মহীয়ান গরীয়ান সর্বশক্তিমান আল্লাহর জন্য সকল প্রশংসা। যিনি বাছাই করে করে পূর্ববর্তী নবী ও প্রিয় বান্দাদের মকবুল ইবাদতগুলো উম্মতে মুহাম্মদীকে দান করেছেন। শত কোটি দরূদ ও সালাম তাঁর পেয়ারা হাবীব হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.) প্রতি। যাকে সৃষ্টি না করলে কোন কিছুই সৃষ্টি হত না।
কুরবানির ইতিকথা : আদি পিতা হযরত আদম (আ.)-এর দুই পুত্র কাবীল ও হাবীলের দেওয়া কুরবানী থেকেই কুরবানীর ইতিহাসের গোড়াপত্তন হয়েছে। তারপর থেকে বিগত সকল উম্মতের উপর এটা জারী ছিল। আমাদের উপর যে কুরবানীর নিয়ম নির্ধারিত হয়েছে, তা মূলত ইবরাহীম (আ.) কর্তৃক শিশু পুত্র ইসমাঈল (আ.)-কে আল্লাহর রাহে কুরবানী দেওয়ার অনুসরণে ‘সুন্নাতে ইবরাহীমী’ হিসাবে চালু হয়েছে। মক্কা নগরীর জনমানবহীন ‘মিনা’ প্রান্তরে আল্লাহর দুই আত্মনিবেদিত বান্দা ইবরাহীম ও ইসমাঈল (আ.) আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের মাধ্যমে যে নজিরবিহীন ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন যুগ পরম্পরায় তারই স্মৃতিচারণ হচ্ছে ‘ঈদুল আদ্বহা’ বা কুরবানীর ঈদ। পবিত্র কুরআনে কুরবানীর বদলে ‘কুরবান’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে। হাদীসেও ‘কুরবানী’ শব্দটি ব্যবহৃত না হয়ে এর পরিবর্তে ‘উদ্বহিয়্যা’ ও ‘আদ্বাহ্যি’ প্রভৃতি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। আর এজন্যই কুরবানীর ঈদকে ‘ঈদুল আদ্বহা’ বলা হয়। আরবী ‘কুরবান’ শব্দটি ফারসী বা উর্দূতে ‘কুরবানী’ রূপে পরিচিত হয়েছে, যার অর্থ ‘নৈকট্য’। আর পারিভাষিক অর্থে ‘কুরবানী’ ঐ মাধ্যমকে বলা হয়, যার দ্বারা আল্লাহর নৈকট্য হাছিল হয়। প্রচলিত অর্থে ঈদুল আদ্বহার দিন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে শারয়ী তরীকায় যে পশু যবেহ করা হয়, তাকে ‘কুরবানী’ বলা হয়। কুরবানী নিছক কোন প্রথা নয় বরং এটি মুসলমানদের একটি ইবাদাত। যিলহজ্জ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে এই ইবাদত পালন করতে হয়।
কুরবানীর গুরুত্ব : ঈদুল আযহার গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন-হাদীসে এ ব্যাপারে যথেষ্ট তাকীদ দেওয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ বলেন-‘কুরবানীর পশুসমূহকে আমি তোমাদের জন্য আমার নিদর্শনসমূহের অন্তর্ভুক্ত করেছি। এর মধ্যে তোমাদের জন্য রয়েছে কল্যাণ’। (সূরা হজ্জ-৩৬)
আল্লাহ তা’য়ালা আরও বলেন, ‘আর আমি তাঁর (ইসমাঈলের) পরিবর্তে যবেহ করার জন্য দিলাম একটি মহান কুরবানী। আমি এটিকে পরবর্তীদের মধ্যে রেখে দিলাম’। (সূরা ছাফফাত-১০৭, ১০৮)। আল্লাহ পাক অন্যত্র বলেন, ‘তুমি তোমার প্রতিপালকের উদ্দেশ্যে ছালাত আদায় কর এবং কুরবানী কর।’ (সূরা কাওছার-২)
আমাদের প্রিয় নবী মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও যে ব্যক্তি কুরবানী করল না, সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটবর্তী না হয়।’ (ইবনে মাজা-৩১২৩)
আম্মাজান আয়শা সিদ্দীকা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কুরবানীর দিন মানুষ যে কাজ করে তার মধ্যে আল্লাহ্ তা’আলার নিকট সব চাইতে পছন্দনীয় হচ্ছে রক্ত প্রবাহিত করা (কুরবানী করা)। কিয়ামতের দিন তা নিজের শিং, পশম ও ক্ষুরসহ হাজির হবে। তার (কুরবানীর পশুর) রক্ত জমিনে পড়ার আগেই আল্লাহ্ তা’আলার নিকটে এক বিশেষ মর্যাদায় পৌঁছে যায়। অতএব তোমরা আনন্দিত মনে কুরবানী কর।’ (ইবনু মাজাহ-৩১২৬)
এক বর্ণনায় আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কুরবানীকারীর জন্য প্রতিটি লোমের বিনিময়ে সাওয়াব আছে। অপর এক বর্ণনায় আছে প্রতিটি শিং-এর বিনিময়ে।’ (তিরমিজি-১৪৯৩)
এটি ইসলামের একটি ‘মহান নিদর্শন’ যা ‘সুন্নাতে ইবরাহীম’ হিসেবে রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে মদিনায় প্রতি বছর আদায় করেছেন এবং সাহাবীগণও নিয়মিতভাবে কুরবানী করেছেন। অতঃপর অবিরত ধারায় মুসলিম উম্মাহ্ সামর্থ্যবানদের মধ্যে এটি চালু আছে। এটি কিতাব ও সুন্নাহ এবং ইজমায়ে উম্মত দ্বারা সুপ্রমাণিত।
ঈদুল আদ্বহায় করনীয় : ঈদের রাত সম্পর্কে হাদিসে আছে, ‘যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আদ্বহার রাতে জাগরিত থেকে আল্লাহর ইবাদত-বন্দেগীতে মশগুল থাকবে, তার বদলে যেদিন অন্যান্য দিল মরে যাবে সেদিন তার দিল মরবে না অর্থ্যাৎ, কিয়ামতের দিনের আতঙ্কের কারণে অন্যান্য লোকের অন্তর ঘাবড়ে গিয়ে মৃতপ্রায় হয়ে যাবে, কিন্তু দুই ঈদের রাত্রে জাগরণকারীর অন্তর তখন ঠিক থাকবে ঘাবড়াবে না। (তাবারানী)
ঈদের দিনগুলো অর্থাৎ দুই ঈদ ও ঈদুল আদ্বহার পরের তিন দিন সহ মোট পাঁচ দিন রোজা রাখা হারাম। এই পাঁচ দিন পানাহারের মধ্যে কিছু বেশি জাঁকজমক করার সাধ্যানুযায়ী অবকাশ আছে এবং তা শরীয়তের কাম্য।
ঈদ-উল-আদ্বহার সুন্নাহসমূহ : *সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়া। *মেসওয়াক করা। *গোসল করা। *যথাসাধ্য উত্তম পোষাক পরিধান করা। *শরী’আত সম্মতভাবে সাজ-সজ্জা করা। *সুগন্ধি বা খুশবু লাগানো। *ঈদগাহে যাবার আগে কিছু না খাওয়া। *আগে আগে ঈদগাহে যাওয়া। *ঈদগাহেই ঈদের সালাত আদায় করা। *পায়ে হেটে ঈদগাহে যাওয়া। *যাবার সময় তাকবীর জোরে জোরে বলতে বলতে যাওয়া। তাকবীরটি হচ্ছে এই-‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা-ইলাহা ইল্লালাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ।’ *এক রাস্তা দিয়ে ঈদগাহে যাওয়া, অন্য রাস্তা দিয়ে প্রত্যাবর্তন করা। *ঈদুল ফিতরের তুলনায় ঈদুল আদ্বহার সালাত সকাল সকাল আদায় করা।
কুরবানীর পশু জবাহ করা প্রসঙ্গে : *নিজ পশু নিজেই জবেহ করা উত্তম। না পারলে জবেহের সময় সামনে থাকা। *পশুকে কিবলামুখী করে শুইয়ে জবেহ করা, জবাইকারীও কিবলাহমুখী হওয়া। *ধারালো ছুরি দ্বারা জবাই করা। *জবাই করার পর পশুটি সম্পুর্ণ নিস্তেজ হওয়ার পর বাকী কাজ শুরু করা, আগে না। *জবাই করার পূর্বে বেশি পরিমাণে পানি খাওয়ানো উচিত, প্রাণীকে ক্ষুধার্থ রাখা জুলুম। *ঈদের নামাজের পরে কোরবানী করা। *গোশত দিয়ে কোন পারিশ্রমিক দেয়া যায়েজ নেই। *গোশত তিন ভাগ করে- নিজে, আত্মীয়-স্বজন এবং গরিব-মিসকীনদের দেয়া উত্তম।
কুরবানী সংক্রান্ত কিছু মাসায়েল :
১. কার উপর কুরবানী ওয়াজিব : প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক সম্পন্ন প্রত্যেক মুসলিম নর-নারী, যে ১০ যিলহজ্ব ফজর থেকে ১২ যিলহজ্ব সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রয়োজনের অতিরিক্ত নেসাব পরিমাণ সম্পদের মালিক হবে তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব। টাকা-পয়সা, সোনা-রূপা, অলঙ্কার, বসবাস ও খোরাকির প্রয়োজন আসে না এমন জমি, প্রয়োজন অতিরিক্ত বাড়ি, ব্যবসায়িক পণ্য ও অপ্রয়োজনীয় সকল আসবাবপত্র কুরবানীর নেসাবের ক্ষেত্রে হিসাবযোগ্য। আর নিসাব হল স্বর্ণের ক্ষেত্রে সাড়ে সাত (৭.৫) ভরি, রূপার ক্ষেত্রে সাড়ে বায়ান্ন (৫২.৫) ভরি, টাকা-পয়সা ও অন্যান্য বস্তুর ক্ষেত্রে নিসাব হল এর মূল্য সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হওয়া। আর সোনা বা রূপা কিংবা টাকা-পয়সা এগুলোর কোনো একটি যদি পৃথকভাবে নেসাব পরিমাণ না থাকে কিন্তু প্রয়োজন অতিরিক্ত একাধিক বস্তু মিলে সাড়ে বায়ান্ন তোলা রূপার মূল্যের সমপরিমাণ হয়ে যায় তাহলেও তার উপর কুরবানী করা ওয়াজিব।-আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৪৫৫; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৭/৪০৫
২. নেসাবের মেয়াদ : কুরবানীর নেসাব পুরো বছর থাকা জরুরি নয়; বরং কুরবানীর তিন দিনের মধ্যে যে কোনো দিন থাকলেই কুরবানী ওয়াজিব হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১২
৩. কুরবানীর সময় : মোট তিনদিন কুরবানী করা যায়। যিলহজ্বের ১০, ১১ ও ১২ তারিখ সূর্যাস্ত পর্যন্ত। তবে সম্ভব হলে যিলহজ্বের ১০ তারিখেই কুরবানী করা উত্তম। -মুয়াত্তা মালেক ১৮৮
৪. নাবালেগের কুরবানী : নাবালেগ শিশু-কিশোর তদ্রূপ যে সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন নয়, নেসাবের মালিক হলেও তাদের উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়। অবশ্য তার অভিভাবক নিজ সম্পদ দ্বারা তাদের পক্ষে কুরবানী করলে তা সহীহ হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩১৬
৫. দরিদ্র ব্যক্তির কুরবানীর হুকুম : দরিদ্র ব্যক্তির উপর কুরবানী করা ওয়াজিব নয়; কিন্তু সে যদি কুরবানীর নিয়তে কোনো পশু কিনে তাহলে তা কুরবানী করা ওয়াজিব হয়ে যায়। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯২
৬. প্রথম দিন কখন থেকে কুরবানী করা যাবে : যেসব এলাকার লোকদের উপর জুমা ও ঈদের নামাজ ওয়াজিব তাদের জন্য ঈদের নামাজের আগে কুরবানী করা জায়েজ নয়। অবশ্য বৃষ্টিবাদল বা অন্য কোনো ওজরে যদি প্রথম দিন ঈদের নামাজ না হয় তাহলে ঈদের নামাজের সময় অতিক্রান্ত হওয়ার পর প্রথম দিনেও কুরবানী করা জায়েজ।-সহীহ বুখারী ২/৮৩২, কাযীখান ৩/৩৪৪, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৮
৭. রাতে কুরবানী করা : ১০ ও ১১ তারিখ দিবাগত রাতেও কুরবানী করা জায়েজ। তবে দিনে কুরবানী করাই ভালো।-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ১৪৯২৭; মাজমাউয যাওয়াইদ ৪/২২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০
৮. কুরবানীর উদ্দেশ্যে ক্রয়কৃত পশু সময়ের পর যবাই করলে : কুরবানীর দিনগুলোতে যদি জবাই করতে না পারে তাহলে খরিদকৃত পশুই সদকা করে দিতে হবে। তবে যদি (সময়ের পরে) জবাই করে ফেলে তাহলে পুরো গোশত সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গোশতের মূল্য যদি জীবিত পশুর চেয়ে কমে যায় তাহলে যে পরিমাণ মূল্য হ্রাস পেল তা-ও সদকা করতে হবে।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০২, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২০-৩২১
৯. কোন কোন পশু দ্বারা কুরবানী করা যাবে : উট, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ। এসব গৃহপালিত পশু ছাড়া অন্যান্য পশু যেমন হরিণ, বন্যগরু ইত্যাদি দ্বারা কুরবানী করা জায়েজ নয়।-কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫
১০. নর ও মাদা পশুর কুরবানী : যেসব পশু কুরবানী করা জায়েজ সেগুলোর নর-মাদা দুটোই কুরবানী করা যায়।-কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৫
১১. কুরবানীর পশুর বয়সসীমা : উট কমপক্ষে ৫ বছরের হতে হবে। গরু ও মহিষ কমপক্ষে ২ বছরের হতে হবে। আর ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছরের হতে হবে। তবে ভেড়া ও দুম্বা যদি ১ বছরের কিছু কমও হয়, কিন্তু এমন হৃষ্টপুষ্ট হয় যে, দেখতে ১ বছরের মতো মনে হয় তাহলে তা দ্বারাও কুরবানী করা জায়েজ। অবশ্য এক্ষেত্রে কমপক্ষে ৬ মাস বয়সের হতে হবে। উল্লেখ্য, ছাগলের বয়স ১ বছরের কম হলে কোনো অবস্থাতেই তা দ্বারা কুরবানী জায়েজ হবে না।-কাযীখান ৩/৩৪৮, বাদায়েউস সানায়ে? ৪/২০৫-২০৬
১২. এক পশুতে শরীকের সংখ্যা : একটি ছাগল, ভেড়া বা দুম্বা দ্বারা শুধু একজনই কুরবানী দিতে পারবে। এমন একটি পশু কয়েকজন মিলে কুরবানী করলে কারওটাই সহীহ হবে না। আর উট, গরু, মহিষে সর্বোচ্চ সাত জন শরীক হতে পারবে। সাতের অধিক শরীক হলে কারও কুরবানী সহীহ হবে না।-সহীহ মুসলিম ১৩১৮, মুয়াত্তা মালেক ১/৩১৯, কাযীখান ৩/৩৪৯
১৩. সাত শরীকের কুরবানী : সাতজনে মিলে কুরবানী করলে সবার অংশ সমান হতে হবে। কারও অংশ এক সপ্তমাংশের কম হতে পারবে না। যেমন কারও আধা ভাগ, কারও দেড় ভাগ। এমন হলে কোনো শরীকের কুরবানীই সহীহ হবে না।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭
১৪. উট, গরু, মহিষ সাত ভাগে এবং সাতের কমে যেকোনো সংখ্যা যেমন দুই, তিন, চার, পাঁচ ও ছয় ভাগে কুরবানী করা জায়েজ। -সহীহ মুসলিম ১৩১৮, বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৭ ১৫. কুরবানীর পশুতে আকীকার অংশ : কুরবানীর গরু, মহিষ ও উটে আকীকার নিয়তে শরীক হতে পারবে। এতে কুরবানী ও আকীকা দুটোই সহীহ হবে।-তাহতাবী আলাদ্দুর ৪/১৬৬, রদ্দুল মুহতার ৬/৩৬২
১৬. কুরবানীর উত্তম পশু : কুরবানীর পশু হৃষ্টপুষ্ট হওয়া উত্তম।-মুসনাদে আহমদ ৬/১৩৬, আলমগীরী ৫/৩০০
১৭. নিজের কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা : কুরবানীর পশু নিজে জবাই করা উত্তম। নিজে না পারলে অন্যকে দিয়েও জবাই করাতে পারবে। এক্ষেত্রে কুরবানীদাতা পুরুষ হলে জবাইস্থলে তার উপস্থিত থাকা ভালো। -মুসনাদে আহমদ
১৮. জবাইয়ে একাধিক ব্যক্তি শরীক হলে : অনেক সময় জবাইকারীর জবাই সম্পন্ন হয় না, তখন কসাই বা অন্য কেউ জবাই সম্পন্ন করে থাকে। এক্ষেত্রে অবশ্যই উভয়কেই নিজ নিজ যবাইয়ের আগে ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ পড়তে হবে। যদি কোনো একজন না পড়ে তবে ওই কুরবানী সহীহ হবে না এবং জবাইকৃত পশুও হালাল হবে না। -রদ্দুল মুহতার ৬/৩৩৪
১৯. কোনো শরীকের মৃত্যু ঘটলে : কয়েকজন মিলে কুরবানী করার ক্ষেত্রে জবাইয়ের আগে কোনো শরীকের মৃত্যু হলে তার ওয়ারিসরা যদি মৃতের পক্ষ থেকে কুরবানী করার অনুমতি দেয় তবে তা জাজেয় হবে। নতুবা ওই শরীকের টাকা ফেরত দিতে হবে। অবশ্য তার স্থলে অন্যকে শরীক করা যাবে। -বাদায়েউস সানায়ে ৪/২০৯, আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩২৬
২০. কুরবানীর গোশত জমিয়ে রাখা : কুরবানীর গোশত তিনদিনেরও অধিক জমিয়ে রেখে খাওয়া জায়েজ।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৪
২১. কুরবানীর গোশত বণ্টন : শরীকে কুরবানী করলে ওজন করে গোশত বণ্টন করতে হবে। অনুমান করে ভাগ করা জায়েজ নয়।-আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩১৭, কাযীখান ৩/৩৫১
২২. কুরবানীর গোশতের এক তৃতীয়াংশ গরিব-মিসকীনকে এবং এক তৃতীয়াংশ আত্মীয়-স্বজন ও পাড়া-প্রতিবেশীকে দেওয়া উত্তম। অবশ্য পুরো গোশত যদি নিজে রেখে দেয় তাতেও কোনো অসুবিধা নেই।-বাদায়েউস সানায়ে? ৪/২২৪, আলমগীরী ৫/৩০০
২৩. জবাইকারীকে চামড়া, গোশত দেওয়া : জবাইকারী, কসাই বা কাজে সহযোগিতাকারীকে চামড়া, গোশত বা কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া জায়েজ হবে না। অবশ্য পূর্ণ পারিশ্রমিক দেওয়ার পর পূর্ব চুক্তি ছাড়া হাদিয়া হিসেবে গোশত বা তরকারি দেওয়া যাবে।
২৪. জবাইয়ের অস্ত্র : ধারালো অস্ত্র দ্বারা জবাই করা উত্তম।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩
২৫. পশু নিস্তেজ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা : জবাইয়ের পর পশু নিস্তেজ হওয়ার আগে চামড়া খসানো বা অন্য কোনো অঙ্গ কাটা মাকরূহ।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২২৩
২৬. কুরবানীর গোশত বিধর্মীকে দেওয়া : কুরবানীর গোশত হিন্দু ও অন্য ধর্মাবলম্বীকে দেওয়া জায়েজ।-ইলাউস সুনান ৭/২৮৩, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০০
২৭. কুরবানীর পশু চুরি হয়ে গেলে বা মরে গেলে : কুরবানীর পশু যদি চুরি হয়ে যায় বা মরে যায় আর কুরবানীদাতার উপর পূর্ব থেকে কুরবানী ওয়াজিব থাকে তাহলে আরেকটি পশু কুরবানী করতে হবে। গরিব হলে (যার উপর কুরবানী ওয়াজিব নয়) তার জন্য আরেকটি পশু কুরবানী করা ওয়াজিব নয়।-বাদায়েউস সানায়ে ৪/২১৬, খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৯
২৮. নবী কারীম (সা.)পক্ষ থেকে কুরবানী করা : সামর্থ্যবান ব্যক্তির রাসূলুল্লাহ (সা.) পক্ষ থেকে কুরবানী করা উত্তম। এটি বড় সৌভাগ্যের বিষয়ও বটে। নবী কারীম (সা.) আলী (রা.)-কে তার পক্ষ থেকে কুরবানী করার ওসিয়্যত করেছিলেন। তাই তিনি প্রতি বছর রাসূলুল্লাহ (সা.)এর পক্ষ থেকেও কুরবানী দিতেন।-সুনানে আবু দাউদ ২/২৯, জামে তিরমিযী ১/২৭৫
২৯. কুরবানীর চামড়া বিক্রির অর্থ সাদকা করা : কুরবানীর চামড়া কুরবানীদাতা নিজেও ব্যবহার করতে পারবে। তবে কেউ যদি নিজে ব্যবহার না করে বিক্রি করে তবে বিক্রিলব্ধ মূল্য পুরোটা সদকা করা জরুরি।-আদ্দুররুল মুখতার, ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩০১
৩০. কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা : ঈদুল আযহার দিন সর্বপ্রথম নিজ কুরবানীর গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত। অর্থাৎ সকাল থেকে কিছু না খেয়ে প্রথমে কুরবানীর গোশত খাওয়া সুন্নত। এই সুন্নত শুধু ১০ যিলহজ্বের জন্য। ১১ বা ১২ তারিখের গোশত দিয়ে খানা শুরু করা সুন্নত নয়।-জামে তিরমিযী ১/১২০, আদ্দুররুল মুখতার ২/১৭৬, আলবাহরুর রায়েক ২/১৬৩
৩১. জবাইকারীকে পারিশ্রমিক দেওয়া : কুরবানী পশু জবাই করে পারিশ্রমিক দেওয়া-নেওয়া জায়েজ। তবে কুরবানীর পশুর কোনো কিছু পারিশ্রমিক হিসেবে দেওয়া যাবে না।-কিফায়াতুল মুফতী ৮/২৬৫
৩২. মোরগ কুরবানী করা : কোনো কোনো এলাকায় দরিদ্রদের মাঝে মোরগ কুরবানী করার প্রচলন আছে। এটি না জায়েজ। কুরবানীর দিনে মোরগ জবাই করা নিষেধ নয়, তবে কুরবানীর নিয়তে করা যাবে না।-খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩১৪, ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/২৯০
মহান আল্লাহর বাণী দিয়ে শেষ করছি সূরা আল হাজ্জ ৩৭ নং আয়াত ইরশাদ হচ্ছে, ‘আল্লাহর কাছে পৌঁছে না ওগুলির গোশত এবং রক্ত বরং পৌঁছে তোমাদের তাক্বওয়া। এভাবে তিনি ওগুলিকে তোমাদের অধীন করে দিয়েছেন যাতে তোমরা আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ঘোষণা কর এ জন্য যে, তিনি তোমাদেরকে পথ প্রদর্শন করেছেন। সুতরাং তুমি সুসংবাদ দাও সৎকর্মশীলদেরকে।’ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালবাসায় নিবেদিত হোক আমাদের কুরবানী।
লেখক : আরবি প্রভাষক, কামাল বাজার ফাজিল মাদরাসা, বিশ্বনাথ, সিলেট।