একটি জিহাদের কথা

Untitled-1 copyআজকের শিশু আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আজকের শিশুরাই একদিন শিক্ষা-দিক্ষা নিয়ে বড় হয়ে এদেশের নেতৃত্ব দিবে, অন্যায় অপরাধের বিরুদ্ধে হয়ে উঠবে প্রতিবাদি কন্ঠস্বর। সততার ঝান্ডা হাতে নিয়ে এগিয়ে যাবে, জিহাদ ঘোষনা করবে অপশক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু জিহাদিদের মধ্যে কোন জিহাদ নিজেই যখন অকালে ঝড়ে যায় তখন মুখ থুবরে পরে সকল আশা- আকাঙ্খা। বলছিলাম তেমনই একটি নিস্পাপ জিহাদের কথা । তারিখটি ছিল ২৬ ডিসেম্বর শুক্রবার বেলা তিন-সারে তিনটার কথা। চার বছরের ফুটফুটে শিশু জিহাদ খেলা করছিল বন্ধুদের সাথে একটি পরিত্যক্ত পানির পাম্পের (নলকুপের) পাশে, যেটির গভীরতা ছিল পায় ৬০০ ফুট এবং সেটির মুখ ছিল খোলা। খেলা করতে করতে অসাবধানতার কারণে শিশু জিহাদ হঠাৎ করে পরে যায় নলকুপের ভিতর। জিহাদের বন্ধুদের চিৎকারে ছুটে আসে তার বাবা-মা সহ প্রতিবেশিরা। মুহুর্তের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে পুরো এলাকায়। এ খবর দ্রুত ছড়িয়ে পরলে গন মাধ্যমের কর্মিরাসহ ঘটনাস্থলে ছুটে আসে ফায়ার সার্ভিস ও অন্যান্য উদ্ধার কর্মিরা। সেদিন আমার কর্মস্থলের ছুটি থাকায় আমি বেড়াতে বের হয়ে যাই। রাতে বাসায় ফিরে টেলিভিশন চ্যানেলে (সরাসরি) প্রচার দেখি এই ঘটনা। আমি ব্যকুল হয়ে উঠি শিশু জিহাদকে উদ্ধার কাজে নিজেকে যুক্ত হওয়ার জন্য। মাত্র ৫ মিনিটে কোন রকম সেরে নেই রাতের খাবার। টর্চ লাইটটি হাতে নিয়ে বাসা থেকে বের সোজা উপস্থিত হই শিশু জিহাদকে গ্রাস করা শাজাহানপুরের নলকুপ রুপী সেই রাক্ষসী মৃত্যুকুপের কাছে। হাজার হাজার মানুষের ভিড় সামাল দিতে বেগ পেতে হয় আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। সিসি ক্যামেরার সরঞ্জাম নিয়ে কিছুক্ষনের মধ্যে সেখানে উপস্থিত একটি বেসরকারী সংস্থা। তাদের কিছুটা সহযোগিতা করার সুবাদে আমি পৌছে যাই মৃত্যুকুপো কাছে। আমার কর্মস্থলে স্যোশাল অডিটের জন্য কিছুদিন পূর্বে আমাদের সবাইকে জভডভা ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স থেকে অগিন নির্বাপন ও উদ্ধার কাজের জন্য দুই দিনব্যপি প্রশিক্ষন দেওয়া হয়। সেই প্রশিক্ষনের অর্জন আর নিজের মনোবল নিয়ে প্রায় দেড় ঘন্টা সেখানে অবস্থান করি শিশু জিহাদকে উদ্ধার কাজে নিয়োজিত থাকার জন্য। কিন্তু ফায়ার সার্ভিসের উর্দ্ধতন কর্মকর্তার বাধার কারনে সরে যেতে হয় আমিসহ রানা প্লাজায় উদ্ধার কাজে সহযোগিতাকারী বশির আহমেদ এবং আরো কিছু স্বেচ্ছাসেবককে। রানা প্লাজার উদ্ধার কর্মি বশির আহমেদ স্বেচ্ছায় গর্তে নামার জন্য ফায়ার সার্ভিসের উদ্যেশ্যে বার বার একটি সেফটি বেল্ট ও কিছু দড়ি চেয়েও তা না পেয়ে হতাশ হয়ে ষেখান থেকে সরে যান। তরিপর শুরু হয় ফায়ার সার্ভিস , বুয়েটের পারদর্শি ব্যাক্তিদের উদ্ধার তৎপরতা। ঘন্টর পর ঘন্টা বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করেও তারা ব্যর্থ হয় শিশু জিহাদকে সনাক্ত করতে। এরই মধ্যে উপস্থিত হন রেল মন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ। এক পর্যায়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এই গর্তের ভিতর কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই বলে ঘোষনা দিয়ে চলে যান। তারপর আমি ছুটে যাই মিডিয়া কর্মিদের সাথে জিহাদের বাসায়। সেখানে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শি এবং জিহাদের আত্মীয়-স্বজনের সাথে কথা বলে জানা যায় শিশু জিহাদ এই গর্তের ভিরেই আছে। সংবাদ কর্মিরা জিহাদের বাবার কথা জানতে চাইলে খবর পাওয়া যায় জিহাদের বাবাকে জবানবন্দি নেওয়ার জন্য পুলিশ নিয়ে গেছে। জিজ্ঞাসাবাদের সময় জিহাদের বাবা এবং জিহাদের মামার উপর পুলিশের আক্রমনাত্মক আচরনের অভিযোগ উঠে। এভাবে রাতভর চলতে থাকে জিহাদকে উদ্ধার কার্য্যক্রম। আমি জিহাদকে দেখার জন্য রাতটি কাটিয়ে দেই ঘটনাস্থলে। কিন্তু আমার কর্মস্থলের পিছুটানের কারণে ভোর পাঁচটায় মনের বিরুদ্ধে ফিরে আসি বাসায়। আসার সময় দেখলাম স্থানীয় লোকজন লোহার রড দিয়ে খাচার মতো একটি বস্তু তৈরী করছে জিহাদকে উদ্ধার করার কাজে ব্যবহার করার জন্য। বাসায় এসেও আমার মন পরে থাকে শাজাহানপুরে। তাই আবার কিছুক্ষনের জন্য টিভি সেটের সামনে বসে থেকে ঘোমাতে যাই। চোখ বন্ধ করেও আমার কাছে মনে হচ্ছে জিহাদ আকুতি জানাচ্ছে তাকে বাঁচাতে। এক দেড় ঘন্টা পর ঘোম থেকে উঠে চলি যাই কর্মস্থলে। সারা রাতের বিবরন পেশ করি সহকর্মিদের সাথে। এমন একটি ঘটনার খুব কাছ থেকে আসার পর কাজে মন বসছিলনা। অফিসের টিভির দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে থাকি জিহাদের উদ্ধারের খবরটি জানার জন্য। বেলা আড়াইটার দিকে টিভির স্ক্রিনে দেখি বেসরকারী উদ্যেগে গর্তে পাঠানো ক্যমেরায় ধারন করা চিত্র, যেখানে ভোর রাতেই আলামত পাচ্ছিল জিহাদের কিন্তু সরকারী উদ্ধারকারীরা বলেছিল সেখানে কোন শিশুর/ মানুষের অস্তিত্ব নেই। আর কথার সুত্র ধরে মিডিয়া কর্মিরা ছুটে যায় জিহাদের বাসায় মুল বিষয়টি জানার জন্য। অবশেষে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান সমাপ্তি ঘোষনার কিছুক্ষন পরেই সমস্ত ভিত্তিহীন কথা-বার্তার অবসান ঘটিয়ে বেলা তিনটার দিকে স্থানীয় বাসিন্দারা সেই লোহার যন্ত্রটির সাহায্যে উদ্ধার করতে সক্ষম হয় শিশু জিহাদকে উদ্ধার করতে। উদ্বেগ আর উৎকন্ঠা কাটিয়ে স্বস্তি ফিরে আসে অপেক্ষামান হাজার হাজার মানুষের মাঝে। সারা এলাকাজুড়ে বইতে থাকে আনন্দের বন্যা। জাহিদেকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিক্যল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তারদের