমান,  অটিজম বিশেষজ্ঞ ও প্রধানমন্ত্র্রীর কন্যা সায়মা হোসেন পুতুল, কোরিয়ার রাষ্ট্রদূত লী ইয়াং-ইয়ং, চীনের চার্জ দ্যা এ্যাফেয়ার্স কিউ ইউ গাংঝু প্রমুখ বক্তব্য রাখেন। এ সময় মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ, সংসদ সদস্যবৃন্দ, কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ, বেসামরিক ও সামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ ছাড়াও বিশ্বের ৩৬ দেশের প্রতিনিধি সম্মেলনে অংশ নেন।
স্বাক্ষরতা ও শিক্ষা ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্র, স্পেন, দক্ষিণ আফ্রিকা, আলজেরিয়া, ইকুয়েডর ও বুর্কিনা ফাসোর ছয় জজনকে ‘ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার-২০১৪’ দেয়া হয়। বিশ্বব্যাপী শিক্ষা ও স্বাক্ষরতায় অসামান্য অবদানের জন্য এবার ৭ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করে ইউনেস্কো।
পুরস্কার প্রাপ্তরা হলেন, বুর্কিনা ফাসো’র অ্যাসোসিয়েশন ফর দি প্রমোশন অব নন-ফরমাল এডুকেশন এর প্রেসিডেন্ট অ্যানাটোলা টি. নিয়ামিওগো, ইকুয়েডরের শিক্ষামন্ত্রী অ্যাগাসটো এসপিনোসা, আলজেরিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অব অ্যাল-ফা-বে-টাই-জেশন এর প্রেসিডেন্ট আচিয়া বার্কি, স্পেইনের পারমানেন্ট এডুকেশন সেন্টার পলিগনো সার সেবিলি এর পরিচালক অ্যানা গার্চিয়া রেইনা, এ প্রতিষ্ঠানের উপ-পরিচালক ইসাবেল ডিলবার্ট, দক্ষিন আফ্রিকার মল্টটেনো ইনিস্টিটিউট ফর ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড লিটারেসি এন্ড ইন্টারন্যাশনাল লিটারেসি ইনিস্টিটিউট এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মাসেনিয়া ডিকোটলা, এ প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ড্যান এ. ওয়াগনার। প্রধানমন্ত্রী পুরস্কার প্রাপ্তদের হাতে সনদ, স্মারক ও পুরস্কারের অর্থ তুলে দেন। এ সময় প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে ছিলেন ইউনেস্কোর মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভা।

Developed by: