শাহ আব্দুল ওদুদের পরশমণি ঃ গানে গানে শুভ জাগরণ বার্তা শিউল মনজুর

111111111111গানের দেশ প্রাণের দেশ বাংলাদেশ। সুদীর্ঘকাল থেকে এ দেশের মানুষ প্রাণ দিয়ে গানকে লালন করে আসছে। গানের ভেতর দিয়ে সুখ শান্তি আশা আকাঙ্খার বর্হিপ্রকাশ ঘটিয়েছে। তেমনি মুক্তির প্রদীপ জ¦ালিয়েছে গানের মধ্যদিয়েই। যা আমরা ৭১ এ স্বাধীনতা যুদ্ধে বিশেষভাবে অনুভব করেছি। এক কথায় ধনী গরিব, ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিক সমাজের সকল পেশার মানুষের মধ্যে চেতনার রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে গান। আজকের প্রচার প্রসারের যুগে বিনোদনের নানা মাত্রা লক্ষ্য করি। কিন্তু হাটতে বসতে চলতে ফিরতে এখনও গান মানুষের বিনোদনের প্রধান উপকরণ। হাট ঘাট মাঠ সর্বত্রই গান, গানের জয়জয়কার। তবে দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ সিলেট অঞ্চলের ভৌগলিক অবস্থান এবং পীর সাধকদের পূণ্যভূমি হওয়ায় গানের মাত্রায় ভিন্নতা লক্ষ্য করি। এ ভিন্নতা হচ্ছে কথার, এ ভিন্নতা হচ্ছে সুরের, এ ভিন্নতা হচ্ছে আঞ্চলিক সংস্কৃতির। শাহ আব্দুল ওদুদ রচিত পরশমণি গানের বইতে আমরা সেই ভিন্ন ধারা লক্ষ্য করি।
সিলেটের প্রথম মুসলমান হযরত শাহগাজি সৈয়দ বুরহান উদ্দিন (র.), সৈয়দা মা জননী (র.) ও শহিদ সৈয়দ গোলজারে আলম (র.)-কে উংসর্গিত বইটির নামকরণের সাথে মানানসই প্রচ্ছদ এঁকেছেন সুভাষ চন্দ্র নাথ এবং অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ সালে প্রকাশিত এই পরশমণি বইটির প্রকাশক সিলেট তথা বাংলাদেশের সু পরিচিত প্রকাশনা সংস্থা বাসিয়া প্রকাশনী। বইটির বাজার মূল্য উল্লেখ রয়েছে ১৫০ টাকা। ৬৮ পৃষ্টার এ বইটিতে গান রয়েছে ৫৭টি।
এই ৫৭টি গানের মধ্য দিয়ে তিনি সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর প্রতি অসীমভক্তি, দেশের প্রতি দেশের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিবেদনসহ আলোকিত সমাজগড়ার জন্য শিক্ষার প্রতি অনুরাগ, মানবতার কল্যাণ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, মানব আত্মার মুক্তি সর্বোপরি জীববোধের উচ্চারণ উদ্ভাসিত হয়েছে। গানের পঙক্তিমালায় কিংবা তার শাখা প্রশাখায় সারল্যের গতি প্রবাহমান। গ্রন্থভূক্ত গানের মধ্যে কখনো অক্ষরবৃত্তের আবার কখনো স্বরবৃত্তের দোলা অনুভব করা যায়। একজন পল্লীগায়ের সাধারণ শিল্পী থেকে শুরু করে আধুনিক শহরের শিল্পীরাও স্বাচ্ছন্দে তাঁর গান পরিবেশন করতে পারবেন। সেই সাথে বলা যায়, গানে গানে যে ম্যাসেজ বা বার্তা গীতিকার দিয়েছেন তাও পাঠক-শ্রোতারা সহজেই আত্বস্থ করতে পারবেন। এখানে পাঠক-শ্রোতাদের জন্যে পরশমণি থেকে পাঁচটি গানের অংশ বিশেষ উল্লেখ করা হলো;
এক) সারা জাহান হয় উজালা দয়াল নবীর রহমতে
আওরে আসিক দলে দলে রওজা শরীফ জিয়ারতে।।
… … … … … …
রওজা শরীফ করিলে তোয়াফ
গোনা কছুর হয় যে মাফ
কুদরতি সাবানে ছাক
আল্লা তালার বরকতে।। (পৃষ্টা-৮)

দুই) জন্ম আমার বাংলাদেশে
ধন্য তারে ভালোবেসে
জীবন কাটাই হেসে হেসে, হাসি অনিঃশেষ।।

টিয়া, ময়না, দোয়েল, কোকিল
ঘুঘু, বুলবুল, মাছরাঙা, চিল
নদীনালা অসংখ্য বিল সুন্দর পরিবেশ।। (পৃষ্টা-১৭)

তিন) শাহজালাল বাবারই গুণে
ধন্য এই সিলেটের মাটি
আধ্যত্মিক রাজধানী খ্যাত
অমূলক নয় এই কথাটি
ধন্য এই সিলেটের মাটি।। (পৃষ্টা-১৯)

চার) ফুটলরে ইসলামের ফুল
সিলেটের হাটে মাঠে
গৌড়গোবিন্দ পরাজিত
জালাল বাবার দাপটে।।

রইল না আর কুসংস্কার
দীন ইসলাম হইল প্রচার
যার উছিলায় পাইলাম দিদার
দয়াল বাবার নিকটে।। (পৃষ্টা-২১)

পাঁচ) শ্রদ্ধা জানাই শহিদ যারা
যাদের জন্যে দেশ পেয়েছি মোরা
দেশ প্রেমিক ছিল যারা
তাদের দয়ার দান।।

সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার
পদে পদে ছালাম সবার
কয় আব্দুল ওদুদ গোনাগার
চরণ তলে মা দিও স্থান।। (পৃষ্টা-২৬)

আমি মনে করি গীতিকারের ৫৭টি গানই উল্লেখযোগ্য অর্থ্যাৎ প্রশংসার দাবী রাখে। কেননা প্রতিটি গানের মধ্যদিয়ে সুস্থ সমাজ গঠনের শুভ জাগরণ বার্তা রয়েছে। এমন একটি গানের বই জঙ্গিবাদ কিংবা সন্ত্রাসবাদ নির্মূলেও ভূমিকা রাখতে পারে। বলা যায়, প্রকাশক নওয়াব আলী একটি গুরুত্বপূর্ণ বই প্রকাশ করেছেন। বইটির টেকশই বাঁধাই ও পরিচ্ছন্ন ছাপা আমাদেরকে বইটি হাতে নিতে প্রলুব্দ করে। গান লেখা সহজ কাজ নয়। গান লিখতে হলে গানের মধ্যেই অবিরাম বিচরণ করতে হয়। গীতিকার প্রাণের তাগিদে আমাদেরকে যে গান উপহার দিয়েছেন, তা আমাদের গানের জন্যে অমূল্য সম্পদ। তাঁর এই গান গুলি বর্তমান সময়ের জন্যই নয়. ভবিষ্যত প্রজন্মকেও অনুপ্রাণিত করবে বলে আমি মনে করি। মরমী কবি হাছন রাজা, দুর্বিণ শাহ, আরকুম শাহ, রাধারমণ, বাউল স¤্রাট আব্দুল করিমের উত্তরসূরি গীতিকার শাহ আব্দুল ওদুদও সবার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারবেন বলে আশা করা যায়। তাঁর রচিত সমগ্র গান সেই ইঙ্গিতই আমাদেরকে দিচ্ছে।

শিউল মনজুরঃ কবি ও কথাসাহিত্যিক।

Developed by: