এবারের স্বাধীনতা পুরস্কারের জন্য মনোনীত দেশের আট বিশিষ্টজনের মধ্যে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য হবিগঞ্জের দুই কৃতীসন্তান মনোনীত হয়েছেন।
তারা হচ্ছেন— সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম শাহ এ এম এস কিবরিয়া এবং মরহুম কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী। বুধবার (৪ মার্চ) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে এ সংক্রান্ত্র প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৫ মার্চ ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে ২০১৫ সালের স্বাধীনতা পুরস্কার প্রদান করবেন।
কিবরিয়া : সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম শাহ এ এম এস কিবরিয়া ১৯৩১ সালে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার জালালসাপ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি ওয়াশিংটনে পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। এ সময় তিনি প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে সংগঠকের ভূমিকা পালন করেন।
১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে শাহ এ এম এম কিবরিয়া টেকনোক্র্যাট কোটায় অর্থমন্ত্রী মনোনীত হন।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে হবিগঞ্জ-৩ (হবিগঞ্জ সদর-লাখাই) আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
২০০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদর উপজেলার বৈদ্যেরবাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঈদপরবর্তী এক জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলার শিকার হন সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়া।
এই নির্মম হামলায় তিনি গুরুতর আহত হলে চিকিৎসার জন্য ঢাকা নেওয়ার পথে রক্তক্ষরণজনিত কারণে মারা যান। ওই হামলায় আরও নিহত হন তার ভাতিজা শাহ মঞ্জুরুল হুদা, আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রহিম, আবুল হোসেন ও সিদ্দিক আলী।
আহত হন হবিগঞ্জ-৩ (হবিগঞ্জ সদর-লাখাই) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এ্যাডভোকেট মো. আবু জাহির, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আলমগীর চৌধুরী ও রাজন চৌধুরীসহ অর্ধশতাধিক লোক।
এ ঘটনায় ২০০৫ সালের ২৮ জানুয়ারি হবিগঞ্জ-২ (বানিয়াচং-আজমিরীগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট আব্দুল মজিদ খান বাদী হয়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা দায়ের করেন। বর্তমানে হত্যা মামলাটি আদালতে বিচারাধীন রয়েছে।
মানিক চৌধুরী : ১৯৩৩ সালে বাহুবল উপজেলার খাগাউড়া গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন মানিক চৌধুরী।
সাহসী এ পুরুষ ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ এবং কারাবরণ করেন। ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনেও ছিলেন সক্রিয়। স্বৈরাচার আইয়ুববিরোধী গণঅভ্যুত্থানে হবিগঞ্জে তার নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হয়।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে বাহুবল-চুনারুঘাট ও শ্রীমঙ্গল নিয়ে গঠিত সংসদীয় এলাকা থেকে বিপুল ভোটে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বঙ্গবন্ধুর ডাকে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের টেলিগ্রাম পেয়েই হবিগঞ্জে গঠন করেন সংগ্রাম পরিষদ। গ্রহণ করেন বৃহত্তর সিলেটের গণমুক্তি বাহিনীর অধিনায়কত্ব।
যুদ্ধ শুরু হলে তিনি হবিগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক ড. আকবর আলী খানের (সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) সহযোগিতায় হবিগঞ্জ অস্ত্রাগার লুট করেন। সেখান থেকে প্রায় ৮শ’র মতো রাইফেল নিয়ে তা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিলিয়ে দেন।
তিনি হবিগঞ্জ মহকুমা কারাগারের তালা ভেঙ্গে কারাবন্দীদের উদ্ধার করে নিয়ে আসেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থের যোগান দিতে হবিগঞ্জ ট্রেজারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে হামলা করে সেখান থেকে সব অর্থ লুট করে তা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রাত্যহিক ব্যয় নির্বাহ ও অস্ত্র ক্রয় করেন। তিনিই প্রথম ভারতের আগরতলার ভারতীয় সরকারের সঙ্গে অস্ত্র ক্রয়ের চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সহ-সর্বাধিনায়ক কর্নেল এম এ রব ও সেক্টর কমান্ডার মেজর সি আর দত্ত তাকে সিভিলিয়ন সেক্টরে প্রথম কমান্ড্যান্ট উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে তিনি মাধবপুর হতে আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসেবে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এ সময় তিনি মাধবপুর উপজেলাজুড়ে বর্তমানে যে স্বল্প গভীর নলকূপ ব্যবহৃত হয় (ঘাই প্রকল্প) তার প্রচলন ঘটান। যার ওপরে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস গবেষণা করেন।
১৯৭৪ সালে তাকে রাষ্ট্রপতি পদকে ভূষিত করা হয়। ১৯৭৫ সালে তিনি হবিগঞ্জ মহকুমা গভর্নর পদে নিযুক্ত হন। বাংলাদেশ কৃষক লীগ কেন্দ্রীয় কমিটি ও আওয়ামী লীগের হবিগঞ্জ মহকুমা কমিটির সভাপতি ছিলেন মানিক চৌধুরী।
তার অনুপ্রেরণায় ও উদ্যোগে আজমিরিগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হাফিজ আফাই মিয়ার অর্থায়নে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সামনে নির্মিত হয় মুক্তিযুদ্ধের দুর্জয় স্মৃতিসৌধ।
মহান এ ব্যক্তি ১৯৯১ সালের ১০ জানুয়ারি হবিগঞ্জ শহরের পুরাতন হাসপাতাল রোডের নিজ বাসভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

