বিশ্বনাথে যুক্তরাজ্য প্রবাসীর ২য় স্ত্রী সুজিনা বেগম হত্যাকান্ডে রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ। হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে ঘাতক গয়াছ কে গ্রেফতারের পর তার স্বীকারোক্তিতে সজলু নামের আরো ১ ঘাতককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। গ্রেফতারকৃত গয়াছ শনিবার সিলেট জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট জেরিন আক্তারের আদালতে কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে।
জবানবন্দিতে ঘাতক গয়াছ জানিয়েছে, যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুরাদ আহমদের ১ম স্ত্রী সাবিনা বেগমের পরিকল্পনায় ৬ লক্ষ টাকার চুক্তিতে প্রবাসীর ২য় স্ত্রী সুজিনা বেগমকে হত্যা করা হয়েছে।
সুজিনার পরিচয় : বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর (পশ্চিমপাড়া খালপাড়) গ্রামের মৃত হাজী আব্দুর রউফের সৎ মেয়ে ও জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসি (সাতহাল) গ্রামের যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুরাদ আহমদের ২য় স্ত্রী সুজিনা বেগম (১৯)। প্রায় সাড়ে ৩মাস পূর্বে মুরাদের সাথে বিয়ে হয় সুজিনার। বিয়ের পর থেকে সুজিনা তার মায়ের সাথে পিত্রালয়ে বসবাস করে আসছিলেন।
যেভাবে হত্যা করা হয় সুজিনাকে : ১৯ জুলাই রবিবার সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজের পরপরই অতিথি পরিচয়ে হাতে বনফুলের মিষ্টির বক্স নিয়ে সুজিনার পিতার বাড়িতে আসে অজ্ঞাতনামা ৪ ঘাতক। ঘাতকরা দরজায় নক করলে সুজিনার মা তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা জানায় সুজিনার স্বামী মুরাদের পূর্ব পরিচিত। এরপর তাদেরকে বসতে দেওয়া হয় এবং তাদের জন্য সুজিনা ও তার মা রেজিয়া বেগম লাচ্ছি তৈরী করেন। কিন্ত আপ্যায়নের পূর্বেই ঘাতকরা ঝাপটে ধরে সুজিনাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে থাকে। এসময় সুজিনার মা এগিয়ে এলে তাকেও আঘাত করে ঘাতকরা। এক পর্যায়ে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত সুজিনা ও তার মা মাটিতে লুটিয়ে পড়লে ঘাতকরা পালিয়ে যায়। এসময় সুজিনার একমাত্র ছোট ভাই জহির উদ্দিন (১২) ঘর থেকে বের হয়ে চিৎকার শুরু করলে আশপাশ বাড়ির লোকজন ছুটে আসেন এবং সুজিনা ও তার মাকে গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে প্রেরণ করেন। কিন্ত হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই সুজিনার মৃত্যু হয়। ময়নাতদন্ত শেষে সোমবার রাতে সুজিনার মামার বাড়ি উপজেলার বাহাড়া দুভাগ গ্রামে তার দাফন সম্পন্ন হয়।
স্বীকারোক্তিতে যা বললো ঘাতক গয়াছ : গ্রেফতারের পর শনিবার সিলেট জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট জেরিন আক্তারের আদালতে হাজির করা হয় ঘাতক গয়াছ মিয়াকে। কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে গয়াছ বলে, ৬লক্ষ টাকা চুক্তির বিনিময়ে হত্যা করা হয়েছে সুজিনাকে। প্রবাসী মুরাদের ১ম স্ত্রী যুক্তরাজ্য প্রবাসী সাবিনা বেগম তার সৎ ভাই জুনাব আলীর মাধ্যমে গয়াছসহ অন্য ৫জনের সাথে হত্যার এই চুক্তি করা হয়। সাবিনার সৎ ভাই জুনাব আলী, চাচাতো ভাই আওলাদ, গ্রেফতারকৃত গয়াছ ও সজলু সহ আরো অজ্ঞাতনামা ৩জন এই হত্যাকান্ডে সরাসরি জড়িত ছিলো। ১৯ জুলাই সন্ধ্যায় একটি মিষ্টির বক্স হাতে নিয়ে সুজিনার বাড়িতে যায় ঘাতকরা। ওই সময় জুনাব আলী ও আরো অজ্ঞাতনামা ২জন বাড়ির বাইরে অবস্থান করে এবং আওলাদ, গয়াছ, সজলু ও অন্য অজ্ঞাতনামা আরো একজন সুজিনার ঘরে অতিথি পরিচয়ে প্রবেশ করে। স্বীকারোক্তিতে গয়াছ জানায়, সুজিনাকে ধারালো ছুরি ও চাকু দিয়ে কুপাতে থাকে আওলাদ, সজলু ও অন্য আরেকজন এবং সুজিনার মা রেজিয়া বেগমের পেটে ছুরি দিয়ে কুপ দেয় সে (গয়াছ) নিজে। এরপর তারা পালিয়ে যায়। গয়াছ জানায়, ৬লক্ষ টাকার চুক্তির মধ্যে তার (গয়াছের) সাথে ২০ হাজার টাকার চুক্তি হয়। এর মধ্যে ঘটনার পূর্বে তাৎক্ষণিক তাকে ২হাজার টাকা প্রদান করে সাবিনার ভাই ঘাতক জুনাব আলী।
ঘাতকদের পরিচয় : স্বীকারুক্তিতে ঘাতক গয়াছ জানায়, হত্যার ঘটনায় সে (গয়াছ) সহ মোট ৭জন ঘাতক সরাসরি জড়িত ছিলো। ঘাতকরা হলো- জগন্নাথপুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সুন্দর আলীর ছেলে ও যুক্তরাজ্য প্রবাসী মুরাদ আহমদের ১ম স্ত্রী ছাবিনা বেগমের সৎ ভাই কুখ্যাত ডাকাত জুনাব আলী, ছাবিনার চাচাতো ভাই একাধিক ডাকাতি ও হত্যা মামলার সাঁজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামী আওলাদ আলী, জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী গ্রামের মৃত জহির উল্লার পুত্র গয়াছ মিয়া, একই উপজেলার জহিরপুর গ্রামের মৃত মন্টু রাজা চৌধুরীর পুত্র কুখ্যাত ডাকাত সজলু রাজা চৌধুরী। এছাড়া আরো অজ্ঞাতনামা ৩ ঘাতক হত্যায় জড়িত রয়েছে বলে আদালতে স্বীকারোক্তিতে গয়াছ জানায়।
কে এই সাবিনা : জগন্নাথপুর উপজেলার আব্দুল্লাহপুর গ্রামের সুন্দর আলীর মেয়ে যুক্তরাজ্য প্রবাসী ছাবিনা বেগম। প্রায় ১৪ বছর পূর্বে পার্শ্ববর্তি শ্রীরামসি সাতহাল গ্রামের মুরাদ হোসেনের সাথে বিয়ে হয় সাবিনার। বিয়ের পর তাদের পরিবারের জন্ম নেয় একে একে ৩টি সন্তান। বিয়ের প্রায় ৫বছর পর থেকে সাবিনা-মুরাদের মধ্যে সৃষ্টি হয় মনোমালিন্য। একপর্যায়ে পৃথক বসবাস শুরু করেন সাবিনা ও মুরাদ। কয়েক বছর ধরে এই বিরোধ আরো জটিল হয়ে পড়ে। এরপর প্রায় সাড়ে ৩মাস পূর্বে দেশে এসে সুজিনাকে বিয়ে করেন মুরাদ। আর এই বিয়েটাকে কিছুতেই মেনে নিতে পারেন নি মুরাদের প্রথম স্ত্রী সাবিনা। মুরাদ বিয়ে করে লন্ডন চলে যাবার পর দেশে আসেন সাবিনাও। এসময় মুরাদ-সুজিনার বিয়ে ভেঙ্গে দিতে মুরাদের পরিবারকে চাপ সৃষ্টি করেন সাবিনা। কিন্ত এই চাপের কাছে কিছুতেই রাজি হননি মুরাদের পরিবার। এরপর প্রায় ১মাস দেশে অবস্থান করে লন্ডন চলে যান সাবিনা। থানা পুলিশ ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা যায়, সাবিনার ৪ ভাইয়ের মধ্যে আপন ভাই সাজ্জাদ হোসেন (২৮) ও শাহাজান মিয়া (৩৩), সৎ ভাই শুকুর আলী (৫৫) ও জুনাব আলী (৫২)। জুনাব আলী এলাকার চিহিৃত একজন ডাকাত। তার বিরুদ্ধে একাধিক ডাকাতি মামলা রয়েছে। এছাড়া শাহজাহানকে তার মা নিজেই নেশাদ্রব্য সেবনের অভিযোগে জেলহাজতে প্রেরণ করেন। সে বর্তমানে জেলহাজতে আটক রয়েছে।
মামলা দায়ের : সুজিনাকে হত্যার ঘটনায় তার মামা ক্বারী আব্দুন নূর বাদি হয়ে গতকাল মঙ্গলবার সুজিনার সতিন সাবিনা বেগম, তার মা ও ২ভাই এর নাম উল্লেখ করে ও আরো ৪/৫ জন অজ্ঞাতনামা আসামী করে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলা নং ১৪।
যেভাবে গ্রেফতার করা হয় ঘাতক গয়াছ ও সজলুকে : ঘটনার পর থেকে হত্যার রহস্য উদঘাটন ও জড়িতদের গ্রেফতারে হর্ন্য হয়ে খুঁজতে থাকে পুলিশ। গত বৃহস্পতিবার দিবাগত ভোর রাতে গোপন সংবাদের জগন্নাথপুর উপজেলার শ্রীরামসী গ্রামের মৃত জহির উল্লার পুত্র গয়াছ মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর গত শুক্রবার দিবাগত রাতে গ্রেফতারকৃত গয়াছকে সাথে নিয়ে অভিযানে নামে পুলিশ। বিশ্বনাথ থানার ওসি রফিকুল হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশের ৪৮ ঘন্টার রুদ্ধদ্বার সফল অভিযানে শনিবার ভোর ৪টায় জগন্নাথপুর উপজেলার জহিরপুর গ্রামে অভিযান চালিয়ে ঘাতক সজলু রাজা কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয় পুলিশ। গতকাল গ্রেফতারকৃত গয়াছকে সিলেট জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে হাজির করা হলে সে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করে।
যেভাবে সনাক্ত করা হয় ঘাতক গয়াছ কে : শুক্রবার ভোর রাতে ঘাতক গয়াছ মিয়াকে গ্রেফতার করে থানায় নিয়ে আসে পুলিশ। এসময় নিহত সুজিনার ছোট ভাই জহির উদ্দিন (১২) কে হাজির করা হয় গ্রেফতারকৃত গয়াছের সামনে। ঘাতকদের এক হিসেবে গয়াছকে তখন সনাক্ত করে জহির। এরপর নিশ্চিত হওয়ার জন্য সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুজিনার মায়ের সামনে হাজির করা হয় ঘাতক গয়াছ কে। এসময় সুজিনার মা রেজিয়া বেগম গয়াছকে দেখে চিৎকার শুরু করেন। তিনি হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতে থাকেন এবং পুলিশকে বুঝাতে চেষ্টা করেন ঘাতক গয়াছই তার (রেজিয়া) পেটে ছুরি বসিয়েছিল।
গয়াছ ও সজলু গ্রেফতারে এলাকায় স্বস্তি : কুখ্যাত ডাকাত একাধিক হত্যা মামলার আসামী গয়াছ মিয়া ও সজলু রাজা গ্রেফতার হওয়ায় এলাকায় স্বস্তি ফিরে এসেছে। শনিবার জগন্নাথপুর এলাকা থেকে এই প্রতিবেদককে একাধিক ব্যক্তি ফোন করে জানান, এলাকায় ঘন ঘন ডাকাতি সংঘঠিত হয়েছে। অনেক প্রবাসী এই ডাকাতদের ভয়ে দেশে আসা থেকে বিরত রয়েছেন। দেশে থাকা প্রবাসীদের স্বজনেরাও রয়েছেন আতংকে। গয়াছ ও সজলু গ্রেফতার হওয়ায় তাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে বলে তারা জানান।