পাকিস্তানে পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষে রণক্ষেত্র পরিণত হয়েছে ইসলামাবাদ। সংঘর্ষে তিনজন নিহত ও পাঁচ শতাধিক আহত হয়েছেন। শনিবার রাতে সাবেক ক্রিকেটার ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক ই-ইনসাফ (পিটিআই) এবং তাহিরুল কাদরির পাকিস্তান আওয়ামী তেহরিক (পিএটি) প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাসভবন অভিমুখে মিছিল শুরু করলে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। পুলিশ শতাধিক বিক্ষোভকারীকে আটক করেছে। বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী তার সরকারি বাসভবন ছেড়ে লাহোরে নিজ বাড়িতে গিয়ে ওঠেন। গতকাল তিনি ফের সেই বাড়িতে ফিরে আসেন। এদিকে সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক সরকারকে সমর্থন দিবে বলে জানিয়েছে। বিক্ষোভে যখন ইসলামাবাদ রণক্ষেত্র তখন সেখানে সামান্য ভূমিকম্পও অনুভূত হয়। এদিকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে মিছিল করার সিদ্ধান্তে নিজ দলেই বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছেন ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে গত দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে বিক্ষোভ করছেন পিটিআই ও পিএটি। খবর ডন, দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, জিয়ো টিভি ও পিটিআই’র।দফায় দফার সংঘর্ষ
শনিবার রাতে হঠাত্ করেই ইমরান খান এবং তাহিরুল কাদরি পার্লামেন্টের বাইরে অবস্থান করা বিক্ষোভকারীদের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দেন। বিক্ষোভকারীরা মিছিল নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ বাধা দেয়। এতে পুলিশ এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। রাত দুইটার দিকে বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট কমপ্লেক্সের মধ্যে ঢুকে পড়ে। তারা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের কাছে পৌঁছে যায়। বিক্ষোভকারীরা প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের মূল গেট ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে পরিস্থিতি চরম আকার নেয়। তাদের আটকাতে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও রাবার বুলেট ব্যবহার করে। শনিবার রাতেই সংঘর্ষে নিহত হন এক বিক্ষোভকারী। রাতভর সংঘর্ষ চলে। তারা পার্লামেন্টের দরজাও ভেঙ্গে ফেলেন। ওই রাতেই বিক্ষোভ পুরো ইসলামাবাদ, লাহোর ও করাচি শহরে ছড়িয়ে পড়ে। করাচিতে মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের দিকেও বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে এগিয়ে গেলে পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে আটকায়।
শনিবার রাতের বিক্ষোভের পর গতকাল রবিবার আবারো সংগঠিত হয় বিক্ষোভকারীরা। প্রায় ২৫ হাজার বিক্ষোভকারী ফের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে রওনা হয়। এসময় পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে। বিক্ষোভকারীরাও পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছোঁড়ে। বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। বিক্ষোভের সময় সাংবাদিকদের ওপরও হামলার ঘটনা ঘটে। দেশটির বেসরকারি সংবাদ মাধ্যম জিও অফিসেও হামলা চালায় বিক্ষোভকারীরা। ইসলামাবাদ পুলিশ প্রধান খালিদ খাত্তাক বলেছেন, বিক্ষোভকারীরা মিছিল সহকারে শরিফের সরকারি বাসভবনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ সময় প্রায় ১শ’ বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়। তিনি বলেন, বিক্ষোভকারীদের অনেকের কাছে কুড়াল, হাতুড়িসহ দেশীয় অস্ত্র ছিল এবং আমি নিশ্চিত তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্রও ছিল। তবে আমরা তা দেখিনি। ইসলামাবাদের পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব মেডিক্যাল সাইন্স হাসপাতালের (পিমস) মুখপাত্র ড. ওয়াসিম খাজা বলেন, সংঘর্ষের সময় হূদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিক্ষোভকারী নাভিদ রাজ্জাক মারা গেছেন। তিনি কাদরির দলের সমর্থক। পিমস’র ডাক্তার আয়েশা ইসানি জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে দুইজন হাসপাতালে মারা গেছেন। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে যে সংখ্যক মৃত্যুর কথা প্রচার করা হচ্ছে তার বিরোধিতা করেন আয়েশা।
বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়ার সময় ইমরান খান গ্যাস প্রতিরোধী মুখোশ পরেন। ইমরান খান সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বলেন, আজকের রাতের জন্য সবাই প্রস্তুত হও। গতকাল রাতে আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। তিনি বলেন, তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির হুমকি দেয়া হচ্ছে। সেটা যদি হয় তাহলে পুরো পাকিস্তান অচল করে দেয়া হবে। তিনি বিক্ষোভ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন। এর আগে শুক্রবার অচলাবস্থা নিরসনে সেনাপ্রধান জেনারেল রাহিল শরিফ মধ্যস্থতার জন্য বিক্ষোভরত দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করেন। কার্যত সে আলোচনা ব্যর্থ হয়।
গণতন্ত্রকে সমর্থন সেনাবাহিনীর
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ইন্টার সার্ভিস জনসংযোগ দফতরের (আইএসপিআর) এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দেশের রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবেই সমাধান করতে হবে এবং যতো দ্রুত সম্ভব সেটা করতে হবে। সেনাবাহিনী গণতন্ত্রকে সমর্থন দিয়ে যাবে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়। সেনা সদর দফতরে অনুষ্ঠিত সেনাপ্রধান রাহিল শরিফের সঙ্গে সেনাবাহিনীর কমান্ডারদের এক বৈঠকের পর বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। চার ঘন্টা ধরে চলা বৈঠকে বর্তমান সংকটে কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগের বিষয়টিকে নাকচ করেন কমান্ডারগণ। তবে কমান্ডারগণ বর্তমান পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এই বৈঠকটি আজ সোমবার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও পরিস্থিতি খারাপ দিকে যাওয়ার কারণে গতকাল সন্ধ্যায় অনুষ্ঠিত হয়।
পিটিআইতে বিভক্তি
পিটিআই প্রেসিডেন্ট জাভেদ হাশমিকে বহিষ্কার করেছেন দলটির চেয়ারম্যান ইমরান খান। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে বিক্ষোভের বিরোধিতা করে জাভেদ বলেছিলেন, দলের বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন অভিমুখে মিছিল করার কোনো সিদ্ধান্ত না হলেও ইমরান কোন্ বার্তা পেয়ে নিজ থেকেই এই সিদ্ধান্ত নেন। তার এই বক্তব্যের পর দলটির তথ্য সচিব শিরিন মাজারি জানান, দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতার সিদ্ধান্তেই ইমরান খান প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের দিকে মিছিল নিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। পিটিআই নেতারা জানিয়েছেন, প্রথমে আমরা এই সিদ্ধান্তে রাজি ছিলাম না। পরে পিএটি আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করা হয়। ইমরান খান হাশমির বক্তব্যের বিষয়ে বলেন, আজ থেকে আমাদের দুজনের পথ ভিন্ন। তিনি হাশমির উদ্দেশ্যে বলেন, আমি কারো সিগন্যালের ওপর নির্ভর করি না। তাই যদি করতাম তাহলে গত ১৭ দিন বসে থাকতাম না।
সরকারি বাসভবনে ফিরলেন নওয়াজ
বিক্ষোভকারীদের ভয়ে নওয়াজ শুক্রবার ইসলামাবাদে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন ছেড়ে লাহোরের নিজ বাসভবনে যান। ব্যক্তিগত কর্মকর্তারাও তার সঙ্গে যান। নওয়াজের ভাই পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী শাহবাজ শরিফও সেখানে বাস করেন। লাহোরেও নিরাপত্তা জোরদার করে পুলিশ। আন্দোলনকারীদের না সরানো পর্যন্ত ইসলামাবাদে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে ফিরবেন না বলে জানা গিয়েছিল। তবে গতকাল তিনি আবার বাসভবনে ওঠেন। গতকাল নওয়াজ শরিফ দলের এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেন। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে পার্লামেন্টে হামলার তীব্র নিন্দা জানানো হয় এবং আগামীকাল পার্লামেন্টের যৌথ অধিবেশন ডাকার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

