হৃদয় সজীব : বৃহত্তর সিলেটের সংগীত জগতে ওয়াসিম খান নাম উচ্চারণ করলে সবাই এক নামে চিনে একজন সফল কী-বোড বাদক হিসেবে। এ সুনাম অর্জন করেছেন ওয়াসিম খান দীর্ঘদিনে। শিশুকালেই ওয়াসিম খান সুরের ভুবনে যাত্রা শুরু করেন। বড় ভাই লাল মিয়া তখন গান গাইতেন। তাঁর হাত ধরে ওয়াসিম খান গানের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং বড় ভাইয়ের সাথে কণ্ঠ মিলাতে থাকেন। কম বয়সেই আয়ত্ত করেন একটি অসাধারণ গুণ। এক সাথে পাঁচটি ডফকি বাজানোর দুর্লভ অর্জন। বড় ভাই লাল মিয়ার অনুষ্ঠানে বিশেষ আকর্ষণ ছিল ওয়াসিম খান ডফকি বাজানো। মানুষ মুগ্ধ হয়ে যেমন গান শুনতো তেমনি ওয়াসিম খানের ডফকি বাজানো দেখে তাক লেগে যেত এবং অনুষ্ঠানে শেষে গুণীজনরা তাকে আর্শিবাদ করে যেতেন।
ওয়াসিম খানের ১৯৬৪ খ্রি. বি-বাড়িয়ার হাবলা উচ্চ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম মো. শহিদুল ইসলাম ও মাতা মরহুমা মোছা. সাফিয়া খাতুন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি তৃতীয়।
বড় ভাই লাল মিয়ার সাথে ওয়াসিম খান বি-বাড়িয়ার আঁনাচে কাঁনাচে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশন করতেন। এক পর্যায়ে গানের নেশায় ও যন্ত্রের ভালোবাসায় তারা ছাতকে চলে আসেন। ছাতক বাজারের গুণীজন ও কিছু মুরব্বিরা বাউলদল দেখে গান গাওয়ার অনুরোধ করেন। তখন তিনি বড় ভাইয়ের সাথে গান গাওয়া শুরু করেন এবং একসাথেপাঁচটি ডফকি বাজাতে থাকেন। মুরব্বিদের দৃষ্টি পড়ে শিশু ওয়াসিমের অসাধারণ ডফকি বাজানোর দিকে। এক পর্যায়ে দুর্বিণ শাহর জনপ্রিয় গান ‘যৌবনরে ডেকছি তরে লইয়া আমি অভাগীনি’ গানটিতে টান দিলেই উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে যান। এই আসরে ছিলেন মুরব্বিদের সারিতে দুর্বিণশাহও। গান শেষ হওযার পরে উপস্থিত সুধীজন জানতে চাইলে যার গান গাইয়ের সেই পীর সাহেবের সাথে আপনাদের পরিচয় আছে কি? কিন্তু ইতোপূর্বে দূর্বিণ শাহর সাথে তাদের পরিচয় হয়নি। ওয়াসিম সান্বিধ্য পেলেন বাউল সম্রাট দুর্বিন শাহর। শুধু সান্বিধ্য নয় দুর্বিন শাহ মুগ্ধ হয়ে মাথায় হাত দিয়ে আর্শিবাদ করলেন।
এভাবে এগুতে থাকেন ওয়াসিম গানের জগতে। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৬ সালের শেষের দিকে বড় ভাইয়ের সাথে সিলেটের তালতলার দিকে যাচ্ছেন। তালতলার হোটেল ব্যবসায়ী কালা মিয়ার দৃষ্টিপরে তাদের দিকে। তিনি তাদেরকে নিয়ে যান তার নিজস্ব হোটলের অফিসে। সেখানে অনেক ভাবুকরা বসে আছেন। তখন বিকাল চারটা। বাংলাদেশ বেতারে অনুষ্ঠানপূর্ব সিলেটের বাউল পরিবেশিত হবে। সবাই শুনবেন। বেতারে শুরু হলো বাউল আবদুল হামিদের গান। সবাই মনোযোগ সহকারে শুনলেন। গান শেষে শুরু হলো ওয়াসিমদের পালা। ছাতকের মতো সিলেটেও সবাই মুগ্ধ হলেন ওয়াসিমের অসাধারণ ডফকি বাজানো দেখে। আসরের শেষ পর্যায়ে উপাস্থিত হলেন বিশিষ্ট কণ্ঠশিল্পী আবদুল হামিদ। তিনি তাদেরকে নিয়ে লালদিঘির পারের হোটেল তাজ বোডিংয়ে যাপনের ব্যবস্থা করলেন। আবদুল হামিদ ওয়াসিমের প্রতিভায় মুক্ত হয়ে ছাড়তে চাইলেন না। শেষ পর্যন্ত আবদুল হামিদ ওয়াসিমকে তার বন্ধনে নিয়ে আসলেন। ওয়াসিম আবদুল আবদুল হামিদকে ধর্মীয় পিতা হিসেবে গ্রহণ করে আনুষ্ঠানিকভাবে গানের তালিম নেয়া শুরু করেন এবং বিভিন্ন জায়গায় তার সাথে গানে কণ্ঠ মিলাতে থাকেন। বাউল আবদুল হামিদের সুযোগ্য শিষ্য হিসেবে ওয়াসিমের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে।
ওয়াসিম ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের আধুনিক ও পলীগীতি গানের একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তালিকাভূক্ত হন। ১৯৯৮ সালের (৭ পৃষ্ঠায় দেখুন) মিয়া (৬ পৃষ্ঠার পর) : পলীগীতি গানের একজন কণ্ঠশিল্পী হিসেবে তালিকাভূক্ত হন। ১৯৯৮ সালের যন্ত্রশিল্পী হিসেবে বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্র তাকে চাকরি প্রদান করে। তিনি কী-বোর্ড, দুতারা, মেন্ডোলিন, তবলা, হারমোনিয়াম বাজান বেতারে।
২০০৭ সালে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের কণ্ঠশিল্পী হিসেবে অনুমোদান লাভ করেন।
২০১৫ সালের শেষের দিকে বেতারের সুরকার হিসেবে তিনি গান সুরারোপ করতে থাকেন এবং বিশেষ বিশেষ প্রোগ্রামে তার সুরারোপিত গান পরিবেশিত হয়ে থাকে।
১৯৯১ সালে প্রথমবারের মতো ওয়াসিম শিল্পী হিসেবে লন্ডন সফর করেন। তার সাথে এ সফরে ছিলেন সৈয়দ আবদুর হাদী, বেবী নাজনীন, বাউল আবদুল হামিদ ও বাউল মুজিবুর সরকারসহ আরো অনেকে। এছাড়া তিনি বিভিন্ন সময় ভারতে বিভিন্ন অনুষ্টানে গান পরিবেশন করেন। সম্প্রতি তিনি সুফী শিতালংশাহ শিল্পী গোষ্ঠী প্রদত্ত সম্মাননা পদক ২০১৬ গ্রহণ করেন।
তার প্রিয় শিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী, সুবীর নন্দী, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লায়লা, মাহমুদুন নবী, খুশিদ আলম। খুশিদ আলমের গান নিজের করতেন। প্রিয় সুরকার খান আতাউর রহামন, সত্য সাহা।
জীবনে গান বাজনায় মগ্ধ থাকার কারণে ব্যক্তিজীবন নিয়ে ভাবা সম্ভব হয়নি। প্রায় ৪০ বছর বয়সে ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর মোছা. সাবরীন ভূইয়া নিপার সহিত বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।