খুলনায় নির্মম কায়দায় ১২ বছরের শিশুকে হত্যা

004খুলনায় নির্মম নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করা হয়েছে ১২ বছরের একটি শিশুকে।

সোমবার রাতে নগরীর টুটপাড়া এলাকায় একটি মোটর গ্যারেজে মলদ্বারে পাইপের মাধ্যমে হাওয়া ঢুকিয়ে মো. রাকিব নামে ওই শিশুকে হত্যা করা হয় বলে পুলিশ জানিয়েছে।

হত্যাকাণ্ডের পরপরই স্থানীয়রা গ্যারেজ মালিক মিন্টু মিয়া (৪০) ও কর্মচারী শরীফ (৩৫) এবং তার মা বিউটি বেগমকে (৫৫) পিটিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে।

রাকিব টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের মো. আলমের ছেলে। সে টুটপাড়া কবরস্থানের কাছে মিন্টু মিয়ার মোটর সাইকেল গ্যারেজ ‘রোজ ব্যাটারিতে’ কাজ করত।

কিছু দিন আগে সে ওই গ্যারেজ ছেড়ে পিটিআই মোড়ের আরেকটি গ্যারেজে কাজ নিয়েছিল বলে স্থানীয়রা জানায়।

খুলনা সদর থানার ওসি সুকুমার বিশ্বাস সাংবাদিকদের বলেন, কাজ ছেড়ে দেওয়ায় রাকিবের উপর ক্ষুব্ধ ছিল মিন্টু মিয়া।

“রাতে মিন্টুর গ্যারেজের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় রাকিবকে ডেকে নেয় সে। একপর্যায়ে শিশুটিকে বিবস্ত্র করে তার মলদ্বারে টায়ারে হাওয়া দেওয়ার পাইপ ঢুকিয়ে দেয়। এতে রাকিবের পেটসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে ফেঁপে ওঠে।”
তখন রাকিব অসুস্থ হয়ে পড়লে মিন্টু ও তার কর্মচারী শরীফ পেটে চাপ দিয়ে বাতাস বের করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। এরপর তারা শিশুটিকে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করায় বলে পুলিশ জানায়।

সেখানে অবস্থার অবনতি হলে রাকিবকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখান থেকে ঢাকায় নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর পরপরই রাকিব মারা যায়।

চিকিৎসকদের বরাত দিয়ে ওসি সুকুমার বলেন, “রাকিবের শরীরের অস্বাভাবিক পরিমাণ হাওয়া প্রবেশ করানোর কারণে তার পেটের নাড়িভুড়ি ছিড়ে যায়, ফুসফুস ফেটে যায়। এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ অকেজো হয়ে গেলে সে মারা যায়।”

রাকিবের লাশ ময়না তদন্তের জন্য খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। মঙ্গলবার তার ময়নাতদন্ত করা হবে।

গণপিটুনির শিকার মিন্টু মিয়া ও শরীফকে পুলিশ পাহারায় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

নির্যাতনের সময় বিউটি বেগম উপস্থিত থাকলেও তিনি শিশুটিকে বাঁচাতে এগিয়ে যাননি বলে জানান খুলনা সদর থানার ওসি।

ছেলে হারানো লাকি বেগমের কান্না থামছে না

‘মামা আর দিয়েন না, মরে যাব’

মৃত্যু যন্ত্রণায় রাকিব ছটফট করলেও তা নির্যাতনকারীদের স্পর্শ করেনি বলে জানিয়েছে এই শিশুর এক বন্ধু, যে চিৎকার শুনে সেখানে গিয়েছিল।

সোমবার রাতে খুলনা নগরীর টুটপাড়া কবরস্থানের কাছে মিন্টু মিয়ার মোটর গ্যারেজের সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল আকিব (ছদ্মনাম)। রাকিবের চিৎকার শুনে সেখানে যায় সে।

এই শিশুটি মঙ্গলবার এ প্রতিবেদককে জানায়, “মেশিন দিয়ে যখন রাকিবের পেটের ভেতরে বাতাস ঢুকাচ্ছিল, তখন সে শুধু বলছিল- ‘মামা আর দিয়েন না, আমি মরে যাব’।”

খান জাহান আলী সড়কের ওই গ্যারেজে এক সময় কাজ করত ১২ বছরের রাকিব, মালিক মিন্টু মিয়াকে ডাকত মামা। কিন্তু নির্যাতন চালানো হত বলে সেই কাজ ছেড়ে পিটিআই মোড়ে অন্য একটি গ্যারেজে কাজ নেয় সে।

সেই কারণে মিন্টু মিয়া ক্ষুব্ধ হয় এবং সেই কারণেই তার উপর নির্মম নির্যাতন চলে বলে রাকিবের পরিবারের অভিযোগ। আর এই নির্যাতনই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয় শিশুটিকে।

নির্যাতনের পর রাকিবকে প্রথমে নেওয়া হয় কাছের একটি ক্লিনিকে, সেখান থেকে পাঠানো হয় খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখান থেকে ঢাকায় নিতে অ্যাম্বুলেন্সে উঠানোর সঙ্গে সঙ্গে তার ‍মৃত্যু হয়।

হাসপাতালেও রাকিবের মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফটের কথা ভুলতে পারছেন না তার মা লাকি বেগম।

“রাকিব আমাকে বলে, মা আমি আর বাঁচব না, যন্ত্রণায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। ও মা আমাকে তুমি বাঁচাও মা।”

টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের বাসায় সন্তান হারানো লাকির এই আর্তনাদ ছুঁয়ে যায় উপস্থিত সবাইকে। চোখের জল ধরে রাখতে না পেরে প্রতিবেশীদের অনেকেই বেরিয়ে আসেন।

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের যে চিকিৎসক রাকিবকে দেখেছেন, সেই সুমন রায় জানান, “শিশুটির শরীরে অস্বাভাবিক পরিমাণ বাতাস প্রবেশ করানোয় তার পেটের নাড়ি-ভুঁড়ি ছিড়ে গিয়েছিল, ফুসফুসও ফেটে যায়।”

রাকিবের মৃত্যুর পরপরই স্থানীয়রা গ্যারেজ মালিক মিন্টু মিয়া (৪০) ও তার কর্মচারী শরীফ (৩৫) এবং শরীফের মা বিউটি বেগমকে (৫৫) পুলিশে ধরিয়ে দেয়।

সাতক্ষীরার দিনমজুর নূর আলম হাওলাদারের ছেলে রাকিব। বছর তিনেক আগে খুলনায় এসে টুটপাড়া সেন্ট্রাল রোডের বস্তিতে উঠেন নূর আলম।

অভাবের কারণে দেড় বছর আগে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ুয়া একমাত্র ছেলে রাকিবকে মিন্টু মিয়ার গ্যারেজে কাজে দিয়েছিলেন নূর আলম।

লাকি বলেন, “গ্যারেজ মালিকের গালমন্দ ও কথায় কথায় মারপিটের কারণে কাজ ছেড়ে পিটিআই মোড়ে নাসিরের গ্যারেজে কাজ নেয় রাকিব। এতেই ক্ষুব্ধ হয় মিন্টু মিয়া।”

সে জন্য একটি শিশুকে মেরে ফেলা হবে- এই বিস্ময় এলাকাবাসীর। “কী অপরাধ করেছিল আমার বুকের ধন”- সবার কাছে লাকি এই প্রশ্নের উত্তর চাইলেও উপস্থিত সবাই ছিল নির্বাক।

Developed by: