মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে রাজাকার ফোরকান মল্লিকের মৃত্যুদণ্ড

3d9ac8d7ecb0173163e133312360f9f1একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পটুয়াখালীতে হত্যা-ধর্ষণের মত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে তখনকার রাজাকার সদস্য ফোরকান মল্লিকের সর্বোচ্চ সাজার রায় এসেছে।

যুদ্ধাপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বৃহস্পতিবার এই রায় ঘোষণা করেন।

রায়ে বলা হয়, আসামির বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের আনা পাঁচটি অভিযোগের মধ্যে তিনটি সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে।

ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি শাহীনুর ইসলামও এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

একাত্তরে ফোরকান ছিলেন মুসলিম লীগের একজন সক্রিয় কর্মী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলে তিনি পাকিস্তানি বাহিনীর সমর্থনে গড়ে তোলা সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন এবং মির্জাগঞ্জ থানার কাকড়াবুনিয়া, দেউলী, সুবিদখালী, কলাগাছিয়াসহ বিভিন্ন গ্রামে যুদ্ধাপরাধ ঘটান বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উঠে এসেছে।

ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশনের তথ্য অনুযায়ী, পটুয়াখালীর মির্জাগঞ্জ থানার ছইলাবুনিয়া গ্রামের সাদের মল্লিক ও সোনভান বিবির ছেলে ফোরকান মল্লিক (৬৪) পড়ালেখা করেছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত। মূলত কৃষিজীবী হলেও ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তিনি।

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে স্বাধীনতাবিরোধীরা আবার রাজনীতিতে পুনর্বাসিত হতে শুরু করলে ১৯৭৭ সালে ফোরকানও স্থানীয় পর্যায়ে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।

এ পর্যন্ত রায় আসা ২০টি মামলার ২২ আসামির মধ্যে ফোরকান হলেন পঞ্চদশ ব্যক্তি, যুদ্ধাপরাধের দায়ে যার সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হল।

মামলার পূর্বাপর
একাত্তর সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগে ২০০৯ সালে ২১ জুলাই ফোরকানের বিরুদ্ধে মির্জাগঞ্জ থানায় মামলা করেন আবদুল হামিদ নামে এক ব্যক্তি। পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে পটুয়াখালীর আদালতে তার বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হয়।

প্রাথমিক তদন্তে ফোরকানের যুদ্ধাপরাধের প্রমাণ পাওয়ার পর মামলাটি পটুয়াখালী থেকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। অভিযোগের তদন্ত শুরু করেন প্রসিকিউশনের তদন্ত র্কমর্কতা সত্যরঞ্জণ রায়।

এরপর পটুয়াখালীর গোয়েন্দা পুলিশ ২০১৪ সালের ২৫ জুন ফোরকানকে বরিশালের রুপাতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে গ্রেপ্তার করে। ৩ জুলাই ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাকে করাগারে পাঠানো হয়।

এরপর ২ ডিসেম্বর ফোরকান মল্লিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নেয় ট্রাইব্যুনাল-২। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আটজনকে হত্যা ও গণহত্যা, ৪ জনকে ধর্ষণ, ৩ জনকে ধর্মান্তরে বাধ্য করা, ১৩টি পরিবারকে দেশান্তরে বাধ্য করা, ৬৪টি বসতবাড়ি ও দোকানে লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের মোট পাঁচটি ঘটনায় অভিযুক্ত করে গত বছর ১৮ ডিসেম্বর ফোরকানের বিচার শুরু হয়।

প্রসিকিউশনের প্রারম্ভিক বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ১৯ জানুয়ারি সাক্ষ্যগ্রহণ শুরুর পর তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৪ জন ফোরকানের বিরুদ্ধে জবানবন্দি দেন। অন্যদিকে ফোরকান মল্লিকের পক্ষে সাফাই সাক্ষ্য দেন চারজন।

সাক্ষ্য শেষে আসামিপক্ষে আব্দুস সালাম খান ও প্রসিকিউশনের পক্ষে মোখলেসুর রহমান বাদল আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন। বিচারিক কার্যক্রম শেষে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ গত ১৪ জুন মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে।

বিংশতম রায়
বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১০ সালের ২৫ মার্চ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধের বহু প্রতীক্ষিত বিচার শুরু হয়। ২০১৩ সালের ২১ জানুয়ারি প্রথম রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রুকন আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। পলাতক থাকায় তিনি আপিলের সুযোগ পাননি।

৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় রায়ে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়, যা প্রত্যাখ্যান করে রাজধানীর শাহবাগে অবস্থান নেয় হাজার হাজার মানুষ।

যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে সেই আন্দোলন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়লে জনতার দাবির মুখে সরকার ট্রাইব্যুনাল আইনে সংশোধন আনে। এর মধ্যে দিয়ে রায়ের বিরুদ্ধে দুই পক্ষেরই আপিলের সমান সুযোগ তৈরি হয়। ২০১৩ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে কাদের মোল্লাকে প্রাণদণ্ড দেয়, যা কার্যকর করা হয় ১২ ডিসেম্বর।

ট্রাইব্যুনালের তৃতীয় রায়ে ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি জামায়াতের নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির আদেশ হয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে সাঈদী আপিল করলে গত বছর ১৭ সেপ্টেম্বর ‘দেইল্যা রাজাকার’ নামে খ্যাত এই জামায়াত নেতার সাজা কমিয়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডের আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

২০১৩ সালের ৯ মে ট্রাইব্যুনালের চতুর্থ রায়ে জামায়াতের আরেক সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামানকেও মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। গতবছর ৩ নভেম্বর আপিলের রায়েও তার সর্বোচ্চ সাজা বহাল থাকে। তাকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয় ১১ এপ্রিল।

মানবতাবিরোধী অপরাধের ষড়যন্ত্র, পরিকল্পনা ও উসকানির দায়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন জামায়াত আমীর গোলাম আযমকে ২০১৩ সালের ১৫ জুন ৯০ বছরের কারাদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। এটি ছিল ট্রাইব্যুনালের পঞ্চম রায়। তার আপিলের শুনানি চলার মধ্যেই গতবছর ২৩ অক্টোবর রাতে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ৯২ বছর বয়সী জামায়াতগুরু।

২০১৩ সালের ১৭ জুলাই ষষ্ঠ রায়ে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদকে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ বছর ১৬ জুন আপিলের রায়েও সেই সাজা বহাল থাকে।

২০১৩ সালের ১ অক্টোবর সপ্তম রায়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও চট্টগ্রামের সাংসদ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ফাঁসির রায় আসে। তার আপিলের রায় হবে আগামী ২৯ জুলাই।

ট্রাইব্যুনালে বিএনপির সাবেক মন্ত্রী আবদুল আলীমের আমৃত্যু কারাদণ্ডের রায় হয় ২০১৩ সালের ৯ অক্টোবর। যুদ্ধাপরাধের দণ্ড ভোগের মধ্যে ৮৩ বছর বয়সে গতবছর ৩০ অগাস্ট মারা যান আলীম। যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর ১১ মাস কারাবন্দি অবস্থায় হাসপাতালের প্রিজন সেলে ছিলেন তিনি।

বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে একাত্তরের দুই বদর নেতা আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মুঈনুদ্দীনকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেয় ট্রাইব্যুনাল। তারা দুজনেই পলাতক।

দশম রায় আসে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর। জামায়াত আমির একাত্তরের বদর প্রধান মতিউর রহমান নিজামীকেও দেওয়া হয় সর্বোচ্চ সাজা, যিনি বাঙালি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করতে ‘স্বেচ্ছায় ও সচেতনভাবে’ ইসলামের অপব্যবহার করেন বলে রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়। তিনিও এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন।

একাদশ রায়ে গতবছর ২ নভেম্বর চট্টগ্রামের আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলীকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়। জামায়াতে ইসলামীর এই শুরা সদস্যকে দলটির প্রধান অর্থ যোগানদাতা বলা হয়ে থাকে।

এরপর ১৩ নভেম্বর ফরিদপুরের রাজাকার কমান্ডার পলাতক জাহিদ হোসেন খোকন ওরফে খোকন রাজাকারের ফাঁসির আদেশ আসে। ২৪ নভেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রাজাকার কমান্ডার ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা মোবারক হোসেনকে আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়।

এরশাদ আমলের প্রতিমন্ত্রী ও একাত্তরে হবিগঞ্জের মুসলিম লীগ নেতা সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হয় গতবছর ২৩ ডিসেম্বর। এরপর ৩০ ডিসেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজহারুল ইসলামের ফাঁসির রায় আসে।

চলতি বছরের প্রথম রায়ে জামায়াতের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুস সুবহানকেও একই সাজা দেওয়া হয়। ট্রাইব্যুনালের সপ্তদশ রায়ে গত ২৩ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পার্টির সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান পলাতক আবদুল জব্বারকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয় আদালত।

আর গত ২০ মে চাঁপাইনবাবগঞ্জের মাহিদুর রহমান ও আফসার হোসেন চুটুকেও আমৃত্যু কারাদণ্ড দেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ৯ জুন কিশোরগঞ্জের রাজাকার পলাতক সৈয়দ মো. হাসান আলীকে ফাঁসি অথবা ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার নির্দেশ দেয় ট্রাইব্যুনাল।

Developed by: