আরকুম শাহ

আনুমানিক ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে সুফি সাধক আরকুম শাহ দক্ষিণ সুরমার ধরাধরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে যে ক’জন প্রথিতযশা মরমি কবি আধ্যাত্মিক জ্ঞান ও ধ্যানের সঙ্গে মরমি সংগীত রচনা করেছেন তাঁদের মধ্যে আরকুম শাহ অন্যতম। তিনি আধ্যাত্মিক জীবনের প্রথম দিগ্দর্শন গ্রহণ করেন দক্ষিণ সুরমার লালাবাজারের ছনখাই (লতিফনগর) নিবাসী পীর হজরত সুফি শাহ আব্দুল লতিফের কাছে। তিনি নিয়মিত পাঠ অভ্যাস, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ, রোজা ও কোরআন তেলাওয়াত করতেন। আরকুম শাহ লিখে গেছেন অজস্র তাত্ত্বিক ও ভক্তিমূলক গান। কালজয়ী এ গানগুলো আকাশবাণীর কয়েকটি কেন্দ্রসহ বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশনে প্রচার হয়ে আসছে। তবে সংরক্ষণের অভাবে তাঁর অনেক গান হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের আঞ্চলিক সংস্কৃতির পরিমণ্ডল থেকে। তাঁর প্রকাশিত কবিতার বই ‘কবিনামা’ ও গানের বই ‘হকিকতে সিতারা’ ব্যাপক পাঠকপ্রিয়। ১৩৪৮ বঙ্গাব্দের ৫ চৈত্র আরকুম শাহ মৃত্যুবরণ করেন। লোকমুখে প্রচারিত আরকুম শাহ’র কয়েকটি গান নিম্নে তুলে দেওয়া হল-
*চাইর চিজে পিঞ্জিরা বানাই/ মোরে কইলায় বন্দ রে বন্ধু নির্ধনিয়ার ধন/ কেমনে পাইমুরে কালা তোর দরশন।। *সমুদ্রের জল উঠে বাতাসের জোরে/ আবর হইয়া উড়ে পবনের ভরে, জমিনে পড়িয়া শেষে সমুদ্রেতে যায়/ জাতেতে মিশিয়া জাতে তরঙ্গ খেলায়।। তুমি আমি আমি তুমি জানিয়াছি মনে/ বিচিতে জন্মিয়া গাছ বিচি ধরে কেনে? এক হইতে দুই হইল প্রেমেরই কারণ/ সে অবধি আশিকের মন করে উচাটন।। *পরিন্দা জানোয়ার যদি কোন এক কালে/ জাতি ছাড়া বন্ধ হয় শিকারির জালে, কিরূপে জিন্দেগি কাটে বন্ধখানায় তার, মাসুক হইয়া কর আশিকের বিচার।। *পাগল আরকুমে কয় মাসুক বানিয়া-/ দুয়াঙ্গ পাতাইয়া থইছে উলুরে গাঁথিয়া, আহার করিতে যদি না যাইত মন- না লাগিত প্রেম লেঠা না হইত মরণ।।
*আমরা প্রেমবাজারে থাকি, আমরা প্রেমবাজারে থাকি/ আশিক ছাড়া পুরুষ নারী হাবিয়া দোজখি।। এশ্কে আল্লাহ এশ্কে রসুল এশ্কে আদম খাকি। আদম হইতে হাওয়া পয়দা প্রেম খেলিবার লাগি।। জলিখা এশ্কেতে পাগল ইউসুফের লাগি/ শিরির জন্য ফরহাদ মইল, খসরু হইল পাতকী।। কুমারে দেখিয়া পাগল কন্যা চন্দ্রমুখি/ সুড়ঙ্গ পথে বাহির হয়ে বেশ ধরিল যোগী।। লায়লি আর মজনু পাগল একে অপরের লাগি/ জহুরা কান্দিয়া ফিরে বারামে না দেখি।। আরকুম বলে আশিক জনে মাসুক পাইলে সুখি/ মনসুর সুল্লিতে চড়ে আনাল হক না ডাকি।।
*সোনার পিঞ্জিরা আমার করিয়া গেলায় খালিরে/ হায়রে আমার যতনের পাখি, সুয়ারে একবার পিনজিরায় আও দেখি।। আর আজ্ঞামতে এই দেহাতে করিলায় পরবাস/ এখন মোরে ছাড়িয়া গেলায় করিয়া নৈরাশ।। যেই ঘরে থাকিয়া তুমি সদায় কৈলায় খেলা, সেই কোঠার মাঝে আমার লাগিয়া গেল তালা।। আর তুমি আমি একই ঘরেছিলাম এতদিন- আজি হতে ভিন্ন ভিন্ন পিঞ্জিরা মলিন।। পাগল আরকুমে কয় মিছা ঘরবাড়ি/ সুয়া পাখি উড়িয়া গেলে পিঞ্জিরা রয় পড়ি। উল্লিখিত গানগুলো আজও সিলেটসহ সারা দেশের মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত। আরকুম শাহকে নিয়ে শুধু দেশে নয় চর্চা করা হচ্ছে বহিঃর্বিশ্বের নানা দেশে। প্রচারিত হচ্ছে তাঁর কালজয়ী গানগুলো প্রতিটি দেশের প্রচার মাধ্যমে। আরকুম শাহ এখন কিন্তু শুধু সিলেটের নয় এখন সারা বিশ্বের সংগীত প্রিয় মানুষের কণ্ঠস্বর।

Developed by: