ইয়ংবেঙ্গল মুভমেন্ট একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লব ।। ড. সফিউদ্দিন আহমদ

সফিউদ্দিন আহমদ মৌলিক গবেষক, শিকড়সন্ধানী লেখক, তথ্যনিষ্ঠ ও মননশীল প্রাবন্ধিক এবং একজন সম্মোহক শিক্ষক হিসেবে সুপরিচিত ও নন্দিত। তিনি বিশ্বসাহিত্যে অভিসঞ্চারী, তুলনামূলক সাহিত্যে বিশে−­ষক এবং সমাজমনস্ক ও প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনার ঋদ্ধ।
বৃহত্তর ঢাকার নরসিংদী জেলার রায়পুরায় ড. সফিউদ্দিন আহমদ- এর জন্ম ১৯ অক্টোবর, ১৯৪১ সালে। তাঁর বাবা কংগ্রেস নেতা মো. আব্দুছ ছামাদ মোল­−া ও মা সমাজ সেবায় নিবেদিতপ্রাণ দিলবরণ বেগম।
মৌলিক গবেষক ও লেখক হিসেবে সমধিক পরিচিত ড. সফিউদ্দিন আহমদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে বাংলায় অনার্স ও এমএ পাস করেন এবং পিএইচডি করেন।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ১২টি গবেষণাগ্রন্থসহ মোট ৭৫টি গ্রন্থের লেখক তিনি। তাঁর গবেষণাগ্রন্থ ‘বৃত্তাবদ্ধ রবীন্দ্রনাথ’, ‘ডিরোজিও জীবন ও সাহিত্য’ ‘ইয়ংবেঙ্গল মুভমেন্ট ও ডিরোজিও’, ‘প্রগতির পদাতিক’, মার্কসবাদী বিপ্ল−বী সাহিত্যিক সোমেনচন্দ্র’, ‘কোরানের প্রথম অনুবাদক ভাই গিরিশচন্দ্র সেন’, ‘ভাষার সংগ্রাম শিক্ষার সংগ্রাম’, ‘সক্রেটিসের জবানবন্দি’, ‘সক্রেটিসের শেষদিনগুলি’, ও ‘উনিশ শতকের রেনেসাঁ’, খুবই আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। বিশ্বসাহিত্যে তিনি যেমন একজন বিদগ্ধ পণ্ডিত তেমনি তাঁর চিন্তা-ভাবনাও বৈশ্বিক বলয়ে দ্যুতিমান।
উনিশ শতকের রেনেসাঁর গবেষণা ও বিশ্লে−ষণে তিনি সিদ্ধহস্ত।
ড. সফিউদ্দিন আহমদ একজন দক্ষ ও কৃতী অনুবাদক। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত প্লে−টোর মহৎ গ্রন্থ ‘ঞযব ষধংঃ ফধুং ড়ভ ঝড়পৎধঃবং’, ছাড়াও তাঁর টমাস পেইনের ‘অমব ড়ভ জবধংড়হ, জরমযঃং ড়ভ গধহ’. ডিরোজিও, বোদ্লেয়ার, র্যাঁবো, টি.এস এলিয়ট, পাবলো নেরুদার কবিতা ও ডি. এইচ লরেন্সের লেডিজ চ্যাটার্লিজ লাভার-এর অনুবাদ পণ্ডিতজনের প্রশংসা অর্জন করেছে। অতিথি অধ্যাপক হিসেবে তিনি অক্সফোর্ড, কেমব্রিজ, সাসেক্স, বার্মিংহাম, কভেন্ট্রি, কোলকাতা, যাদবপুর, কল্যাণী, বিশ্বভারতী ও ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েছেন।
লন্ডন অবস্থানকালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ঊপযড় ড়ভ ঊধংঃ শিরোনামে বক্তৃতা দিয়ে তিনি পণ্ডিতজনের শ্রদ্ধাস্মিত আকর্ষণ করেন।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জন হিউবার্ট বলেছেন, ‘ড. সফিউদ্দিন আহমদ লন্ডন এসেছেন আদর্শে ও মননে, চিন্তা-চেতনা ও দর্শনে, স্বকীয়তা ও ব্যক্তিত্বে নিজ দেশের মাটির গন্ধ নিয়ে। পোশাকে ও চলনে এবং ঐতিহ্যবোধ ও স্বাতন্ত্র্যবোধ অর্জন করা সহজ নয়। অন্য দেশ থেকে এমন আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের অধিকারী মানুষ আমাদের দেশে খুবই কম আসে।’
অধ্যাপক মেলকম স্মিথ বলেছেন, ‘ড. সফিউদ্দিন আহমদ তার ভাষণে দ্ব›দ্ব-সংঘাতময় যুদ্ধ বিধ্বস্ত ও রক্তক্ষরিত বিশ্বে প্রেম, ভালোবাসা, মানবতা ও বিশ্বশান্তির মঙ্গলদীপ জ্বেলে দিয়ে গেছেন। মনে হচ্ছে বিশ্বশান্তি ও মানবতাবাদী দর্শনের তিনি একজন পুরোহিত।’
ড. সফিউদ্দিন আহমদের লেখায় যেমন রয়েছে ধর্মান্ধতা ও আচারের আগল ভাঙার ইঙ্গিত, তেমনি রয়েছে মুক্তবুদ্ধি, যুক্তিবাদ ও বৈশ্বিক ভাবনা এবং বিজ্ঞান মনস্কতা ও সমাজের পরিবর্তনের অঙ্গীকার। দেশ ও বিদেশের পণ্ডিতেরা তাঁর সাহিত্য গবেষণায় বিমুগ্ধ।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সুরেশচন্দ্র মৈত্র বলেছেন, ‘লিখতে গিয়ে তুমি বেড়াজাল দিয়ে যেন সবকিছুকে টেনে নিয়ে এসো। অন্যের লেখার সাথে তুলনা করে সবসময় তুমি তোমার বক্তব্য উপস্থাপন করো। তোমার লেখা পড়ে অনেক লেখা ও অনেক বই পড়া হয়ে যায়।’
দার্শনিক সর্দার ফজলুল করিম বলেছেন, ‘আপনার গবেষণামূলক লেখাগুলোতে থাকে একটা বিস্তৃত পটভূমি। তাছাড়াও অনেক তথ্য ও উপকরণ থাকে। অনেক দুর্লভ গ্রন্থের আকরও আপনি তুলে ধরেন। যারা গবেষণা করবেন ও তথ্য খুঁজবেন তারা আপনার বই পড়ে উপকৃত হবেন।’
পাশ্চাত্য জ্ঞান, বিজ্ঞান, জীব বিজ্ঞান ও জীবন মহিমায় বিমুগ্ধ ড. সফিউদ্দিন আহমদ বলেন, আমাদের দৃষ্টি থাকবে আকাশে কিন্তু পা থাকবে দেশের মাটিতে। স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যে আমরা সমুজ্জ্বল। আমরা পাশ্চাত্যের কণ্ঠস্বর বা প্রতিধ্বনি নই।
প্রথম জীবনে তিনি প্রচুর কবিতা ও গল্প লিখেছেন। তাঁর গল্প ‘মানুষ গড়ার কারিগর’, ‘ডাকপিয়ন’, ‘ঘুম ভেঙে গেছে’, ইবনিত কুদ্রত কর্তৃক রুশ ভাষায় এবং সিঁড়ি, উত্তর ও উত্তরণ ও মেরুদণ্ড জাঁ মিরিয়াম ও নোয়েল গার্নিয়ে কর্তৃক ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।
শাহ্জালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন অবস্থায় ২০০৫ সালে অবসর গ্রহণ করেন। গভীর পড়াশুনা, জ্ঞান, মনীষা, পাণ্ডিত্য, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্ব, মুক্তবুদ্ধি, গ্রগতিশীল চিন্তা- চেতনা ও আত্মপ্রত্যয়ে তিনি ঋদ্ধ। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি বিনয়ী, অমায়িক ও সুসংস্কৃত মন-মানসিকতার অধিকারী ও লোকপ্রিয়। তরুণদের কাছে টানার ও আকর্ষণ করার তার একটি সম্মোহক শক্তি আছে। সাহিত্যের আড্ডা ও বৈঠকে তিনি প্রাণখোলা এবং সদাহাস্য ও উচ্চকণ্ঠ।

Developed by: