অপারেশন হিলসাইড’ : পালিয়ে গেছেন এক ‘জঙ্গি’, যেভাবে গড়া হয় আস্তানা

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের গহীন পাহাড়ে প্রায় ৪ ঘণ্টার অভিযান শেষে নারী শিশুসহ ১৩ জঙ্গিকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আটককৃতদের মধ্যে রয়েছে- ৩ শিশু, ৬ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ। পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি), সোয়াটসহ অন্যান্য সংস্থা ‘অপারেশন হিল সাইড’ নাম এই অভিযান পরিচালনা করে। অভিযান শেষেই জঙ্গিদের ঢাকায় নিয়ে যায় সিটিটিসি।
গতকাল শনিবার সকাল ১০টায় পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামের জুগিটিলায় বাইশালীস্থ জঙ্গিদের আস্তানা থেকে আটকের পর উপস্থিত সাংবাদিকদের অভিযানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বক্তব্য দেন-সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান।

সংবাদ সম্মেলনে যা বললেন সিটিটিসি প্রধান: আমাদের কাছে তথ্য ছিল নতুন একটি উগ্রবাদী সংগঠন ব্যাপক সংখ্যক লোককে উগ্রবাদের দীক্ষা দিয়েছে। সে সব লোক হিজরতের জন্য ঘর থেকে বের হয়েছেন। শুরুতে আমাদের কাছে তথ্য ছিল মৌলভীবাজারের যে কোনো একটি পাহাড়ে তারা তাদের আস্তানাটি তৈরি করেছে। এরপর আমরা কুলাউড়ায় জঙ্গি আস্তানা সম্পর্কে চূড়ান্ত তথ্য পাই।’ তিনি বলেন, ‘ঢাকায় আমরা একজনকে গ্রেফতার করেছি, যিনি এই জঙ্গি আস্তানা থেকে তার পরিবারকে আনার জন্য গিয়েছিলেন,’ এর সূত্র ধরে মূলত সামনে আসে এই পাহাড়ি এলাকার তথ্য।

সিটিটিসি প্রধান বলেন, কুলাউড়ায় জঙ্গি আস্তানা থেকে বিনা বলপ্রয়োগে আমরা তাদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হই। তাদের হেফাজতে নেওয়ার পরে আমরা আস্তানায় ব্যাপক তল্লাশি চালিয়ে প্রায় ৩ কেজি বিস্ফোরক ও ৫০টির মতো ডেটোনেটর উদ্ধার করি। যা দিয়ে গ্রেনেডসহ হাই এক্সপ্লোসিভ তৈরি করা হয়। এছাড়া ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা, প্রশিক্ষণ সামগ্রী; কমব্যাট বুট, বক্সিন ব্যাগ এবং কয়েক বস্তা জিহাদি বই জব্দ করা হয়েছে,’ যোগ করেন তিনি।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি নতুন একটি সংগঠন, এর নাম “ইমাম মাহদির কাফেলা”। বাংলাদেশে যেসব নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আছে, সেগুলোর বাইরে এটি একটি নতুন সংগঠন। এই সংগঠনের যে মূল ব্যক্তি তার নামও আমরা পেয়েছি। আশা করি, তার পর্যন্ত পৌঁছাতে আমরা সক্ষম হবো। তিনি আরও বলেন, এই সংগঠনের প্রধানের নামও নিশ্চিত হওয়া গেছে। মাত্র ৭দিন থেকে তারা দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করে। এখানে অভিযান পরিচালনার পর কেউ পালিয়ে যেতে পারেনি। এখানে যারা আসা-যাওয়া করতো তাদের নামের তালিকা আছে। তবে, তিনি এই অভিযানে জঙ্গি সংগঠনকে অংকুরেই নস্যাৎ করা হয়েছে বলে জানান।

বিকাশে আসতো টাকা: আস্তানার বাসিন্দা জয়নাল মিয়া প্রায় দিন ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা বিকাশে তুলতেন। ঘটনার একদিন আগে ৬০ হাজার টাকা বিকাশ থেকে তুলতে যায় জয়নাল মিয়া। টাকা বেশি থাকায় ঘটনাস্থলের পার্শ্ববর্তী দোকান থেকে তুলতে না পেরে রবিরবাজার থেকে তুলেন।

