মৃত্যু ঝুকিতে নাফ নদীর ওপারে আটকে থাকা হাজারো রোহিঙ্গা

9aba063caae5e1c10870d4f43428d417কক্সবাজার, ০৮ অক্টোবর- থেমে নেই আরাকানে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নির্মমতা। প্রতিদিনই অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে রোহিঙ্গাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনা। আরাকানে একজন রোহিঙ্গা মুসলিমকেও থাকতে দেয়া হবে না এমন কঠোর মনোভাব নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান ও গণবিতাড়ন অভিযান অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী।

বাড়িঘর থেকে বিতাড়িত হয়ে সীমান্তের ওপারে নাফ নদীর তীরে, বনে জঙ্গলে অবস্থান নিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। গত চারদিন ধরে নাফনদীর তীরে আটকে আছেন বুচিডংয়ের হাজারো রোহিঙ্গা। তারা খেয়ে না খেয়ে রোদে পুড়ে খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষা করছেন বাংলাদেশে আসার জন্য। এ অবস্থায় গত শুক্রবার রাতে প্রচণ্ড ঝড়ো হওয়া এবং প্রবল বৃষ্টিতে ভিজে ১০টি শিশু মারা গেছে।

সুত্র জানিয়েছে, বৃষ্টিতে ভিজে ৪০-৫০টি শিশু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে ১০-১২টি শিশুর অবস্থা আশংকাজনক। রাতে প্রবল বৃষ্টি হলে রোহিঙ্গারা পাহাড়ের ঢালুতে গাছের নিছে আশ্রয় নেয়ার জন্য নদীর তীর থেকে পাহাড়ের দিকে যেতে চাইলে মিয়ানমারের সেনারা আটকে তাদের দেয় এবং নদীর দিকে ধাওয়া করে।

এসব আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে একজন বৃদ্ধ কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানান, কোলের বাচ্চা কোলেই মারা পড়বে যদি তাদের দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করা না হয়। এভাবে আর ক’দিন গেলে বৃদ্ধরাও মারা পড়বেন।

তিনি আটকেপড়া এসব রোহিঙ্গাকে উদ্ধার ও শিশুদের মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্যের আকুতি জানিয়েছেন। এভাবে প্রতিদিনই বাংলাদেশে এসে প্রাণে বাঁচার আকুতি নিয়ে হাজার হাজার রোহিঙ্গা নাফনদীর ওপারে জড়ো হচ্ছে। তারা বাঁচার জন্য আকুতি জানাচ্ছে এমন কয়েকটি ভিডিও এপারে তাদের আত্বীয় স্বজনের কাছে পাঠিয়েছে।

নাফ নদী পার হওয়ার জন্য নৌকা না থাকায় তারা বাংলাদেশে আসতে পারছেন না। এসব রোহিঙ্গার সাথে থাকা খাদ্যও শেষ হয়ে গেছে। অভুক্ত শিশুরা কাঁদছে। ৮/১০ দিন ধরে কারা চোখে ঘুম নেই। ক্লান্ত শরীর। চোখগুলো কোটরে ঢুকে গেছে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবারই একই অবস্থা।

এসব রোহিঙ্গা জানিয়েছে, তারা শেষ পর্যন্ত চেয়েছিলেন নিজ দেশে থেকে যেতে। অনেক দিন পালিয়েছিলেন আরাকানের পাহাড় ও ঝোপ জঙ্গলে। রাত কাটাচ্ছেন অনহারে-অর্ধাহারে।

এদিকে, শুক্রবার মধ্যরাতে বুচিডংয় টাউনশিপে রোহিঙ্গাদের অন্তত: ৩০টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে আগুন দিয়েছে সেনাবাহিনী। এছাড়া প্রাণহানির আশংকায় আশপাশ থেকে পালিয়ে যাওয়া রোহিঙ্গাদের বাড়িতে প্রতিদিনই আগুন দেয়া হচ্ছে। শুক্রবার মধ্যরাতে সীমান্ত শহর মংডু পৌরসভার সুধা গ্রামে আগুন দেয় সেনাবাহিনী। টেকনাফ পৌরএলাকা থেকে ওই আগুনের শিখা দেখেছেন সীমান্তের অধিবাসিরা। বৃহস্পতিবার নয়াপাড়া, পূর্ব পাড়া, পশ্চিম পাড়া , সুন্দরী পাড়া ও মাঙ্গালা পাড়ায় আগুন দেয় সেনা সদস্যরা।

এসময় শতাধিক রাখাইন মুসলিম বিরোধী শ্লোগান দিয়ে রোহিঙ্গাদের ধাওয়া করে। গোদাম পাড়া নামকস্থানে নাফ নদীর পাশে প্রায় ১০ হাজার রোহিঙ্গাকে কয়েকদিন ধরে ঘিরে রেখেছে সেনাবাহিনী। সেখানে কাপড় ও পলিথিন দিয়ে ছোট ছোট তাবু বানিয়ে তারা অবস্থান করছেন। সেনাবাহিনী তাদেরকে কোথাও যেতে দিচ্ছে না। তাদের কাছে থাকা মোবাইলও কেড়ে নিচ্ছে সেনারা। এসব রোহিঙ্গার খাদ্য ও পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে।

সেখানের এক রোহিঙ্গা শুক্রবার গোপনে তার আত্মীয়দের কাছে একটি ভিডিও পাঠিয়ে এ অবস্থার বর্ণনা দেন। এখন তাদেরকে নিয়ে সেনারা কি করবে তা নিয়ে তারা শংকিত হয়ে পড়েছেন।

অপরদিকে সীমান্তে স্থলমাইন পাতা, কাঁটাতারের বেড়া, বেড়ায় বিদ্যুৎ সংযোগের পর এবার সীমান্তের কাছে বাংকার খনন করছে মিয়ানমারের সেনারা। গত এক সপ্তাহ ধরে বাংকার খনন চলছে। সীমান্তের তুমব্রু থেকে লেবুছড়ি এলাকার বিপরীতে মিয়ানমারের ঢেকুবুনিয়া থেকে আমতলা পর্যন্ত দীর্ঘ ৭০ কিলোমিটার এলাকায় দুই শতাধিক শ্রমিক বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে একাজ করছে।

পাশাপাশি এসব শ্রমিকের নিরাপত্তার জন্য সীমান্তের জিরোপয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে মিয়ানমারের সেনারা। তারা তিন ভাগে ভাগ হয়ে ভারী অস্ত্র কাঁধে নিয়ে টহল দিচ্ছে। গত এক সপ্তাহ ধরে সীমান্ত এলাকার বাংলাদেশীরা এ ঘটনা প্রত্যক্ষ করে শংকিত হয়ে পড়ছেন।

ওপারের তুমব্রু সীমান্তের রোহিঙ্গারা জানান, ঢেকুবুনিয়া, পুরান মাইজ্জা, লম্বাবিল, সিকদারপাড়াসহ তাদের এলাকার সীমান্ত ঘেঁষা বিভিন্ন গ্রামে গত মঙ্গলবার থেকে বাংকার খনন করছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। এর আগে তারা নো-ম্যানস ল্যান্ডে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে স্থলমাইন পুতে রেখেছে।

গত কয়েক সপ্তাহে স্থলমাইন বিস্ফোরণে ১১ রোহিঙ্গা এবং শতাধিক প্রাণী মারা গেছে। সর্বশেষ মারা গেছেন মিয়ানমারের বলিবাজারের আবুল কাসিমের ছেলে নুরুচ্ছাফা (৩৪)। ৩ অক্টোবর সকাল ১০টায় সীমান্তের ৪৪ নম্বর পিলারের বিপরীতে মিয়ানমারে মাইন বিস্ফোরণে তিনি মারা যান।

গত শুক্রবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে নো-ম্যানস ল্যান্ডে মিয়ানমারের হেলিকপ্টার দেখেছেন সীমান্তে অবস্থানকারী লোকজন। তার এভাবে নিয়মিত টহল দেয়। মাঝে মাঝে গুলি ছোঁড়ে। বাংলাদেশ থেকেও গুলির শব্দ শোনা যায়।

তারা জানান, শুধু তমব্রু সীমান্ত নয়, বাংলাদেশের চাকমা পাড়া এবং বাইশারী সীমান্ত এলাকায়ও অবস্থান নিয়েছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী। তবে বাংলাদেশের সীমান্ত রক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিতে তারা দিনের বেশিরভাগ সময় ঘনজঙ্গলে অবস্থান করে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তমব্রু-চাকমা পাড়া এবং বাইশারী এলাকার জিরোপয়েন্ট বা নো-ম্যান্স ল্যান্ডে অন্তত ১৫ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।

নাইক্ষ্যংছড়ির ৩১ বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ারুল আজিম জানান, প্রত্যেক দেশ যার যার নিরাপত্তার জন্যে সবকিছু করবে। বাংকার খনন মানে এই নয় যে, তারা আমাদের সাথে যুদ্ধ করবে।

তিনি জানান, মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক নষ্ট হয়নি। কোনো অস্বাভাবিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হলে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমাধান করবে। বর্তমানে সীমান্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সীমান্তে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধির পাশাপাশি নজরদারি বাড়িয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি।

লে. কর্নেল মঞ্জুরুল হাসান খান বলেন, আমরা একে হুমকি মনে করছি না। অন্যদিকে আমাদের যা যা করা প্রয়োজন তা করছি।

Developed by: