মহররম মাসটি হিজরি অব্দের চারটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ মাসের মধ্যে অন্যতম। মহররম এলেই ভেসে ওঠে কারবালার মর্মান্তিক দৃশ্য। ইসলামের ইতিহাসের এক আলোচিত, অবিস্মরণীয় একই সঙ্গে বরকতপূর্ণ দিন ১০ মহররম। আমরা জানি, এই দিনটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুসলিম বিশ্বের ঐতিহাসিক নানা ঘটনাপ্রবাহ। কারবালার ময়দানে আমাদের প্রিয় নবীর দৌহিত্র হজরত ইমাম হোসেইনের (রা.) শাহাদাতের কথা পরম শ্রদ্ধা ও ভাবগাম্ভীর্যে উচ্চারিত হয়ে আসছে। ১০ মহররম একাধারে পুণ্য অর্জনের ও শোক পালনের দিন। এদিন রোজা রাখলে ও বিশেষ নামাজ আদায় করলে অধিক পুণ্য অর্জন হয়।
হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আশুরার দিন যে ব্যক্তি তার পরিবারের জন্য মুক্তহস্তে ব্যয় করবেন আল্লাহপাক তাকে সারা বছর সচ্ছলতা দান করবেন। আজকের দিনে শোক পালনের কারণ, হজরত মোহাম্মদের দৌহিত্র ফাতেমা বিবির পুত্র পরিবার ও অনুগামীসহ কারবালা প্রান্তরে এজিদের সঙ্গে যুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন। ওই নিষ্ঠুর ও পৈশাচিকতায় ইমাম হোসেইনের শিশুপুত্র আলি আসগরও রক্ষা পাননি। এই করুণ কাহিনি ইসলামের ইতিহাস পাঠেই আমরা পাই। আরও পাই ত্যাগের শিক্ষা। মহানুভবতার শিক্ষা। মহররম আসলে একটি দিন নয়, একটি মাস। হিজরি ক্যালেন্ডারের প্রথম ও পবিত্রতম মাসগুলোর একটি। সমকালীন প্রেক্ষাপটে আশুরার শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যায়-অবিচার ও স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের যে প্রেরণা বিশ্বময় ইমাম হোসেইন (রা.) ছড়িয়ে গেছেন, তাও মানবজাতির জন্য বড় শিক্ষা। মানবতাকে যদি আমরা অন্তরে ধারণ করে নিপীড়িত-নিষ্পেষিত-বঞ্চিতদের পক্ষে দাঁড়িয়ে যূথবদ্ধ প্রয়াস নিই তাহলে কাঙ্ক্ষিত সমাজ প্রতিষ্ঠা দুরূহ নয়। আশুরার মূল চেতনা আমাদের তো এ শিক্ষাই দেয়। আমাদের উচিত, এ মাসে অধিকভাবে নফল ইবাদতে রত হওয়া। ১০ মহররমকে কেন্দ্র করে আমরা যেন অতিরঞ্জিত কিছু না করি বরং হজরত ইমাম হোসেইন (রা.) সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠায় যে আদর্শ আমাদের সামনে রেখে গেছেন তা আঁকড়ে ধরে জীবনের পথে চলা। মহররম মাসে যে ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, তা আমাদের ত্যাগ ও আদর্শের মহান শিক্ষাই দেয়।
ইসলামের ইতিহাসে শোকাবহ এই দিনে কারবালার প্রান্তরে ঐতিহাসিক বিয়োগান্ত ঘটনার স্মরণে মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও আজ যথাযোগ্য মর্যাদায় পবিত্র আশুরা করোনা-দুর্যোগের কারণে সীমিত পরিসরে পালিত হলেও এর ভাবগাম্ভীর্য ও ইবাদতে কোনোই ঘাটতি হবে না। কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরার শাশ্বত বাণী অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে আজও অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রেরণা জোগায় সত্য ও সুন্দরের পথে চলার। শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের সুমহান আদর্শ সমুন্নত রাখতে মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন হজরত ইমাম হোসেইন (রা.) এবং তার পরিবার ও অনুসারীরা।
মাসের নামটাই মহররম- এর পবিত্রতার পরিচয় বহন করে। আশুরার মাহাত্ম্য সম্পর্কে হাদিস শরিফে বিস্তর বর্ণনা রয়েছে। ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে রমজান মাসের সিয়াম কাজ ফরজ হওয়ার আগে প্রিয় নবী রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে এবং তার নির্দেশে সাহাবায়ে কেরাম আশুরার সিয়াম পালন করেছেন, এমনকি রমজানের ফরজ সিয়াম পালন করলেও আশুরার নফল সিয়ামও পালিত হতে থাকে। প্রিয় নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) বলেছেন, রমজানের সিয়ামের পর উত্তম সিয়াম হচ্ছে আশুরার সিয়াম। বর্তমান বিশ্বে আশুরার শিক্ষা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। অন্যায় ও ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে আপসহীন অবস্থান ও ত্যাগের যে শিক্ষা কারবালার ঘটনা মানবজাতিকে দিয়েছে, তা আজকের বাস্তবতায় যথাযথভাবে পালিত কিংবা অনুসরণ করা গেলে অন্যায়-অবিচার দূর করতে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
মহররম মাসের ১০ তারিখ বা আশুরা ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে ঐতিহাসিক কারবালার হৃদয়বিদারক ঘটনার কারণে। এই সত্য এড়ানোর পথ নেই। ইমাম হোসেইন (রা.) সত্য, ন্যায় ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করার জন্য, গণতন্ত্র ও মানবিক মূল্যবোধ কায়েম করার জন্য, অন্যায়-অবিচার, জুলুম-নিপীড়ন প্রতিহত করে হক ইনসাফের ভিত্তি পাকাপোক্ত করার জন্য কারবালা প্রান্তরে নিজের পবিত্র প্রাণ কোরবান করার মধ্য দিয়ে যে অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন, তা পৃথিবীর মানুষকে ন্যায়ের সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার তাগিদ দিয়ে আসছে যুগ যুগ ধরে।
হজরত ইমাম হোসেইন প্রিয় নবী (সা.)-এর প্রিয় দৌহিত্র। এই দৌহিত্র সম্পর্কে তিনি বলতেন, হোসেইন আমার থেকে এবং আমি হোসেইন থেকে। সেই ইমাম হোসেইনকে যারা শহীদ করল তারা নিঃসন্দেহে নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করার যোগ্য নয়, তারা প্রকৃত অর্থেই ইসলামের শত্রু, স্বাধীনতার শত্রু। সত্য ও ন্যায়ের শত্রু। মাওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর বলেন, হোসেইনের কতল আসলে ইয়াজিদের মরণ হয়েছে। ইসলাম জিন্দা হয়ে ওঠে প্রতি কারবালার পর। আশুরা একটি পবিত্র দিন। শিরক, বিদ্‌আত ও কুসংস্কারমূলক কাজ করে যেন আমরা আশুরার পবিত্রতা নষ্ট না করি এবং সত্য ও সুন্দর প্রতিষ্ঠায় নিবেদিত হওয়ার দৃঢ়প্রত্যয়ী হই।
সাংবাদিক ও পরিবেশকর্মী