পর্যবেক্ষনের পর যে খবরটি সৃষ্টি হয় সে খবরটির সাথে সৃষ্টি হয় জিহাদকে উদ্ধারের পর বয়ে যাওয়া আনন্দের বন্যায় প্রচন্ড খরা। আর সেই খরতাপে পুড়তে থাকে জিহাদের মা, বাবা, আত্মীয়-স্বজনসহ এলাকাবাসি ও দুর দুরান্ত থেকে আসা প্রতিটি মানুষের অন্তর। আমার ডিউটি শেষ করে রাতে রওয়ানা হই জিহাদের বাসার উদ্যেশ্যে। জিহাদদের বাসার কাছে খিলগাঁও বাজারের পাশের মাঠে আয়োজন করা হয়েছিল ওয়াজ মাহ্ফিলের । এই ঘটনায় শুক্রবার সেটি স্থগিত রাখা হয়েছিল এবং শনিবার আবার শুরু করা হয়। আমি সে মাঠের ভিতর দিয়ে যাওয়ার সময় ওয়াজ মাহ্ফিলের আয়োজকদের একজনের সাথে জিহাদের জন্য দোয়া করার জন্য অনুরোধ করলে আমার অনুরোধটি তারা গ্রহন করে এবং ওয়াজ মাহ্ফিল শেষে জিহাদের জন্য দোয়া প্রার্থনা করবে বলে আমাকে আস্বস্ত করে। রাত নয়টা দিকে উপস্থিত হলাম জিহাদের বাসায়। সেখানে গিয়ে দেখলাম বেশ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি জিহাদের মায়ের সাথে কথা বলছে, তাকে সান্তনা দেওয়ার চেষ্টা করছে। যার নাড়ি ছিড়া বুকের মানিক মায়ের আঁচল ছেড়ে চিরদিনের জন্য এই জগতের সমস্ত মায়ার বাধন ছিন্ন করে চলে গেল সে মাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষাও কেউ খুজে পাচ্ছেনা। সেখানে তখন আরো অপেক্ষায় থাকে একটি টেলিভিশন চ্যনেলের সংবাদ কর্মি জিহাদের মায়ের সাথে কথা বলার জন্য। রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ চলে যাওয়ার পর সংবাদ কর্মিরা দারস্ত হয় হতভাগি মায়ের। সন্তান হারিয়ে প্রায় নির্বাক / অসুস্থ্য মায়ের কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছিল। তাই সংবাদ কর্মিরা অল্প সময়ের মধ্যে চলে যান জিহাদের বাসা থেকে। আমি আরো কিছুক্ষন অবস্থান করার পরও রাতে জিহাদের লাশ নিয়ে আসার কোন সম্ভাবনা না দেখে চলে যাই আমার বাসায়। পরের দিন (রবিবার) বাসা থেকে বের হয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় খুজে পাই পুলিশী অত্যাচারের সত্যতা ধন্যবাদ জানাই সংবাদ মাধ্যমকে। প্রায় ২৪ ঘন্টার নাটকীয়তার পর আমরা পুরস্কার পেলাম দেশের একটি ভবিষ্যতের লাশ। কি অপরাধ ছিল জিহাদের। সারা রাত উদ্ধার নাটক করে ফায়ার সার্ভিসের বাহিনীরা তাদের কার্যক্রম সমাপ্তি ঘোষনার সাধারন মানুষ উদ্ধার করে আনতে হলো শিশু জিহাদকে। তাহলে সরকারি উদ্ধারকারি বাহিনীর ভূমিকা কি? মায়ের বুক খালি করে ফুটফুটে শিশু জিহাদ লাশে পরিনত হলো, এ মৃত্যুর দায়ভার কে নিবে? কে থামাবে বাবার আহাজারি, মায়ের বিলাপ, ভাই-বোনের কান্না আর আত্মীয়-স্বজনেরহাহাকার? আমাদের হয়তো আর কিছুই করার নেই, শুধু মহান সৃষ্টি কর্তার কাছে প্রার্থনা করি শিশু জিহাদ যেন জান্নাতের বাসিন্দা হয়। পরিবারের প্রতিটি সদস্যের মাঝে শোকের পরিবর্তে শক্তি ফিরে আসুক।

Developed by: