প্রাণ গেল ৫২ জনের, নিখোঁজ ৭০
- ৪৯ জনের লাশ পুড়ে কয়লা
- শ্রমিকদের বিক্ষোভ, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ
- সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি
মীর আব্দুল আলীম, রূপগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ॥ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড নামে একটি কারখানায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ের ঘটনায় আরও ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়াল ৫২ জনে। শুক্রবার বিকেল ৩ টার দিকে হাসেম ফুড কারখানাটির চতুর্থ তলা থেকে ৪৯ টি মরদেহ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ৬ তলা ভবনটির চতুর্থ তলা পর্যন্ত আগুন নেভানো হয়েছে। কিন্তু গভীর রাতেও পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলার আগুন নির্বাপণের কাজ চলছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে। আগুন নির্বাপণের পর প্রকৃত হতাহতের মোট সংখ্যা জানা যাবে। এ ঘটনায় ৫২ জন মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেলেও এখনও ৭০ জনের বেশি নিখোঁজ রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক অপারেশন অফিসার জিল্লুর রহমান সাংবাদিকদের লাশ উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ফায়ার সার্ভিসের সিভিল ডিভিশনের উপপরিচালক দেবাশীষ বর্মণ ফায়ার জানিয়েছেন, উদ্ধার হওয়া ৪৯ জনের লাশ পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। তাদের চেনার কোনই উপায় নেই। স্বজনরা চাইলেও লাশ দেখে শনাক্ত করতে পারবেন না। ডিএনএ টেস্ট ছাড়া লাশ শনাক্ত করা সম্ভব হবে না। এর আগে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় দুই নারী- স্বপ্না রানী ও মিনা আক্তার নিহত হন। পরে রাত ১১ টার দিকে মোরসালিন (২৮) নামে আরও এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্তত ৫০ জন আহত হয়েছে।
ঘটনার পর থেকেই নিহতের স্বজনরা কারখানার চারপাশে ভিড় জমিয়েছে। স্বজনদের আহাজারিতে কারখানার আশপাশের পরিবেশ ভারি হয়ে গেছে। এদিকে আগুন নেভাতে দেরি হওয়ায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বিক্ষোভ মিছিল ও ভাংচুর চালায়। এসময় পুলিশের সঙ্গে তাদের ধাওয়া, পাল্টাধাওয়ার ঘটনা ঘটে। তারা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে হামলা চালিয়ে আনসারদের মারধর করে অস্ত্রাগার থেকে তিনটি শটগান লুট করে নিয়ে যায় বলে জানান উপজেলা আনসারদের ইনচার্জ নাছিমা বেগম।
স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, উপজেলার কর্ণগোপ এলাকার সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানায় প্রায় ৭ হাজার শ্রমিক, কর্মচারী কাজ করেন। ছয় তলা ভবনে থাকা কারখানাটির নিচ তলার একটি ফ্লোরে কার্টন এবং পলিথিন তৈরির কাজ চলে। সেখান থেকেই হঠাৎ করে আগুনের সূত্রপাত। এসময় আগুনের লেলিহান শিখা বাড়তে শুরু করে। এক পর্যায়ে আগুন পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। কালো ধোঁয়ায় কারখানাটি অন্ধকার হয়ে যায়। এক পর্যায়ে শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে শুরু করেন। কেউ কেউ ভবনের ছাদে অবস্থান নেন। তবে চার তলায় থাকা প্রায় ৭০-৮০ শ্রমিক কাজ করেন। অগ্নিকান্ডের খবর পেয়ে চার তলার শ্রমিকরা ছোটাছুটি করতে থাকলে ওই তলার দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তারক্ষী কেচি গেটে তালা দিয়ে রাখেন। আগুন নিভে যাবে বলে তালা দিয়ে শ্রমিকদের ওই তলাতেই বসিয়ে রাখেন। অগ্নিকান্ডের ঘটনায় অন্যান্য তলার শ্রমিকরা অনেকে বের হতে পারলেও চার তলার শ্রমিকরা বের হতে পারেননি। আগুনের খবর পেয়ে কেউ কেউ ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে শুরু করে। নিহতের কেউ কেউ মোবাইল ফোনে স্বজনদের সঙ্গে শেষ কথা বলেছেন। এর আগে গত বৃহস্পতিবার বিকেলে আগুন থেকে বাঁচতে রানী, মিনা আক্তার ও মোরসালিন হক ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে নিহত হন। এছাড়া এ ঘটনায় প্রায় অর্ধশতাধিক শ্রমিক আহত হন। এদের মধ্যে ১০ জনকে গুরুতর অবস্থায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ও বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শুক্রবার সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসেন ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি হাবিবুর রহমান, জেলা প্রশাসক মোস্তাইন বিল্লাহ, পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম, উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) শাহ নূসরাত জাহান, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আতিকুল ইসলাম। এদিকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা আগুন নেভাতে ব্যর্থ হলে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা রাস্তায় বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে রূপগঞ্জ থানা পুলিশ ও আঞ্চলিক পুলিশের সদস্যদের সঙ্গে শ্রমিকদের ধাওয়া, পাল্টাধাওয়া, ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। তারা কারখানা ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে চলাচলরত গাড়িসহ মোট অর্ধশতাধিক গাড়ি, মোটরসাইকেল ভাংচুর করে। সজীব গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান হাসেম ফুড লিমিটেডে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা হাসেম ফুডের আনসার ক্যাম্পে প্রবেশ করে ব্যাপক ভাংচুর চালায়। এসময় শ্রমিকরা ক্যাম্পের অস্ত্র সংরক্ষণাগারের তালা ভেঙ্গে তিনটি শটগান লুট করে নেয়। শ্রমিকদের হামলায় কাউসার, বিশ্বজিত, ফারুক, মোশরাকুলসহ প্রায় ৫ আনসার সদস্য আহত হয়।
শ্রমিক ও নিহতের স্বজনরা অভিযোগ করে বলেন, হাসেম ফুড কারখানাটি অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলত। কারখানাটিতে অগ্নি নির্বাপণের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া বেশিরভাগই শিশুশ্রমিক কাজ করত। এছাড়া কারখানাটি অতিরিক্ত খাদ্যপণ্যে অতিরিক্ত কেমিক্যাল ব্যবহার করত। এ কারণেই অতিরিক্ত কেমিক্যালের কারণে আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাদের এত দেরি হয়। এছাড়া কারখানার ভবন থেকে বের হতে শ্রমিকদের জন্য কোন ইমারজেন্সি এক্সিটের ব্যবস্থা রাখা হয়নি। এছাড়া নিহত শ্রমিকদের বেশিরভাগই শিশু।
১২ বছর বয়সী শিশুশ্রমিক বিশাখা রানী ক্ষোভের সুরে বলেন, বাবা-মাসহ আমাদের ৫ বোনের সংসার। বেতন-ভাতা ও ওভারটাইম না পাওয়ায় আমরা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম। এ কারণে আমরা শ্রমিকরা বেতন-ভাতার দাবিতে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল করি। আর এ ক্ষোভেই কারখানার মালিকপক্ষ এই ভবনে আগুন লাগিয়ে আমার মা সপ্না রানীসহ অন্যান্য শ্রমিককে হত্যা করে। আমরা এ হত্যার বিচার চাই।
নিখোঁজ শ্রমিক তাছলিমা আক্তারের বাবা আক্তার হোসেন বলেন, মালিকপক্ষের দোষেই কারখানায় আগুন লাগে। এছাড়া মালিকপক্ষ শ্রমিকদের চার তলায় আটকে রেখে হত্যা করে। আমরা এ নির্মম হত্যাকান্ডের বিচার চাই।
নিখোঁজ শ্রমিক ওমৃতা রানীর (১৭) বোন রোজিনা আক্তার জানান, তার বোন ওমৃতা আক্তার চার তলায় কাজ করছিল। ওমৃতা রানী বলছিল মালিকপক্ষ তাদের আটকে রেখে জোর করে ১২ ঘণ্টা ডিউটি করাতেন। ঘটনার দিনও তারা কেচিগেট তালা দিয়ে রাখায় চার তলার কোন শ্রমিক বের হতে পারেনি। হাসেম ফুড লিমিটেড কারখানাটির যে ভবনটিতে আগুন লেগেছে সে ভবনটি বিল্ডিং কোড না মেনে করা হয়েছে। অব্যবস্থাপনার মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালনা করায় এ অগ্নিকা-ের সূত্রপাত।
কারখানার অন্যান্য শ্রমিক আরও অভিযোগ করে বলেন, কারখানা কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের বেতন-ভাতা ঠিকমতো পরিশোধ করেন না। শ্রমিকরা বেতন চাইলে মালিকপক্ষ তাদের মারধরসহ চাকরিচ্যুত করার হুমকিধমকি প্রদান করেন। কারখানাটিতে দুটি গেট থাকলেও একটি গেট কারখানা কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে রাখে। কোন দুর্ঘটনা হলে শ্রমিকরা দ্রুতগতিতে বের হতে গেলেও শ্রমিকদের পদদলিত হওয়ার শঙ্কা থাকে।