একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের বিরুদ্ধে পাঁচটি অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তাকে ফাঁসির দণ্ডাদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১২টায় জনাকীর্ণ আদালতে আসামির উপস্থিতিতে ট্রাইব্যুনাল-১-এর চেয়ারম্যান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রায় দেয়। এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পঞ্চদশ রায়।
১৫৮ পৃষ্ঠার রায়ের সার-সংক্ষেপ পড়ে শোনান বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন ও বিচারপতি আনোয়ারুল হক।
আজহারুলের বিরুদ্ধে আনিত ছয়টি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হয়েছে। শুধু ১ নম্বর অভিযোগটি প্রমাণিত হয়নি। ২, ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে তাকে পৃথকভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। এছাড়া ৫ নম্বর অভিযোগের জন্য ২৫ বছরের ও ৬ নম্বর অভিযোগের জন্য পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
এর আগে সকাল নয়টার দিকে আজহারকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে আনা হয়। এরপর ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায় রাখা হয় তাকে। পরে সেখান থেকে তাকে ট্রাইব্যুনালে আসামির কাঠগড়ায় নেওয়া হয়।
গত বছরের ১২ নভেম্বর যুদ্ধাপরাধের ছয় ঘটনায় অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে আজহারের বিচার শুরু হয়। এর আগে ২০১২ সালের ১৫ এপ্রিল এটিএম আজহারের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু হয়। ওই বছর ২২ অগাস্ট মগবাজারের বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয় তাকে। তদন্ত শেষে গত বছরের ১৮ জুলাই আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে রাষ্ট্রপক্ষ। এরপর নভেম্বরে অভিযোগ গঠনের পর ২৬ ডিসেম্বর শুরু হয় সাক্ষ্যগ্রহণ।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) এম ইদ্রিস আলীসহ রাষ্ট্রপক্ষে ১৯ জন সাক্ষ্য দেন। তবে সপ্তম সাক্ষী আমিনুল ইসলামকে বৈরি ঘোষণা করা হয়। এছাড়া আজহারের যুদ্ধাপরাধের একজন ‘ভিকটিম’ ১৪ নম্বর সাক্ষী হিসাবে ক্যামেরা ট্রায়ালে জবানবন্দি দেন। চলতি বছর ৩ ও ৪ আগস্ট আজহারের পক্ষে একমাত্র সাফাই সাক্ষী হিসেবে জবানবন্দি দেন আনোয়ারুল হক। এরপর দুইপক্ষ দীর্ঘ সময়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালে।
আজহারের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগে বলা হয়, ১৯৭১ সালে আজহার রংপুরের কারমাইকেল কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র এবং জামায়াতে ইসলামীর তখনকার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রসংঘের রংপুর শাখার সভাপতি ছিলেন। জেলার আলবদর বাহিনীরও নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।
ছয় অভিযোগ:
মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত ৯ ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধে ৬টি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হয়। প্রথম অভিযোগ হলো, ২৪ মার্চ থেকে ৩ এপ্রিলের মধ্যে দূর্গাদাস অধিকারী এবং অন্য সাত জনকে অপহরণ, আটক ও নির্যাতনের পর হত্যা।
দ্বিতীয় অভিযোগ হলো, ১৬ এপ্রিল তার নিজ এলাকা রংপুরের বদরগঞ্জ থানার ধাপপাড়ায় ১৫ জন নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালিকে গুলি করে হত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ। এ ঘটনায় পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে আজহার অংশ নেন।
তৃতীয় অভিযোগ হলো, ১৭ এপ্রিল রংপুরের বদরগঞ্জের ঝাড়ুয়ারবিল এলাকায় এক হাজার ২শ’রও বেশি নিরীহ লোক ধরে নিয়ে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করা হয়, যাদের মধ্যে ৩৬৫ জনের পরিচয় পাওয়া গেছে।
চতুর্থ অভিযোগ হলো, ৩০ এপ্রিল রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক কালাচান রায়, সুনীল বরণ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ অধিকারী, চিত্তরঞ্জন রায় ও কালাচান রায়ের স্ত্রী মঞ্জুশ্রী রায়কে বাসা থেকে অপহরণের পর দমদমা সেতুর কাছে নিয়ে হত্যা করা হয়।
পঞ্চম অভিযোগ হলো, ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে রংপুর শহর ও বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মহিলাদের ধরে এনে টাউন হলে আটকে রেখে ধর্ষণসহ শারীরিক নির্যাতন চালানো হয়। এসব ঘটনার সঙ্গে আজহার জড়িত ছিলেন।
ষষ্ঠ অভিযোগ হলো, নভেম্বরের মাঝামাঝি রংপুর শহরের গুপ্তপাড়ায় একজনকে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়। ১ ডিসেম্বর রংপুর শহরের বেতপট্টি থেকে আজহারের নেতৃত্বে একজনকে অপহরণ করে রংপুর কলেজের মুসলিম ছাত্রাবাসে নিয়ে আটক রেখে শারীরিক নির্যাতন ও গুরুতর জখম করা হয়।