শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশের আর্থ সামাজিক ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা বাড়ছে। স্বীকৃতি স্বরূপ আন্তর্জাতিক পদকও পেয়েছেন গবেষকরা। আর্থিক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও গবেষণা খাতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রথম এই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। গবেষকরা জানালেন, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ পেলে আরো বেশি গবেষণা চালানো সম্ভব হবে। আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে অনেক গবেষণা করা সম্ভব হয় না।
গবেষণা কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, খনিজ তেল, গ্যাস, কয়লা, জ্বালানি সংকট, নবায়নযোগ্য শক্তি, বায়ো গ্যাস, বায়ো ডিজেল, বায়ো বিদ্যুত্, ইলেক্টো কেমেস্ট্রি, ক্যাটালাইসিস, পেট্রোলিয়াম, ট্রেড সিস্টেম, ম্যাক্রো ইকোনমি, সিলেটের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন, রেমিটেন্স, নগরায়নের সমস্যা, নগর উন্নয়ন, মাইনরিটি কমিউনিটি, ট্রাফিক জ্যাম, ভূমিকম্প, প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন ও চা বাগানের শ্রমিকদের জীবনযাত্রাসহ বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা হচ্ছে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে। আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ হচ্ছে এসব গবেষণা প্রতিবেদন। গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক, জাতিসংঘের বিজ্ঞান সংস্থা ইউনেস্কো পদক, ইয়াং সায়েন্সস্টিট অ্যাওয়ার্ড (কোরিয়া), দি ওয়ার্ল্ড সায়েন্স একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি পুরস্কার (স্বর্ণপদক) ও ইউজিসি অ্যাওয়ার্ডসহ বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পদক পেয়েছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে চালু হয় সাস্ট রিসার্চ সেন্টার। সরকারিভাবে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন প্রতি বছর গবেষণার জন্য বরাদ্দ দেয় ২০ লক্ষ টাকা। এছাড়া পূবালী ব্যাংক ১০ লক্ষ ও রূপালী ব্যাংক ১০ লক্ষ টাকা গবেষণার জন্য অনুদান দেয়। বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল অনুষদের নির্বাচিত শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করেন। গবেষণার চাহিদার তুলনায় এই খাতে অর্থ বরাদ্দ অপ্রতুল বলে জানালেন গবেষকরা। গবেষণায় সফলতার ফলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বিশ্বব্যাংকের ৬টি প্রজেক্টের গবেষণার কাজ দিয়েছিলো শাবির ৬ জন শিক্ষককে। গবেষণাগুলো ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের প্রজেক্টের জন্য ১৫ জন শিক্ষক রিসার্চ পেপার জমা দিয়েছেন। রিসার্চ সেন্টার সূত্রে জানা যায়, ইউজিসির ২০ লক্ষ ও দুটি ব্যাংকের ২০ লক্ষ টাকা দিয়ে অভ্যন্তরীণ গবেষণা করা হয়। বার্ষিক বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়ে ২০১১ সালে ৩৩টি প্রকল্পের অধীনে ৬৬ জন শিক্ষক গবেষণা করেন। ২০১২ সালে ৩৩টি গবেষণা প্রকল্পের অধীনে ৭০ জন শিক্ষক গবেষণা করেন। ২০১৩ সালে ৩১টি গবেষণা প্রকল্পের অধীনে ৬২ জন শিক্ষক গবেষণা করেছেন। শিক্ষকদের গবেষণায় উদ্বুদ্ধ করতে ২০১১ সাল থেকে ভিসি অ্যাওয়ার্ড চালু হয়েছে। প্রতিবছর সর্বোচ্চ মানসম্মত জার্নালের ভিত্তিতে দুইজন গবেষককে এই অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৫টি বিভাগের নির্বাচিত শিক্ষকরা বিভিন্ন বিষয়ে গবেষণা করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবুল হাসনাত ভৌত বিজ্ঞান শাখায় গবেষণায় কৃতিত্বের জন্য ২০০৩ ও ২০১০ সালে দুইবার ইউজিসি পুরস্কার পেয়েছেন। ২০০৮ সালে ইয়াং সায়েন্সস্টিট অ্যাওয়ার্ড (কোরিয়া) পান। ২০১৩ সালে দি ওয়ার্ন্ড সায়েন্স একাডেমির অধীনে প্রখ্যাত রসায়নবিদ বিজ্ঞানী আতাউর রহমান অ্যাওয়ার্ড (আর্জেটিনা) লাভ করেন। ড. হাসনাত ইলেক্টো কেমেস্ট্রি, ক্যাটালাইসিস বিষয়ে গবেষণায় অবদানের জন্য ২০১৪ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি পুরস্কার (গোল্ড মেডেল) লাভ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পেট্রোলিয়াম এন্ড মাইনিং ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক ড. মোঃ রফিকুল ইসলাম বাংলাদেশের ভবিষ্যত্ জ্বালানি সংকট নিরসনে ভূগর্ভস্থ কয়লাসম্পদ উত্তোলনের জন্য পরিবেশবান্ধব ও টেকসই মাইনিং পদ্ধতির বৈজ্ঞানিক গবেষণা, টিপাইমুখ ড্যামের উপর গবেষণা করে ২০১৪ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি কর্তৃক তরুণ বিজ্ঞানী পুরস্কার (গোল্ড মেডেল) লাভ করেন। তিনি খনিজ সম্পদ নিয়ে গবেষণার জন্য ইউজিসি অ্যাওয়ার্ড ও ইয়াং সায়েন্সস্টিট অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী কর্তৃক ব্যবহূত ড্যাম ডিজাইনের আলোকে এবং ভারতের টিপাইমুখ এলাকার ভূ-তাত্ত্বিক, ভূ-প্রকৌশল ও বিগত ১২০ বছরের আঞ্চলিক ভূমিকম্পের ডাটাবেজের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ও ভারতীয় বিজ্ঞানী মহলের মধ্যে সর্বপ্রথম টিপাইমুখ ড্যাম নিয়ে বৈজ্ঞানিক মডেলিং বিষয়ে গবেষণা করে সর্বমহলে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। ড. রফিকের এসব মূল্যবান বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধসমূহ আন্তর্জাতিক বিজ্ঞানী মহলে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, জার্মানি, ফ্রান্স, চীন, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে সমাদৃত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আবু ইউসুফ নবায়নযোগ্য শক্তি, বায়ো গ্যাস, বায়ো ডিজেল ও বায়ো বিদ্যুত্ নিয়ে গবেষণায় অবদানের জন্য জাতিসংঘের বিজ্ঞান বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো পদক (২০১১, মালয়েশিয়া) লাভ করেন। ‘এনার্জি ফর সাস্টেইনবল ইন এশিয়া’ বিষয়ে গবেষণায় কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রাখায় ওই বছর বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র তিনি এ পদক পান। জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন আবিষ্কারের ব্যাখ্যাসহ বিভিন্ন বিষয়ে মানসম্পন্ন গবেষণা করায় ড. আবু ইউসুফ ওয়ার্ল্ড লাইফ সায়েন্সেস ফোরাম বায়ো-ভিশন ২০১৩ (ফ্রান্স) এর ফেলোশিপ পান। ওয়ার্ল্ড লাইফ সায়েন্স ‘ফোরাম ফাউন্ডেশন ফর দ্য ইউনিভার্সিটি অব লিয়ন’ দ্বারা গঠিত একটি বিজ্ঞানভিত্তিক সংগঠন। এছাড়া জীব বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবদানের জন্য কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড পলিমার সায়েন্স বিভাগের ড. মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন ইউজিসি পদক পেয়েছেন। ম্যাক্রো অর্থনীতি বিষয়ে গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. সায়ন চক্রবর্তীও ইউজিসি পদক পান। বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো: কবির হোসেন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা সেন্টারের মাধ্যমে গবেষণা করে গবেষকরা দেশের উন্নয়নে ভূমিকা রাখছেন। এই গবেষণা জার্নালগুলো দেশের উন্নয়নে দিক নির্দেশনা দেবে। গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ণাঙ্গ রূপ দেবে। স্কলারশিপ ও ক্লাস পরীক্ষার পাশাপাশি শিক্ষকরা আরো বেশি করে গবেষণা করবেন এটাই প্রত্যাশা। গবেষণার ফলে সিলেট তথা দেশের উন্নয়ন কিভাবে করা যায় সে বিষয়টি বেরিয়ে আসবে।