রাশিদা বেগম। একজন উদীয়মান লেখিকা। লিখে যাচ্ছেন নীরবে নিভৃতে।
তিনি ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর বরিশাল জেলার গৌরনদী উপজেলার নাঠৈ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মো. হাতেম আলী, মাতা মরহুমা চাঁদ বানু।
রাশিদা বেগম সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার রাগীব নগর গ্রামে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।
তিনি জান্নাতুল ফেরদাউস, রাহাদুল ইসলাম রুহান, ফাতেমা ফেরদাউস হিরা সন্তানত্রয়ের জননী।
চাকরীজীবী কবি রাশিদা বেগম সীমাহীন ব্যস্ততার অবসরে কাগজ-কলম নিয়ে বসেন এবং লিখেন ছড়া-কবিতা-প্রবন্ধ ইত্যাদি। সৃজনশীলতার জোয়ারে তিনি সর্বদা ভাসমান। ‘সোনালি স্বপ্নের ডানা’ গ্রন্থটি তাঁর প্রথম প্রকাশনা।
তিনি সহজ, সরল, স্পষ্টবাদী সর্বোপরি একজন কোমলমতী সম্ভাবনাময়ী নারী।
তাঁর লেখায় দেশপ্রেম, ভাষাপ্রেম, রোমান্টিকতা প্রভৃতির উপস্থিতি ল্যণীয়। সচেতন পাঠকের নিকট ‘সোনালি স্বপ্নের ডানা’ গ্রন্থটি সমাদৃত হবে।
সোনালি স্বপ্নের ডানা; কবি রাশিদার স্বপ্ন শিল্পের রঙধনু
শিউল মনজুর
এক.
কবিতা কি? এই প্রশ্নের উত্তরে কবিতার যেমন নির্দিষ্ট কোন সংজ্ঞা নেই তেমনি কবিতা লেখারও নির্দিষ্ট কোন পদ্ধতি বা কৌশল নেই। তবে কবিতা লেখার দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা যে রীতি আমরা প্রত্য করি তা হচ্ছে ছন্দরীতি। যদিও গত কয়েক দশক ধরে কাব্যচর্চায়রত কবিদের নিকট এই আদি বা প্রাচীন ধারাটি অনেকটাই উপেতি। তারপরেও কেউ কেউ এই প্রাচীনরীতি অনুসরণ করে কাব্য সাধনায় ব্রত রয়েছেন এবং সুন্দর সুন্দর কবিতা রচনা করে পাঠক হৃদয়ে রস আস্বাদন করে চলেছেন। আমাদের সাহিত্য অঙ্গনের অতি পরিচিত মুখ কবি রাশিদা বেগম। তিনি এই ছন্দরীতি অনুসরণ করে দীর্ঘদিন ধরে নীরবে কাব্য চর্চা করছেন এবং নিরবেই কবিতার মধ্যদিয়ে পাঠক হৃদয়ে নিজস্ব একটি স্থান দখল করে নিতে সম হয়েছেন। আর এই গ্রন্থটি কবি রাশিদার স্বপ্ন শিল্পের রঙধনু।
দুই.
ছন্দরীতির স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের ঢঙে লেখা ৪১টি ছড়া কবিতার পান্ডুলিপি সোনালি স্বপ্নের ডানা গত ২০১৫ সালের একুশে গ্রন্থমেলায় প্রকাশিত হয়েছে। সোনালি স্বপ্নের ডানা কবি রাশিদা বেগমের প্রথম ছড়া কবিতার বই। ৪৮ পৃষ্টা বা তিন ফর্মার এই বইটি কবি উৎসর্গ করেছেন নিজের মা-বাবাকে এবং বইটির বাজার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৮০ টাকা। সিলেটের প্রতিষ্ঠিত প্রকাশনী বাসিয়া থেকে প্রকাশিত, ঝকঝকে মুদ্রিত ও সুভাষচন্দ্র নাথের আকর্ষণীয় প্রচ্ছদের কল্যাণে প্রথম দর্শনেই বইটি হাতে তুলে নেবার জন্য মনোযোগ আকর্ষণ করে। শুধু তাই নয়, হাতে নেবার পর একের পর এক পৃষ্ঠা অতিক্রম করে ভেতরে যেতে যেতে মনে হবে এই বইটির শব্দ চয়নে ও পঙক্তিমালা সৃষ্টিতে যেন একজন দ কারিগরের ছোঁয়া রয়েছে। ভাবনায় রয়েছে পরিশীলিত একজন নান্দনিক মনের অধিকারী মানুষের উচ্চারণ। বইটির অরে অরে উজ্জ্বল হয়ে প্রস্ফুটিত হয়েছে স্বদেশ, সমাজ ও মানব সম্প্রদায়কে ভালোবাসার সৌন্দর্যবোধ। অর্থ্যাৎ এই বোধ ভালোলাগার, এই বোধ প্রণোদনার, সর্বোপরি এই বোধ সার্বজনীন এবং কল্যাণের বার্তাবাহক।
তিন.
সোনালি স্বপ্নের ডানা গ্রন্থে যে ৪১টি ছড়া-কবিতা রয়েছে সেগুলিকে কয়েকটি পর্বে যেমন; স্বদেশ পর্ব, দানবীর রাগীব আলী পর্ব, প্রকৃতি পর্ব, প্রেম পর্ব, শিশু ও মা পর্ব এবং ব্যক্তি ও সমাজ পর্বে বিভক্ত করা যেতে পারে।
চার.
স্বদেশ বা নিজ মাতৃভূমির প্রতি মানুষের ভালোবাসা অথবা আবেগ অনুভুতি চিরন্তন। এই চিরন্তন ভালোবাসায় মানুষ যেমন দেশের জন্য প্রাণ বিসর্জন দেয় সেখানে কবিরাও যুগে যুগে দেশের জন্যে আত্মত্যাগ করেছেন, এমন নজীর রয়েছে একাধিক। আমাদের এই বাংলাদেশের জন্যও কবি সাহিত্যিকরা ভাষা আন্দোলন, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধসহ দেশ রার বিভিন্ন আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। এমন কি একাত্তরের যুদ্ধে অনেকে প্রাণও দিয়েছেন। আমাদের আলোচ্য গ্রন্থের রচয়িতা দেশ মাত্তৃকার প্রতি একনিষ্ট ভালোবাসায় নিবেদিত। তাঁর বেশ কিছু ছড়া-কবিতায় দেশের প্রতি যে অকৃত্রিম ভালোবাসা ও আবেগ নিহিত রয়েছে তার বর্হিপ্রকাশ ঘটেছে। স্বদেশকে নিয়ে তাঁর লেখা দুটি ছড়া-কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপন করা হলো;
১। ভূবন ঘুরে দুচোখ মেলে
দেখছি একটি দেশ
সে যে আমার স্বúেœ ঘেরা
সোনার বাংলাদেশ।
…………………
মুক্ত আকাশ মুক্ত বাতাস
স্বাধীন একটি দেশ
সে যে আমার সোনার বাংলা
স্বাধীন বাংলাদেশ। (কবিতার শিরোনাম; স্বাধীন বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৭)
২। বীর ছিল রফিক সালাম
মনে পড়ে সেই কথা
একুশ তো নয় শোকের স্মৃতি
স্বজন হারানো ব্যথা।
পিচডালা পথে রক্তের ধারা
করুণ স্মৃতির রেশ
ধরণীতে বুঝি একটাই আছে
ভাষা শহিদের দেশ। (কবিতার শিরোনাম; ভাষা শহিদের দেশ, পৃষ্ঠা-১৩)
সুখ ও দুঃখ নিয়ে কবির এমন মুগ্ধ উচ্চারণ আমাদেরকেও দেশ প্রেমে উজ্জ্বীবিত করে। শুধু তাই নয় ছন্দে পঙক্তিতে নতুন প্রজন্মকে দেশের আকাশ বাতাস মাটি এবং আমাদের মাতৃভাষার প্রতি যে দায়বদ্ধতা রয়েছে সে পাঠের মন্ত্রণাও তিনি দেন।
পাঁচ
প্রকৃতির প্রতি কবিদের অনুরাগের মাত্রা স্বদেশের প্রতি ভালোবাসার মতই। সবুজের মায়াবি পাহাড়-বন, নদ-নদীর প্রবাহিত জীবন চিত্র, ঋতু বৈচিত্র্যের নানা রঙ যে কোন বয়সের যে কোন সময়ের কবি মনকে আকর্ষণ করে নানা মাত্রায় নানা ভাবনায়। সোনালি স্বপ্নের ডানা গ্রন্থের রচয়িতা কবি রাশিদা বেগমকেও এই স্বদেশের ঋতু বৈচিত্র্য ও নানা রঙের প্রকৃতি আকর্ষণ করে, তাঁকে কবিতা লিখতে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃতি প্রেমে আসক্ত হয়ে কবি রাশিদা বসন্ত, এখন লাগে ভালো, বাসিয়া, ছয়টি ঋতু, বাসিয়া নদীর তীরে প্রভৃতি শিরোনামের কবিতা লিখেছেন যা এই গ্রন্থের মাধ্যমে আমাদেরকে তিনি উপহার দিয়েছেন। প্রকৃতি বিষয়ক দুটি কবিতার অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপন করা হলো;
১। বাসিয়া নদীর তীরেতীরে
বাইও মাঝি ধীরে ধীরে
দেখবে সেথায় সারি সারি
নদীর পারে তারই বাড়ি
সবুজ গাছে ঘেরা
ইট পাথরে গড়া
সেই কুঠিরে বসত করে
শ্যাম মনচোরা। (কবিতার শিরোনাম; বাসিয়া নদীর তীরে, পৃষ্ঠা-২১)
২। শীত সকালে লেপ মুড়িয়ে
খেজুর গুড় আর মুড়ি নিয়ে
খেতে যদি বলো,
তখন লাগে ভালো।
বসন্তেরই সকাল বেলা
ছেলেরা সব করে খেলা
মাঠে মাঠে বসে মেলা
এমন যখন হলো
তখন লাগে ভালো। (কবিতার শিরোনাম: এখন লাগে ভালো, পৃষ্ঠা-২৯)
প্রকৃতি বিষয়ক কবিতার এরকম নান্দনিক উচ্চারণে কবিকে প্রকৃতির প্রেমিক হিসেবে সহজেই শনাক্ত করা যায়। বাসিয়ার অমিয় জল, বসন্তের পাতাঝরা মৃদু মিষ্টি হাওয়া কবিকে প্রকৃতির গভীরে নিয়ে যায়। তাইতো তিনি এতো সুন্দরভাবে প্রকৃতির কবিতা রচনা করতে পেরেছেন।
ছয়.
দানবীর রাগীব আলী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম রূপকার। এছাড়া এদেশের সামাজিক উন্নয়নেও রয়েছে তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান। যা চিরস্বরণযোগ্য। সিলেট পেরিয়ে দেশের আনাচে কানাচে তিনি প্রতিদিন স্বাস্থ্য, ক্রীড়া, শিা ও শিল্প সাহিত্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। কৃতিত্বপূর্ণ কাজের জন্য ধনী গরিব সকলের নিকটই তিনি সমান জনপ্রিয় একজন মানুষ। তিনি তুলনাহীন বা অতূলনীয় ব্যক্তিত্ব। তাই শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি জগতের মানুষেরা তাঁকে গল্পে কবিতায় নাটকে প্রবন্ধে নানাভাবে মূল্যায়ন করে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই বরেণ্যব্যক্তিকে নিয়ে শতাধিক গ্রন্থও রচিত হয়েছে। তাঁকে নিয়ে গবেষণা করছে বিভিন্ন খ্যাতি সম্পন্ন শিা প্রতিষ্ঠান। আলোচ্য গ্রন্থেও কবি রাশিদা তাঁর পঙক্তির ছন্দ মাধুর্যের দোলাচালে এই মহান ব্যক্তিকে স্মরণীয় করে রাখার চেষ্টা করেছেন। তাঁকে নিয়ে লেখা দুটি ছড়া-কবিতার চুম্বক অংশ বিশেষ এখানে উপস্থাপন করা হলো;
১। রাগীব আলীর ব্রেনটা নিয়ে
ভাবতে যদি থাকি
নিশ্চয় অনেক কিছু
রয়ে যাবে বাকী,
তাঁর গড়া সৃষ্টি নিয়ে
ভাবতে যদি যাই
টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া।
সীমা নাহি পাই। (কবিতার শিরোনাম; তুলনাহীন, পৃষ্ঠা-৪৫)
২। হে সৃষ্টির বীর
চিরদিন থাকো বেঁচে
এ ধরার মাঝে
উন্নত করে শির।
হে সৃষ্টির বীর
বারবার এ বাংলার বুকে
ফোটাও সুখের ফুল
গরিবের মুখে। (কবিতার শিরোনাম; সৃষ্টির বীর, পৃষ্ঠা-৩৮)
দানবীর রাগীব আলীকে নিবেদন করে তাঁর এসব ছড়া-কবিতাগুলো অসম্ভব সুন্দর। দানবীর রাগীব আলীর সুযোগ্য স্ত্রী মহিয়সী রাবেয়া খাতুনকে নিয়েও তিনি রচনা করেছেন সুন্দর পঙক্তিমালার ছড়া-কবিতা। যা পাঠক হৃদয়ে মধুর সুর ছড়িয়ে দেয়।
সাত.
সোনালি স্বপ্নের ডানা গ্রন্থে শিশু ও মাকে নিয়েও স্মরণযোগ্য ছড়া-কবিতা লেখা হয়েছে। ব্যক্তি ও সামাজিক কবিতাগুলোও মূল্যায়নের দাবী রাখে। খুকু মণি, হুলো ক্যাট, ময়না প্রভৃতি শিশু উপযোগী ছড়াগুলো শিশুদের মনে আনন্দ দেবে বলে মনে করি। আবার রূপায়ন, কবির মেলা, মুসাফির প্রভৃতি সামাজিক ছড়া-কবিতাগুলো আমাদেরকে অন্যরকম ভাবনায় ধাবিত করে।
আট.
কবি রাশিদা সহজ সরল এবং প্রতিনিয়ত আমরা যে শব্দ ব্যবহার করি সেগুলির সমন্বয়েই ছড়া-কবিতাগুলো তিনি নির্মাণ করেছেন। তবে তাঁর কিছু কিছু ছড়া কবিতায় তাল লয়ের ঘাটতি রয়েছে বলে মনে হয়। আবার কিছু কবিতায় সমকালীন কবিদের কবিতার সুর বা প্রভাবও রয়েছে। কাব্য সাধনার ভেতর দিয়ে এসব ঘাটতি ও প্রভাব মুক্ত হবেন কবি রাশিদা বেগম তা আমরা প্রত্যাশা করি। তবে একথা অনস্বীকার্য যে, প্রথম কবিতার বইতে তিনি যে অসংখ্য সুন্দর ও সাবলীল কাব্যসৃষ্টি করেছেন, যা তাঁকে পাঠক হৃদয়ে দীর্ঘদিন বাঁচিয়ে রাখবে। আমাদের ছড়া-কবিতার সাহিত্য ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। এই ধারার জনপ্রিয় কবিদের তালিকা অত্যন্ত দীর্ঘ। মধূসুদন. রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, সুকুমার, সুকান্ত প্রমূখ বিখ্যাত কবিদের থেকে শুরু করে কালিদাস, কামিনী, সত্যন্দ্রনাথ, বন্দে আলী মিয়া, অমিয় চক্রবর্তী, বুদ্ধদেব বসু, আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, আলমাহমুদ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, নির্মলেন্দু গুণ, জয় গোস্বামীসহ এই সময়ের অসংখ্য কবি স্মরণযোগ্য ছড়া কবিতা লিখে পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন। সোনালি স্বপ্নের ডানায় ভর করে কবি রাশিদা বেগম তাঁর পরবর্তী গ্রন্থে আরো চমকপ্রদ খ্যাতিমান কবিদের মতো ছড়া-কবিতা উপহার দিয়ে পাঠক হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নেবেন। আমরা সে আশাই করি। আরো আশা করি তাঁর অন্তর দৃষ্টি স্বদেশের সীমা পেরিয়ে পৌঁছে যাবে বিশ্ব বারান্দায়। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখব কবি রাশিদা বেগমের অনন্য কাব্য কীর্তি।