
সিডনি, ০৫ সেপ্টেম্বর- মক্কেলকে কাঁদাতে চান না কেউই। তবে এখানে মক্কেলের কান্না দেখেই ডাক্তাররা বুঝতে পারেন, কত ভালোভাবে কাজটি করতে পেরেছেন। আশায় আশায় থাকেন, রোগীকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় কখন চোখের পানি ঝরবে। জলেই যে আনন্দ ডাক্তারদের! তবে যেসব রোগীকে সুস্থ করতে পারেন না, সেগুলোকে মৃত ঘোষণা দিয়ে একটি বাক্সে রেখে দেন। সে বাক্সের নাম ‘পুতুলের গোরস্থান’। যেখানে-সেখানে কেনা প্লাস্টিকের পুতুল ঠিকঠাক করে দেওয়ার জন্য অনেক হাসপাতালই দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল। তার মাত্র কটিই টিকে আছে। তাদের মধ্যে সিডনির পুতুলের হাসপাতাল দেখতে দেখতে পার করে দিল ১০০ বছর। পারিবারিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটি হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের ভাঙাচোরা পুতুলকে নতুন করে দেওয়ার ভরসাস্থল। খেটে চলেছেন জনা ১২ ডাক্তার-কর্মী। তাঁদের প্রধান জেফ চ্যাপম্যান। ৬৭ বছরের মানুষটিই হাসপাতালের সর্বেসর্বা, প্রধান সার্জন। তাঁর বাবার তৈরি হাসপাতাল চালাচ্ছেন। কর্মীদের অনেকে আসেন দূর-দূরান্ত থেকে। অনেকে পড়ে আছেন বছরের পর বছর। তাঁদেরই একজন কেরি স্টুয়ার্ট। সিকি শতাব্দী ধরে এ ডাক্তারের রোগী সারাতে সারাতে পেকে গেছে মাথার চুল। তার পরও মাঝেমধ্যে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সবচেয়ে বিরক্ত লাগে সেলুলয়েডের পুতুল। একেবারে দুবলা, নাড়াচাড়া করাই ঝামেলা। কাঁচামালও খুব পাতলা, টিস্যুর মতো সিনথেটিক প্লাস্টিক। বলতে বলতে মেজাজ চড়ে গেল- ‘সেলুলয়েডের পুতুল ঠিকঠাক করা খুব ঝামেলা। অনেক সময় নেয়। একেকটা পুতুল নিয়ে তিনবারও কাজ করতে হয়েছে। তার পরই কেবল হয়েছে মনেরই মতো।’
হাসপাতালের জন্মও খুব মজার। জেফ চ্যাপম্যানের চাচা হ্যারল্ড চ্যাপম্যানের একটি সাধারণ মুদি দোকান ছিল। একবার জাপান থেকে সেলুলয়েডের পুতুলের একটি চালান আনলেন। তবে আসতে আসতেই ভেঙেচুরে একাকার। ভাইয়ের নির্দেশে সেগুলো ধরে ধরে ঠিক করলেন চ্যাপম্যান। পুতুল সারাই করতে করতেই মাথায় এলো সারাইকেন্দ্র খোলার। খুলেও ফেললেন ‘ডলস হসপিটাল’। দুঁদে ব্যবসায়ী ছিলেন চ্যাপম্যান। দেখতে দেখতে জনপ্রিয় হয়ে উঠল হাসপাতালটা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তো রমরমা সময় পেরিয়েছে। যুদ্ধের ফলে বাইরে খেলা নিষিদ্ধ ছেলেমেয়েদের। ঘরে বসে পুতুল খেলা ছাড়া অন্য বিনোদন নেই। মা-বাবাও খুব উৎসাহ দেন। যাতে বাইরে বেরোতে না হয়। আমদানি নিষেধাজ্ঞায় নতুন পুতুল আসা বন্ধ। পুরনো ছেঁড়াফাড়া পুতুলই ভরসা। তাই ছেলেমেয়েদের সন্তুষ্ট করতে দলে দলে মা-বাবা ভাঙাচোরা পুতুল সারাইয়ের জন্য লাইন দিয়েছিলেন। জেফের বাবার বিষয়বুদ্ধি ছিল প্রখর। স্মৃতি হাতড়ে ছেলে বললেন, ‘বাবারও মনে হয়েছিল যুদ্ধের বছরগুলোই ব্যবসা করার সবচেয়ে ভালো সুযোগ। হাসপাতালেরও সবচেয়ে সুসময় কেটেছে। রোগীর ভিড় সামলাতে ছিলেন ডাক্তার-কর্মী মিলিয়ে ৭০, ছয় ছয়টি রুম।’
মাসে গড়ে শ-দুয়েক পুতুল আর খেলনাকে সুস্থ করে। নিয়মিত পুতুল সারাইয়ের কর্মশালা করে। বলতে বলতে মজার তথ্য দিলেন হাসপাতালের প্রধান সার্জন জেফ- ‘৮০ শতাংশ কাজই আনেন বুড়ো খোকাখুকুরা।’ মাঝবয়সী পুরুষ, বুড়ো হয়ে যাওয়া কোনো নারী রোগী নিয়ে আসেন। নাতি-নাতনিদের খেলতে দেবেন বলে ছেলেবেলার পুতুল বের করেছিলেন বা বুড়োকালে ছেলেবেলার স্মৃতি হাতড়াতে খুঁজে বের করেছেন শখের পুতুল। খেলার সাথিকে দেখেই মন ভেঙে যায়। তখন তো এমন শয়ে শয়ে সুপার মার্কেট ছিল না বলে কিনতেও পারতেন না। একটি পুতুল দিয়েই ছেলেবেলা পার করেছেন অনেকে। প্রিয় পুতুলকে বাঁচাতে হাসপাতালে ছোটেন। নাজুক রোগীর সার্জারিও খুব মনোযোগের সঙ্গে করতে হয় চ্যাপম্যানের দলকে- ‘আমাদের কাছে তেমন রোগীই আসে, যার অবস্থা খুব খারাপ। এমন রোগী কমই পাই, যে সামান্যতেই সেরে যায়।’
কম নয়, হাসপাতালের জন্ম থেকে কমপক্ষে ৩০ লাখ পুতুল, টেডি বিয়ার, কাঠের ওপর চলমান ঘোড়া, খেলনা গাড়ির ওপর সফল অপারেশন চালিয়েছেন সার্জনরা। সুস্থ অবস্থায় সেগুলোকে নিয়ে হাসতে হাসতে ফিরে গেছেন অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের হাজারও মানুষ। একবার এক মানুষ সমান লম্বা-চওড়া ভাঁড়কেও অপারেশন চালিয়েছেন চ্যাপম্যান। তাঁর কাঁচির নিচে ভদ্রভাবে শুয়ে পড়তে হয়েছে ঠিক ১২ ফুট লম্বা ভয়ংকর কুমিরকেও।
হ্যাঁ, ঠিক ভেবেছেন, মেয়েরাই বেশি আসেন পুতুল নিয়ে। তবে চ্যাপম্যান জানালেন, টেডি বিয়ার নিয়ে বয়স্ক পুরুষরাও আসেন। ফের বললেন, ‘আমরা এমনো মানুষ দেখেছি, যার চোখের জল পড়ছে তো পড়ছেই। পুতুল বের করে অঝোরে কাঁদছেন। তবে রিলিজ ডেটে অবাক হয়ে গেছেন- প্রিয় পুতুল টেডিকে দেখাচ্ছে ঠিক নতুনের মতো।’
এত্ত এত্ত রোগীর বেশির ভাগেরই সমস্যা চোখ আর চুলে। সত্যি হাসপাতালের মতো রিলিজ ডেট দেয় পুতুলের হাসপাতাল। বিশেষজ্ঞ সার্জন কখন সময় দিতে পারবেন ও কত সময় লাগবে তার ওপর নির্ভর করে ডেট দেওয়া হয়। যদি পা, পায়ের পাতা বা আঙুলে সমস্যা থাকে, তাহলে গেইল গ্রেইনঞ্জার ছাড়া উপায় নেই। এসব বিষয়ে তিনি এক্সপার্ট। এ ছাড়া রোগীদের ঠিকঠাক করতে যেসব জিনিসপত্র ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর বেশির ভাগই সত্যিকারের সার্জনদের। পার্থক্য একটাই- অন্য হাসপাতালের মতো বিশাল কোনো জায়গায় বিরাট সাইনবোর্ড নেই পুতুলের হাসপাতালের। দক্ষিণ সিডনির ব্যস্ত পাড়া বেক্সলিতে পুতুলের দোকানের পেছনে আছে। ভেতরে সদাব্যস্ত ডাক্তার। কেউ হাত জোড়া লাগাচ্ছেন, কেউ পায়ের আঙুল বা মাথা। কেউ কোটর খুলে বের করে চোখের অবস্থা দেখছেন। তাঁদের রোগীরা যে নানাভাবে আহত। শিশুদের রাগের ফলাফল বা অতি উৎসাহী কুকুরের আক্রমণে বা ভাইবোনের কাড়াকাড়িতে শরীরটা হয়েছে জখম।