বসতি স্থাপন করে যেভাবে: স্থানীয় বাসিন্দা রফিক মিয়ার কাছ থেকে খাস জায়গা কিনে জঙ্গিরা। প্রথমে জঙ্গি আস্তানায় পুরুষরা বসবাস করে। ঘটনার আগের দিন অনেক মহিলা ও বাচ্চা এখানে আসতে দেখা যায়। এ থেকেই স্থানীয়দের সন্দেহ হয়।
এদিকে, শুক্রবার রাত ৮টা থেকে কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামের জুগিটিলায় বাইশালী নামক এলাকায় একটি টিলার ওপর নতুন স্থাপিত বাড়ি ঘিরে রাখে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। শনিবার সকাল ৭টার দিকে বাড়িটিতে অভিযান শুরু হয়। বেলা ১১ টায় আটককৃতদের নিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয় সিটিটিসি।

আটককৃতরা হলেন: সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর থানার মাইজবাড়ি গ্রামের সাইফুল ইসলামের ছেলে রাফিউল ইসলাম (২২), কিশোরগঞ্জ জেলার ইটনা থানার কালনা গ্রামের আবুল কাশেমের ছেলে হাফিজ উল্লাহ (২৫), নারায়ণগঞ্জ জেলার ফতুল্লা থানার রসুলপুর গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে খায়রুল ইসলাম (২২), তার স্ত্রী মেঘনা (১৭) এবং তাদের ১২ মাসের শিশু আবিদা, সাতক্ষীরা থানা ও জেলার দক্ষিণ নলতা গ্রামের ওমর আলীর পুত্র শরিফুল ইসলাম (৪০), পাবনা জেলার আটঘরিয়া থানার শ্রীপুর গ্রামের আব্দুছ ছত্তারের স্ত্রী শাপলা বেগম (২২) ও তার ১৮ মাসের শিশু কন্যা জুবেদা ও হুজাইফা (০৬), নাটোর জেলা ও সদর থানার চাদপুর গ্রামের সোহেল তানজীমের স্ত্রী মাইশা ইসলাম (২০), বগুড়া জেলার শরিয়াকান্দি থানার নিজবলাই গ্রামের সুমন মিয়ার স্ত্রী সানজিদা খাতুন (১৮), সাতক্ষীরা জেলার তালা থানার দক্ষিণ নলতা গ্রামের শফিকুল ইসলামের স্ত্রী আমিনা বেগম (৪০) এবং তার মেয়ে হাবিবা বিনতে শফিকুল (২০)।

আটককৃতদের কাছ থেকে ৩ লাখ ৬১ হাজার টাকা ও স্বর্ণালংকার, ৫০টি ডেটোনেটর, আড়াই কেজি বিস্ফোরক, প্রশিক্ষণ সামগ্রী ও বিপুল পরিমাণ জিহাদী বই উদ্ধার করা হয়েছে।
খবর পেয়ে দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম। অভিযানে অংশ নেন-যুগ্ম কমিশনার কামরুজ্জামান, সিটিটিসির নাজমুল ইসলাম, সোয়াট কামান্ডার এডিসি জাহিদ, মৌলভীবাজারের পুলিশ সুপার মো. মঞ্জুর রহমান পিপিএম ও কুলাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ মো. আব্দুছ ছালেক প্রমুখ।
কর্মধা ইউনিয়নের সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার মাহমুদা আক্তার জানান, ‘যে বাড়িতে অভিযান চালানো হয়েছে ওই বাড়ির বাসিন্দা তারা নয়। কয়েকদিন থেকে তারা এখানে বসতি গেড়েছে। এলাকার কারো সাথে খুব একটা মিশতো না। চলাচল ছিলো সন্দেহজনক।’
কুলাউড়ার কর্মধা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মুহিবুল ইসলাম আজাদ জানান, তার ইউনিয়নের পূর্ব টাট্টিউলি গ্রামের বাইশালী বাড়ি নামক পাহাড়ি এলাকা এরা বসতি শুরু করে। কিভাবে এখানে এসেছে তা নিশ্চিত নয়। বসতি খুব বেশিদিন না হওয়ায় জানাজানিও হয়নি বলে জানান তিনি।

Developed by: