টুঙ্গিপাড়ার খোকা থেকে ইতিহাসের মহানায়ক

A-1ঢাকা, ১৫ আগস্ট- স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার নেতৃত্বেই মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার পাটগাতি ইউনিয়নের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন।
তার বাবা শেখ লুত্ফর রহমান গোপালগঞ্জ দায়রা আদালতের সেরেস্তাদার (যিনি আদালতের হিসাব সংরক্ষণ করেন) ছিলেন। মা সায়েরা খাতুন। শৈশবে বঙ্গবন্ধুকে আদর করে ডাকা হতো ‘খোকা’। ১৯২৭ সালে ৭ বছর বয়সে শেখ মুজিব গিমাডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শুরু করেন। সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালীন চোখে সার্জারি করাতে হয়েছিল তার। যে কারণে প্রায় ৪ বছর পড়াশোনা বন্ধ থাকে।

১৯৪১ সালে গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল থেকে তিনি ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর কলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে এইচএসসি এবং বিএ পাস করেন। ১৯৪৭ সালে কলকাতা ত্যাগ করে ঢাকা ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। স্কুল জীবনেই তার রাজনৈতিক সচেতনতার প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৩৯ সালের ঘটনা।
অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুল পরিদর্শনে এলে বঙ্গবন্ধু স্কুলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ত তা সারানোর জন্য ও ছাত্রাবাসের দাবি স্কুল ছাত্রদের পক্ষ থেকে তুলে ধরেন। অল্প বয়স থেকেই তার রাজনৈতিক প্রতিভার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ১৯৪০ সালে তিনি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন নিখিল ভারত মুসলিম ছাত্র ফেডারেশনে যোগ দেন।

পরে এই সংগঠন ছেড়ে ১৯৪৩ সালে যোগ দেন বেঙ্গল মুসলিম লীগে। এখানেই সান্নিধ্যে আসেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর। ১৯৪৮ সালে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ গঠন করেন। ১৯৪৮ সালে ভাষার প্রশ্নে তার নেতৃত্বেই প্রথম প্রতিবাদ এবং ছাত্র ধর্মঘট শুরু হয়, যা চূড়ান্ত রূপ নেয় ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে। পঞ্চাশের দশক তার রাজনৈতিক উত্থানের কাল। ধীরে ধীরে তিনি হয়ে ওঠেন দূরদর্শী এক রাজনৈতিক নেতা।
এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান মুসলিম লীগ ছেড়ে দেন এবং হোসেন সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা ভাসানীর সঙ্গে মিলে গঠন করেন ‘আওয়ামী মুসলিম লীগ।’ তিনি দলের প্রথম যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ভাষা আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক নেতা হিসেবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৩ সালে তিনি দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হয়ে যুক্তফ্রন্ট সরকারের কৃষিমন্ত্রী হন তিনি। ১৯৫৬ সালে কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ১৯৬৩ সালে হোসেন সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ মুজিবুর রহমান।
১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোরে বিরোধী দলসমূহের একটি জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনেই শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৬ দাবি পেশ করেন, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের পরিপূর্ণ রূপরেখা উল্লিখিত হয়েছিল। এ দাবি আদায়ে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আন্দোলন তীব্র হয়। ১৯৬৮ সালের প্রথমদিকে পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবুর রহমান এবং আরও ৩৪ জন বাঙালি সামরিক ও সিএসপি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। ইতিহাসে এটি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা নামে সুপরিচিত।
এতে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করা হয়। তাকে গ্রেফতার করা হলে আন্দোলনকারী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে মুক্ত করে বাঙালিরা। ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর আয়োজিত এক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব বাংলার নামকরণ করেন ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক আইনসভায় নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে।
আওয়ামী লীগ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩১০টি আসনের মধ্যে ৩০৫টি আসন লাভ করে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুর স্বায়ত্তশাসনের নীতির পুরোপুরি বিপক্ষে ছিল। আওয়ামী লীগের সরকার গঠন ঠেকাতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংসদের অধিবেশন ডাকা নিয়ে টালবাহানা শুরু করেন।

বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন। রেসকোর্সের জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন— ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর ডাকে উত্তাল হয়ে ওঠে সারা দেশ। ইয়াহিয়া খান সামরিক আইন জারি করেন। ২৫ মার্চ কালরাতে সারা দেশে গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি সেনারা। সেই রাতেই ধানমন্ডির নিজের বাসভবন থেকে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নামে আপামর জনসাধারণ।

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করা হয়। তার অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। এ সরকারের অধীনেই গঠিত হয় মুক্তিবাহিনী এবং শুরু হয় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী লড়াই। দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের প্রাণ ও লাখো নারীর আত্মবিসর্জনে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলেও তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার কারাগার থেকে শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পান ৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সালে। তিনি দেশে ফেরেন ১০ জানুয়ারি। একটি জাতিকে স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ উপহার দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ইতিহাসের এই মহানায়ককে নিয়ে অন্নদাশঙ্কর রায় যথার্থই লিখেছেন— ‘যতদিন রবে পদ্মা- মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান/ ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

ব্যক্তিত্বে ও নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু বিশ্ব মিডিয়ার নজর কেড়েছিলেন। আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় তাকে তুলে ধরা হয়েছে ‘মহান নেতা’ ও ‘অসামান্য ব্যক্তিত্ব’ শিরোনামে। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার ঘোষণার পর পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দী হন শেখ মুজিবুর রহমান। এ ঘটনার পর নিউজউইক ম্যাগাজিন তাদের প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে ‘পোয়েট অব পলিটিকস’ আখ্যায়িত করে নিবন্ধ প্রকাশ করে।

ফিন্যানশিয়াল টাইমস ১৯৭৫ সালে তাকে নিয়ে লিখে— বঙ্গবন্ধু না থাকলে কখনই বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে শিরোনাম করে— ‘বাংলাদেশ : ফ্রম জেইল টু পাওয়ার’।

দ্য গার্ডিয়ানে লেখা হয়— ‘শেখ মুজিব ছিলেন এক বিস্ময়কর ব্যক্তিত্ব’। – পশ্চিম জার্মানি পত্রিকায় লেখা হয়— ‘শেখ মুজিবকে চতুর্দশ লুইয়ের সঙ্গে তুলনা করা যায়। জনগণ তার কাছে এত প্রিয় ছিল যে, লুই ইয়ের মতো তিনি এ দাবি করতে পারেন, আমি-ই রাষ্ট্র।’

১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় জোট-নিরপেক্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর দেখা হয়েছিল। তখন কাস্ত্রো বলেন, ‘আমি হিমালয়কে দেখিনি, তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এ মানুষটি হিমালয়ের সমান। সুতরাং হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতা আমি লাভ করেছি। ’

এই উপমহাদেশের বাঙালি মনীষীদের নিয়ে পরিচালিত বিবিসির এক জরিপে সবাইকে ছাড়িয়ে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ নির্বাচিত হয়েছিলেন বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

Developed by: