কেরালার চেরামন জুমা মসজিদ হচ্ছে ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ

সপ্তম শতাব্দির প্রথম ভাগে আরবে  ইসলামের অভ্যুদয়ের  কিছুকাল পরে  ভারতের কেরালা রাজ্যের ত্রিশুর জেলার কদুঙ্গালুর তালুকের ( সাব-ডিস্ট্রিক্ট) মেথালায় ভারতবর্ষের প্রথম মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয় । সুদূর অতীতে  চেরা রাজারা  কেরালা অঞ্চল শাসন করতেন । চেরামন পেরুমল রাম ভর্মা কুলশেখর   ছিলেন  এই বংশের একজন  রাজা । একসময় তিনি তার রাজ্য তিনভাগ করে  বংশের লোকেদের মধ্যে বন্টন ক’রে নিজে নিরুদ্দেশ হয়ে যান । কিংবদন্তী  আছে  যে,  তিনি রাজ্যের শাসন-ক্ষমতা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে  মক্কা-মদিনায় গমন করেন এবং  ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন ।  সত্যিকার ইতিহাস নানা লেজুড় লেগে একসময় কিংবদন্তী হয়ে যায়। রাজা চেরামন পেরুমলের অন্তর্ধানের বিষয়টি  এরকম একটা কিংবদন্তীর  বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে আটকে  রয়েছে ।  কিন্তু  কিংবদন্তীর ভেতর থেকে ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলি সত্যের উপরে আলো ফেলে  এবং  ইতিহাসকে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করে ।   চেরামন  জুমা  মসজিদটি সেরকম একটি স্থাপনা হয়ে রাজার অন্তর্ধান  কাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করেছে  ।

লোককাহিনী   এমন যে,  একদিন চেরামন পেরুমল রাম ভর্মা কুলশেখর  আধ্যাত্মিকভাবে আলোকিত হয়ে জীবন , অতিপ্রাকৃতিক ঘটনা  এবং পরকালের  রহস্য উৎঘাটনে  ব্যস্ত  হয়ে পড়েন । তখন মালাবার উপকূলে মদিনা  থেকে একদল আরবীয় মুসলামানদের আগমান ঘটে  ।

সেই দলে অন্তর্ভূক্ত  একজন জ্ঞানী ব্যাক্তি শেখ শাহিরুদ্দিন বিন বাকিউদ্দিন আল-মাদানির  সাথে কথা বলে রাজা জানতে  পারেন যে, আরবে একজন মহা-মানবের আভির্ভাব হয়েছে ।  ২০১২ সালের ৯ সেপ্টম্বরের ‘আরব নিউজ’ পত্রিকায়  জনৈক আলী আকবর কর্তৃক প্রকাশিত  এক প্রবন্ধে  এম হামিদুল্লাহ রচিত ‘মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ’ পুস্তকের বরাত দিয়ে বলা হয় যে ,  রাজা পূর্বোক্ত  মুসলিম দলের সাথে মদিনা নগরীতে গিয়ে রাসুল (সা) এর  হাতে হাত রেখে ইসলাম কবুল করেন এবং তাজুদ্দিন নাম গ্রহণ করেন । প্রথম সাক্ষাতের দিন তিনি  নবিজীকে ভারতের আদা  উপহার দিয়েছিলেন ।  আহমেদ  জৈনুদ্দিন মাখতুমের লিখিত   ‘ তুফাতুল মুজাহিদিন ’ গ্রন্থে  প্রদত্ত তথ্যের সাথে ‘আরব নিউজে’ প্রকাশিত প্রবন্ধের  তথ্যের মিল রয়েছে । এছাড়া কেরালার  ব্রাহ্মণ পণ্ডিতদের রচিত ‘কেরালোপাটি’  গ্রন্থে এই ঘটনার স্বীকৃতি পাওয়া যায় ।

লোক-কাহিনীর ধারাবাহিকতায় বলা হয় যে , চেরামন পেরুমল ওরফে  তাজুদ্দিন কিছুদিন মদিনায় অবস্থানের পর কয়েকজন আরব ধর্ম-প্রচারকসহ দেশে  ফেরার জন্য রওনা হন । তারপর  ওমানে এসে  তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং মৃত্যুবরণ করেন।  তার আগে তিনি  ভ্রমণসঙ্গী  মহানবি (সা) এর  সাহাবি হযরত মালিক বিন দিনারের মাধ্যমে   উত্তরসূরিদের উদ্দেশে  একটা পত্র  লিখে যান । পত্রটিতে   লেখা হয়েছিল যে ,   মসজিদ নির্মাণের  জন্য  মালিক বিন দিনারকে পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া হয় যেন  । সেই সূত্র ধরে   ৬২৯ সালে কেরালার  কদুঙ্গালুর  এলাকায় ভারত উপমহাদেশের প্রথম মসজিদ হিসেবে চেরামন জুম্মা  মসজিদ নির্মিত হয় ।   ওই সময়ে কেরালার বিভিন্ন স্থানে  আরও অনেকগুলি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল বলে ‘আরব নিউজে’ উল্লেখ করা হয়েছে । উল্লেখ্য যে মালিক বিন দিনার কর্নাটকের বাটকলে মৃত্যুবরণ করেন ।

ষষ্ঠদশ শতকের শুরু  থেকে ইউরোপের নব্য বণিক-সম্প্রদায়ের  কোম্পানিগুলি ভারতে আসতে  শুরু করে । পর্তুগীজ বণিক ভাস্কো দা গামা  ১৪৯৮ সালে আফ্রিকার উত্তম আশা অন্তরিপ  হয়ে বহু পথ ঘুরে ভারতের মালাবার উপকূল তথা কেরালা রাজ্যের কলিকট বা কোহিকোড বন্দরে উপনীত হন। ভাস্কো দা গামা যখন ভারতে আসেন তখন কেরালার কলিকট অঞ্চল  ছিল সামুথ্রি রাজবংশ দ্বারা শাসিত একটি রাজ্য । সামুথ্রি বংশ ক্ষমতা পেয়েছিল  চেরা রাজবংশের  কাছ থেকে।   সামুথ্রি  রাজারা প্রথমে মহিশূর-রাজ  হায়দার আলির কাছে এবং  তারপর  মরাঠা শক্তির কাছে পদানত হন  ।  শেষবার ইংরেজ শক্তির কাছে রাজ্য হারিয়ে সামুথ্রিরা ১৮০৬ সালে ভাতাভোগী রাজায় পরিণত হন। আধুনিককালের এই বাণিজ্য-ইতিহাসের পেছনে মালাবার এলাকার একটি পুরোনো ইতিহাস আছে । ভারতে আসার সমুদ্রপথ আবিষ্কারের মাধ্যমে ইউরোপীয় জনগোষ্ঠীর সাথে  ভারতের  সখ্য গড়ে ওঠার বহু আগে   আরব সাগর ও পারস্য উপসাগরের  সন্নিহিত মালাবার উপকূল  আরব বণিকদের কাছে  পরিচিত ছিল । দক্ষিণ ভারতের সাথে আরব ব্যবসায়ীদের ছিল মশলা আদান-প্রদানের ব্যবসা ।  চেরামন পেরুমল জুমা   মসজিদটি  সেই  অতীত ইতিহাসের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে ঘটনার পরম্পারা রক্ষা করে চলেছে  ।

পর্তুগীজ লেখক দুয়ার্তে বারবোসা এবং  জোস ডি ব্যারোস প্রমুখ ব্যক্তির   লেখা ইতিহাস থেকে   চেরামন পেরুমল সম্পর্কে অনেক কিছু জানা যায় । তাদের   মতে পর্তুগীজরা   কেরালায় আসার ৬০০ বৎসর পূর্বে চেরামন দেশান্তর হয়েছিলেন । সেই হিসেবে রাজার  অন্তর্ধানের সময় নবম-দশম শতকের মধ্যে পড়ে ।  পর্তুগীজ লেখক  দিয়াগো ডি কুটস দাবি করেন , রাজা মুসলমান নয়, খৃষ্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তবে পর্তুগীজদের আসার আগে ভারতের দক্ষিণ এলাকায় মুসলিম ছাড়া একেশ্বরবাদী অন্য  কোন ধর্মের মানুষের আগমন  এবং অবস্থানের  কোনো গ্রহণযোগ্য তথ্য  নেই বিধায়   রাজার খৃষ্টধর্ম গ্রহণের কাহিনী নিজেদের ধর্মের প্রতি আনুগত্য থেকে সৃষ্ট বলে  সহজেই অনুমান করা যায় ।  অন্যদিকে   ভারতীয় কোনো কোনো  ঐতিহাসিকের মতে   চেরামন পেরুমল একজন  প্রাচীন আমলের রাজা ছিলেন সত্য , তবে  তার সময়ে  আরবে ইসলাম ধর্মই  কায়েম হয়নি । যে চেরামন পেরুমাল ওরফে তাজুদ্দিনকে নিয়ে কিংবদন্তী,  তিনি তাদের মতে  চেরা রাজার একজন  গভর্নর ছিলেন এবং ঘটনাটি দ্বাদশ শতকের প্রথমার্ধে সংঘটিত হয়েছিল । এস এন সদাশিভনের  মতে কিংবদন্তি বা লোককথার যে রাজা মক্কায় গিয়েছিলেন তিনি মালাবার এলাকার  রাজা নন , তিনি মালদ্বিপের রাজা ছিলেন । মালে এবং মালাবার শব্দ দুটির মধ্যে  ভুলবোঝাবুঝির কারণে এটা হয়ে থাকতে পারে  বলে তার অভিমত ।

ঐতিহাসিক এম জি নারায়ণন বলেছেন , “ There is no reason to reject the tradition that the last Chera king embraced Islam and went to Mecca , since it finds its place not only in Muslim chronicles , but also in Hindu Brahminical chronicles like the keralolpatti ,  which need not be expected to concoct such a tale which in no way enhances the prestige of the Brahmins or Hindu population .”  কেরালোপাটি  গ্রন্থে  চেরামন পেরুমালের মুসলিম হওয়ার এবং মদিনায়  গমনের কথা স্বীকার করা হয়েছে  । এম জি নারায়ণনের কথাকে সমর্থন দেয়   ১৮৮৭ সালে মালাবারের কালেক্টর হিসেবে দায়িত্বপালনকারী   উইলিয়াম লোগানের বক্তব্য । উইলিয়াম লোগান Malabar Manual এ উল্লেখ করেছেন  যে,  তার কাছে  ওমানের  এক প্রতিনিধি এসেছিলেন আর্থিক  সাহায্যের আশায়  ।  সেই ব্যক্তি তাকে  বলেছিলেন যে , অতীতে  মালাবার   এলাকার এক রাজা ওমানে মৃত্যুবরণ করলে  তাকে সেখানে দাফন করা হয়েছিল আর  তার সেই  কবরটি ভগ্নদশায় নিপতিত  বিধায়  সংস্কারের জন্য অর্থ  দরকার ।  এলাকার কালেক্টর হিসেবে সাহায্যের জন্য তাকে অনুরোধ করা হয়  । ব্রিটিশ এই সিভিল সার্ভেন্ট  লিখেছেন যে , কেরালার জনশ্রুতিমতে , হারিয়ে যাওয়া চেরামন পেরুমলই হচ্ছেন ওমানের ‘সালালাহ’ নামক  এলাকায় দাফনকৃত সেই ব্যক্তি ।

ব্যবসায়িক কারণে পর্তুগীজদের সাথে আরব মুসলিমদের একটা প্রতিযোগিতা চলে আসছিল । কলিকটের সামুথ্রি   রাজার সাথে পর্তুগীজদের যে যুদ্ধ হয় , তাতে ‘ম্যাপিলা’ গোত্রের মুসলিম সৈন্যেরা রাজার পক্ষে  নৌ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে  যুদ্ধ করেছিল  ।  নৌ-সেনা প্রধানকে বলা হতো কুঞ্জালি মারাকার । ইতিহাসে এরকম কয়েকজন কুঞ্জালি মারাকারের কথা আছে ।  পর্তুগীজদের বিপক্ষে আরব এলাকার বংশোদ্ভূত মুসলিম উত্তরসূরি-জনগোষ্ঠীর ব্যাপক অবদানের জন্য সামুথ্রি রাজা-শাসিত মালাবার এলাকায় মুসলামান জনগোষ্ঠীর প্রতি স্থানীয় জনসাধারণ বন্ধুভাবাপন্ন ছিল । অন্যদিকে পর্তুগীজদের প্রতি তারা ছিল বিরূপ । এই আর্থ-সামাজিক বৈরিতার কারণে  ইসলামের পক্ষে যায় , এমন তথ্য পর্তুগীজ লেখকেরা  গোপন করেছেন  বলে বুঝা যায়  । অন্যদিকে  কেরালার হিন্দু-মুসলমান সবাই চেরামন পেরুমলের কাহিনীকে ধর্মীয় গাম্ভির্যের সাথে বিশ্বাস করে । হিন্দু-মুসলিম মিলেমিশে  সেখানে কিছু অনুষ্ঠান পালনের ঐতিহ্য  যুগ যুগ ধরে চলে আসছে । তাই কেরালার শেষ চেরা-রাজা চেরামন পেরুমল রাম ভর্মা কুলশেখরের   ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও তার অনুরোধে মসজিদ নির্মিত হওয়ার  পক্ষে  বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবার  কোনো কারণ নেই । ঐতিহাসিক সত্য বিকৃত হয় যেসব কারণে , তার মধ্যে প্রধান হচ্ছে — ধর্মীয় পক্ষপাত, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দ্বারা তথ্য-বিকৃতি , কাল্পনিক  সাহিত্যের প্রভাব, প্রত্নসম্পদ বিনষ্ট হওয়া  এবং  যুদ্ধের  মাধ্যমে জনজীবন বিলুপ্ত হওয়া ,  ইত্যাদি। কিন্তু  যে-সব প্রাচীন লোককথা এবং ঐতিহাসিক রেকর্ডের অস্তিত্ব পাওয়া যায় , তা সবই কেরালায় মুসলিম শাসনবহির্ভূত সময়ে সৃষ্ট । যেসব ভারতীয় ঐতিহাসিক চেরা রাজার ধর্মান্তর সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করে স্থানীয় গভর্নরের ধর্মান্তরের কথা বলেছেন , তাদের বক্তব্য দ্বারা মসজিদ নির্মিত হওয়ার ঘটনা নাকচ হয় না ।   এসব বিষয় বিবেচনা করলে মালাবার উপকূলে  ১১২৪ সালে পুনর্নির্মিত  চেরামন জুমা মসজিদটি  সপ্তম শতকে নির্মিত এবং এই উপ-মহাদেশের প্রথম মসজিদ  এ বিষয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না  । মসজিদের পুনর্নিমাণ-স্মৃতিফলকে সেই  নির্মাণ-কালের  উদ্ধৃতি রয়েছে।

Developed by: