বড়লেখায় একমাসে পাঁচটি লোমহর্ষক হত্যা: আইন-শৃঙ্খলার চরম অবনতি

18619মৌলভীবাজারের বড়লেখায় গত একমাসে পাঁচটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। একের পর এক নৃশংস খুনের ঘটনায় সাধারণ মানুষদের মধ্যে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। একটি খুনের রেশ কাটতে না কাটতেই ঘটছে আরও একটি খুনের ঘটনা। আওয়ামীলীগ নেত ও প্যানেল চেয়ারম্যান, ব্রিটিশ নারী খুন হওয়ার পর সর্বশেষ গত ১৪ অক্টোবর পূর্ব বিরোধের জের ধরে আপন ভাতিজার দা’র কোপে খুন হন আসুক উদ্দিন (৩৮) নামের অটোরিক্সাচালক। এসব ঘটনায় সাধারণ মানুষজন আইন-শৃক্সক্ষলা সরাসরি বাহিনীকে দায়ী করছেন। পাশাপাশি এসব খুনের ঘটনায় সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়ও জড়িত রয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৪জনকে এলাকাবাসীর সহায়তায় গ্রেফতার করেছে থানা পুলিশ। অন্য ঘাতকদের গ্রেফতার করতে পুলিশ তৎপর রয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্তে সংশ্লিষ্টরা।

হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি সীমান্তবর্তী এ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে চুরি, ডাকাতি, জায়গা দখল, অপহরণ, সন্ত্রাসী হামলাসহ নানা অপরাধ কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পেয়েছে। ওসি সহিদুর রহমানের যোগদানের পর থেকে প্যানেল চেয়ারম্যান আলম, ব্রিটিশ নারী, অটোরিক্সাচালক আসুক হত্যাসহ গত এক মাসে ৫টি হত্যাকাÐের ঘটনা ঘটে। এছাড়া অন্যান্য অপরাধ কর্মকাণ্ডসহ নানা অপরাধ পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে। আইন-শৃক্সক্ষলার এমন অবনতিতে স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের চরম ব্যর্থতাকেই দায়ী করছেন সাধারণ জনগণ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ১৪ অক্টোবর সদর ইউনিয়নের কেছরীগুল গ্রামে দুপুর সাড়ে ১২টায় জমি-জমা সংক্রান্ত পূর্ব বিরোধের জের ধরে আপন ভাতিজার দা’র কোপে আসুক আহমদ (৩৮) নির্মমভাবে খুন হন।  নিহত আসুক পেশায় সিএনজিচালিত অটোরিকশাচালক ও কেছরীগুল গ্রামের মঈন উদ্দিন মনাই’র ছেলে। ঘটনার পর পরই ভাতিজা সুমন আহমদ (২৮) পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় থানায় হত্যা মামলা রুজু হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, হত্যাকারী সুমনকে গ্রেফতারের জোর চেষ্টা চলছে।

এদিকে গত ০৬ অক্টোবর সকাল ১০টায় উপজেলার দাসেরবাজার ইউপি’র পশ্চিম গুলুয়া গ্রামের মৃত ললিত মোহন দাসের স্ত্রী মায়া রাণী দাসকে (৫৫) নিজকক্ষে ঢুকে কাঁচি  দিয়ে কুপিয়ে খুন করে ভাসুরপুত্র নৃপেশ দাস সুনাই (২৫)। ঘটনার পর পরই এলাকাবাসী অভিযুক্ত নৃপেশকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয় ওই ঘাতক। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই জাহাঙ্গীর আলম জানান, জমি-জমা সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে চাচী মায়া রাণীকে কুপিয়ে হত্যা করে সুনাই। আদালতে সে চাচী হত্যার দায় স্বীকার করেছে।

অপরদিকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর সকাল পৌনে ১১টায় প্রকাশ্য দিবালোকে পূর্ব বিরোধের জেরে উপজেলার উত্তর শাহবাজপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান ও ইউপি আওয়ামীলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন আলমকে (৩৮) দা দিয়ে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে কাজল মিয়া (৪৭)। নিহত আলম সায়পুর গ্রামের খলিলুর রহমানের ছেলে। এই ঘটনায় আলমের বাবা খলিলুর রহমান ওইদিন রাতেই কাজল মিয়াকে প্রধান আসামী করে আরওা ৪/৫জনকে অজ্ঞাতনামা রেখে থানায় হত্যা মামলা রুজু করেন। ঘটনার পরদিন ৩০ সেপ্টেম্বর ভোরে খুনি কাজল ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয়দের হাতে আটক হয়। পরে তাকে থানা পুলিশের কাছে সোপর্দ করা হয়। কাজল আদালতে এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করেছে। তবে এ হত্যাকাÐে ব্যবহৃত সেই দা এখনও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। নিহতদের পরিবার ও স্থানীয়দের দাবি, রাজনৈতিক জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে পরিকল্পিতভাবে কাজলকে ব্যবহারের মাধ্যমে দু’বারের মেম্বার আলমকে খুন করানো হয়েছে। এ ঘটনার পর মূল হোতাদের শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি ও ফাঁসির দাবিতে এলাকায় বিক্ষোভ-সমাবেশ অব্যাহত রয়েছে।

এছাড়া গত ১৩ সেপ্টেম্বর ভোররাতে উপজেলার চান্দগ্রামে নিজ বাড়িতে খুন হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ নাগরিক ফাতির আলীর স্ত্রী মায়ারুন নেছা (৬৬)। পুত্রবধূর পরকীয়ার জেরেই খুন হন তিনি। এ ঘটনায় নিহতের দেবর হারিছ আলী বাদী হয়ে দু’জনের নামোল্লেখ ও আরও কয়েকজনকে অজ্ঞাতনামা  রেখে থানায় মামলা করেন। এ ঘটনায় জড়িত পুত্রবধূ ফাহিমা (২৮) ও ফাহাদ আহমদ সবুজ (২২) নামের এক যুবককে গ্রেফতার করেছে থানা পুলিশ। ফাহিমা ও সবুজ পৃথকভাবে বড়লেখা সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট হাসান জামানের আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই অমিতাভ দাস তালুকদার জানান, গৃহবধূূ ফাহিমা তার স্বামীর অবর্তমানে জনৈক ব্যক্তির সাথে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ঘটনার রাতে শ্বাশুড়ী বিষয়টি টের পাওয়ায় তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। তিনি আরও জানান, এই ঘটনার মূল আসামীকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

একই দিন ১৩ সেপ্টেম্বও কোরবানির মাংস বণ্টন নিয়ে প্রতিপক্ষের দা’র কোপে কুতুব আলী নামের এক ব্যক্তি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ঘটনার পর পরই এলাকাবাসী হত্যাকারী আব্দুল জলিলকে আটক করে পুলিশে সোপর্দ করেন। আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে ঘাতক।

এ বিষয়ে বড়লেখা থানা অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সহিদুর রহমান জানান, উপজেলার আইন-শৃক্সক্ষলা পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে আছে। সাম্প্রতিককালে যে কয়টি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে,  সেগুলোর প্রায় সবগুলোরই রহস্য উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। পৃথক এসব ঘটনার সাথে জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এসব হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত অন্যদেরও দ্রুত গ্রেফতার করা হবে।

জেএ/এমওআর

Developed by: