মো. কাচা মিয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের একজন প্রবাসী সংগঠক। ১৯৭১ সালে রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধে পরাধীন দেশ জাতির স্বাধীনতার সোনালি স্বপ্ন নিয়ে বহির্বিশ্বে যে সব স্বদেশ প্রেমিকরা সংগঠিত হয়ে বিভিন্নভাবে বাঙালি জাতির স্বাধীনতার্জনের বন্ধুর পথকে সুগম করার সার্থক প্রয়াস পেয়েছিলেন, ঐতিহ্যবাহী বিশ্বনাথ উপজেলার কৃতীসন্তান মো. কাচা মিয়া তাদের একজন, এমনকি অগ্রগণ্য বলা যায়। স্বদেশ স্বজাতি যখন পাকহানাদার বাহিনীর অতর্কিত আক্রমনে দিশেহারা, পাকিস্তানী দুর্বৃত্তদের বহুজাতিক নির্মম অত্যাচারে আবহমান বাঙালি জাতি যখন অতিষ্ট ঠিক তখন নির্যাতিত দেশ জাতির পে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করার তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন মো. কাচা মিয়া। তিনি স্বাধীনতাকামী কতিপয় হৃদয়বান প্রবাসী বাঙালি বন্ধুদের নিয়ে যুক্তরাজ্যের ওল্ডহ্যাম শহরে ওল্ডহ্যাম-বাংলাদেশি ইয়ুথলীগ নামে একটি ব্যতিক্রমধর্মী সংগঠনের রূপায়ন করেন এবং সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের পদে অধিষ্ঠিত হয়ে সম্পূর্ণ অভিনব দতার সাথে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেন। উল্লেখিত সংগঠনটি বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পে সর্বপ্রথম সংগঠন। ওল্ডহ্যাম-বাংলাদেশি ইয়ুথলীগের ল্য ছিল প্রবাসী বাঙালিদের নিকট থেকে সাপ্তাহিক চাঁদা সংগ্রহ করে ওইসব মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে দান করা। স্বদেশ প্রেমিক কাচা মিয়ার আন্তরিক প্রচেষ্টা ও সুদ নেতৃত্বে স্বাধীনতাকামী ওল্ডহ্যামবাসী বাঙালিরা বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিযুদ্ধের তহবিলে বিপুল অংকের বৈদেশিক মুদ্রা জমা করেন। ওইসব মুদ্রা অস্ত্র কেনার কাজে ব্যবহৃত হয়। সংগ্রামী ব্যক্তিত্ব মো. কাচা মিয়া বিশ্বনাথ উপজেলার ৫নং দৌলতপুর ইউনিয়নের নয়াগাঁও গ্রামে ১৯৩৮ খ্রি. ১লা জানুয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা মো. ছিদ্দেক আলী ও মাতা আফতেরা বিবি। তিনি ১৯৬২ খ্রি. যুক্তরাজ্য গমন করেন। মো. কাচা মিয়া একজন সফল সংগঠক এবং বিশ্বস্ত সমাজসেবক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শের সৈনিক, আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির ধারক মো. কাচা মিয়া ওল্ডহ্যাম শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের প্রাণ পুরুষ। এক সময় বিপুল ভোটের ব্যবধানে নির্বাচিত হন ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক। প্রগতিশীল রাজনীতিতে আস্থাশীল মো. কাচা মিয়া দীর্ঘদিন ওল্ডহ্যাম আওয়ামীলীগের সম্পাদকের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন জনকল্যাণ মূলক কর্মকাণ্ডের সাথে তাঁর গভীর সম্পৃক্ততা রয়েছে যথারীতি।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বইপত্রে উজ্জ্বল অরে লিপিবদ্ধ রয়েছে তার সংগ্রামী ভূমিকার কথা। বিশ্বনাথের অহংকার, মুক্তিযুদ্ধের প্রবাসী সংগঠক মো. কাচা মিয়ার একটি সংপ্তি সাাৎকার মাসিক বাসিয়ায় প্রকাশিত হলো। এটা মননশীল পাঠকের নিকট প্রিয়পাঠ্য হলে আমাদের পরিশ্রম সার্থক মনে করবো।
বাসিয়া: সুদূর প্রবাসে থেকে মহান মুক্তিযুদ্ধে আপনি বিরাট অবদান রাখার প্রয়াস পেয়েছেন। তো এ েেত্র কাজ করার আপনার মূল উদ্দেশ্য কী ছিল?
কাচা মিয়া: বাংলাদেশ আমার জন্মভূমি। এখানকার মাটিতে আমার নাঁড়ি প্রোথিত। সঙ্গতকারণে এদেশ ও দেশের মাটির সাথে আমি আত্মিকভাবে সম্পর্কিত। স্বদেশ স্বজাতির সমস্যাকে আমি আমার নিজের সমস্যা মনে করি। দেশজাতির অগ্রগতি-উন্নয়নের সংবাদে যে রকম পুলকিতবোধ করি তদ্রপ অবনতি ও অশান্তির সংবাদে ও মর্মাহত হয়ে থাকি। ’৭১ এর ৭ মার্চের ভাষণের পর থেকে আমার ধারণা হয়েছিল যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে স্বাধীনতার্জনের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। পরবর্তীতে ২৬ শে মার্চ যখন পাকহানাদার বাহিনী অতর্কিত হামলা চালাতে শুরু করলো তখন গোটা বিশ্ব বিস্ময়ের দৃষ্টিতে তাকাতে শুরু করলো তাদের পৈচাশিক কর্মকাণ্ডের দিকে। বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে শুরু হলো প্রতিরোধ থেকে মুক্তিযুদ্ধ। যেটা সুদীর্ঘ ন’মাস চলমান ছিল। পাকিস্তানী স্বৈরাচারীদের প্রতি আমরা প্রবাসীদের মনোভাব বেশ অসন্তুষ্ট ছিল সেই ’৭০ সালের নির্বাচন থেকে। ওই সময়ের সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবের বিজয় হলে মতা হস্তান্তরে কর্তৃপরে গড়িমসি আমাদেরকে সীমাহীন হতাশ করে। তখন থেকে আমাদের আর বুঝতে অবশিষ্ট থাকলো না যে বিনা রক্তপাতে স্বাধীনতা আসবে না। সেই উপলব্ধিকে কেন্দ্র করে মোট ৩৬ জন সহকমীদের নিয়ে আমি ওল্ডহ্যাম বাংলাদেশি ইয়ূথলীগ নামে বাংলাদেশে চলমান মুক্তিযুদ্ধকে সহযোগিতা করার উদ্দেশ্যে সংগঠন করি।
বাসিয়া: বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক আপনি। এটা বিরাট এক অহংকারের বিষয়। এ প্রসঙ্গে আপনার অনুভূতি জানতে চাই?
কাচা মিয়া: বহির্বিশ্বে ওল্ডহ্যাম শহরে আমার উদ্যোগে অন্যান্য সহযোদ্ধাদের সার্বিক সহযোগিতায় ওল্ডহ্যাম-বাংলাদেশি ইয়ূথলীগ গঠন করি। আমি ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। সে বাস্তবতায় বহির্বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সংগঠক হিসেবে নিজেকে গর্বিত মনে করি। পরবর্তীতে বিশেষ করে ইংল্যান্ডের অন্যান্য শহরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপে বিভিন্ন সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এটা এক বিরাট গৌরবের বিষয়। আমি সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলাম। এক সময় স্বাধীনতা অর্জিত হলে আমি আমার স্বপ্নকে সফল মনে করলাম।
বাসিয়া: কিছুদিন পূর্বে আমরা জানতে পারলাম যে, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখার জন্য আপনাকে প্রবাসী মুক্তিযোদ্ধার সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বিলম্বের কারণ কী মনে করেন।
কাচা মিয়া: কিছুদিন পূর্বে যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের উদ্যোগে আমাকে সম্মান প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সংবাদে আমিও আশাবাদী হই। অতপর কর্তৃপরে পিছুটানের প্রকৃত কারণ খুঁজে পাইনি। হয়তো সময় সুযোগের অপোয় তারা রয়েছেন। এ ব্যাপারে আমার করণীয় কিছু আছে বলে মনে করি না। বাংলাদেশ সরকারের ডাক এলে আমি সে ডাকে তাৎণিক সাড়া দিতে দ্বিধাবোধ করবো না।
বাসিয়া: স্বাধীনতার্জনের পর বাঙালি জাতি কতোটুকু উপকৃত হয়েছে বলে মনে করেন?
কাচা মিয়া: স্বাধীনতা বাঙালি জাতিকে যথার্থ উচ্চতায় প্রতিস্থাপিত করেছে। বাঙালি আর পরাধীন নয়। একটি স্বাধীন দেশ ও জাতি হিসেবে আমাদের গৌরবদীপ্ত পরিচিতি আজ বিশ্বময়। আমরা এখন আর তলাবিহীন ঝুড়ি নই- এমনকি কচুপাতার পানিও নই। স্বাধীনতার্জনের পর বাঙালি বহুপ্রকার বিজয়ের অসংখ্য মাইলফলক অতিক্রম করেছে। আমরা যে সীমাহীন উপকৃত হয়েছি তা বলার অপো রাখে না।
বাসিয়া: জাতির জনক শেখ মুজিব সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চাই?
কাচা মিয়া: শেখ মুজিব বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা। বিশ্বসেরা যে ৫/৭ জন নেতা রয়েছেন শেখ মুজিব তাদের একজন। আমি যখন ওল্ডহ্যাম শহরস্থ মাপল মিলে চাকরি করি তখন মঞ্জুর আহমদ নামধারী আমার এক সহকর্মী কথা প্রসঙ্গে আমাকে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে একটা টাইগার আছেন যার নাম শেখ মুজিব।’ কিউবার প্রেসিডেন্ট যাকে হিমালয়ের সাথে তুলনা করেছেন তার মূল্যায়ন ও কী করবো। শেখ মুজিব একজন আন্তর্জাতিক মানের নেতা। সাহস, বুদ্ধি, প্রজ্ঞা, বিচণতা দূরদর্শিতা ইত্যাদি কোনো কিছুর কমতি ছিল না শেখ মুজিবের।
বাসিয়া: একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে আপনি কীভাবে দেখেন?
কাচা মিয়া: সূচনালগ্ন থেকেই গণতন্ত্র নানা ঘাত প্রতিঘাতের মুখোমুখি হয়ে আসছে। ’৭৫ এর পনোরো আগস্ট জাতির জনক ট্রাজেডি গণতন্ত্রের ভিত্তিকে প্রকম্পিত করেছে। পঁচাত্তর পরবর্তীতে অনেক স্বৈরাচারীদের করতলগত হয়েছে এদেশের মসনদ। তারা খেয়াল খুশী মত মূল চার নীতির শল্য চিকিৎসা করেছেন। আমার মতে জিয়াউর রহমানের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড গণতন্ত্রের ধারাকে বাধাগ্রস্থ করেছে। ফলে তিগ্রস্থ হয়েছে গণতন্ত্র। ওই সব না হলে এতদিনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিশ্ব দহলিজে আদর্শ হয়ে যেতো। স্বাধীনতা বিরোধী চক্র বিশেষ করে আমেরিকা ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এখনও আমাদের স্বপে অবস্থান করতে পারছে না। একাত্তরে তাদের ভূমিকা যেরূপ ছিল বর্তমানে সেরূপ রয়েছে বলে মনে হয়। তারা চায় না বাংলাদেশ অগ্রগতির ধারায় আবর্তিত হোক। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার ৭ম নৌবহরের সংবাদ কার অজানা? রাশিয়া, ভারত আমাদের পাশে না থাকলে এত কম সময়ে স্বাধীনতার্জন সম্ভব হতো না। ইউরোপ-আমেরিকা চায় বাংলাদেশ তাদের দিকনির্দেশনায় চলুক পান্তরে শেখ মুজিবের মেয়ে চান স্বাধীন দেশের মানুষ হিসেবে স্বাধীনভাবে চলতে। পশ্চিমারা শেখ হাসিনার নীতি আদর্শের প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারছে না। শেখ হাসিনার গঠনমূলক নেতৃত্ব দেশজাতিকে আলাদা উচ্চতায় উপনীত করেছে। তাঁর ব্যতিক্রমী অগ্রযাত্রা প্রতিরোধকল্পে আন্তজার্তিক অসংখ্য ষড়যন্ত্র ক্রিয়াশীল রয়েছে। কোনো মোড়ল রাষ্ট্রের করুণায় নয়; আপন বুদ্ধিমত্তার বলে শেখ হাসিনা এখন বিশ্বনেত্রী। এ গৌরব গোটা বাঙালি জাতির। উচ্চ মতাসম্পন্ন কোনো অস্ত্র নয়, জনপ্রিয়তাই ছিল শেখ মুজিবের মোম হাতিয়ার। ১৯৭৪ সালের দুর্ভি ছিল অনেকটা মানব সৃষ্ট। আমেরিকা সময় মতো ত্রাণ জাহাজ প্রেরণ করলে দুর্ভিরে মাত্রা এত সীমাহীন হতো না। ওই সময় পাক প্রেসিডেন্ট, ’৭১ এর পরাজিত মুখ, ইয়াহিয়া চীন সফরে যাওয়ার সময় দুর্ভি পীড়িত বাংলাদেশের করুণ চিত্র দেখে রুমাল দিয়ে মুখ ডেকে ছিলেন।
বাসিয়া: অনেক বাঙালি যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব লাভ করেছেন। সেখানে তারা স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তাদের পরবর্তী প্রজন্ম বাংলাদেশ সম্পর্কে কীরূপ ধারণা পোষণ করে থাকে?
কাচা মিয়া: গণতন্ত্রের দৌড়ে বাংলাদেশ বেশ অগ্রগামী। শেখ হাসিনার মতো নেতার নেতৃত্ব অব্যাহত থাকলে অচিরেই গণতান্ত্রিক বিকাশ ঘটবে তা মনে করা যায়। আমি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের বিজয়ে সম্পূর্ণরূপে আশাবাদী। যে যেখানে জন্মগ্রহণ করে সে স্থানই তার জন্মভূমি। যুক্তরাজ্যে অসংখ্য বাঙালি স্থায়ীভাবে বসবাস করছে। ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত করছে। খুঁজে নিচ্ছে সুখ সমৃদ্ধজীবন তাদের উত্তরসূরীরা বাংলাদেশকে তাদের পিতার কিংবা দাদার দেশ বলে ভালো জানে। তারা বাংলাদেশকে ভালোবাসে মনে প্রাণে। দেশের উন্নয়নের সংবাদে খুশী হয়, আনন্দবোধ করে থাকে। তাদের অধিকাংশরা সময় সুযোগে বাংলাদেশ সফর করে এমন কি করবেও। বাংলাদেশ সুখী সমৃদ্ধ একটি আত্ম নির্ভরশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভে ধন্য হোক ওই প্রত্যাশা আমারও।
ধন্যবাদ আপনাকে।