পংক্তিস্বজন : স্বজনের ভালোবাসার লোভে বিজন প্রান্তরে পড়ে থাকে হিজল তমলের ছায়া

H-10সাইদুর রহমান সাঈদ
সাহিত্যের সবচেয়ে কঠিন বিষয় হচ্ছে কবিতা। একাগ্রচিত্তে নিরন্তর অনুশীলন না করলে কবিতা লেখা সম্ভব নয়। কঠোর পরিশ্রমীরাই কবি হতে পারেন। জীবন-জীবিকার তাড়নার পাশাপাশি সৃজনশীল মানুষকে কবিতা লেখার তাড়নাও আন্দোলিত করে। তাই সুদূর যুক্তরাজ্যে শতকর্মব্যস্ততার মাঝেও অনেকেই নিয়মিত সাহিত্য চর্চায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার গৌরব অর্জন করেছেন। এ ছাড়া কবিতার মতো বিশুদ্ধ শিল্প মানুষের মধ্যে ঐক্যবোধ সৃষ্টি করে। যার ফলশ্র“তিতে আমরা পেয়েছি যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী ৯জন কবির যৌথ কাব্যগ্রন্থ ‘পংক্তিস্বজন’। যৌথভাবে কাব্যগ্রন্থ পকাশ তাদের ঐক্যবোধ ও আন্তরিকতার পরিচায়ক। এ গ্রন্থটি সম্পাদনা করেছেন এম মোসাইদ খান। সিলেটের বাসিয়া প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত এ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশকাল হচ্ছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা- ২০১৬। চমৎকার প্রচ্চদে ঝকঝকে ছাপা সাড়ে ৬ ফর্মার এ কাব্যগ্রন্থটি হাতে নিলেই খুলে দেখতে ইচ্ছে হয়। সেটআপ, গেটআপ, বাঁধাই সবকিছুই চমৎকার। এ যৌথ কাব্যগ্রন্থটি উৎসর্গ করা হয়েছে সকল ‘মা’কে। এ বিষয়টি অত্যন্ত প্রশংসনীয়। এটি মায়ের প্রতি তাদের অকৃত্রিম ভালোবাসার প্রকাশ। এটি মায়ের কাছে চিরঋণী হিসেবে মায়ের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাপ্রদর্শন।
যাদের কবিতা বুকে ধারণ করে ‘পংক্তিস্বজন’ আত্মপ্রকাশ করেছে তারা হলেন, এ কে এম আবদুল্লাহ, আবীর ইসলাম, আসমা মতিন, মোহাম্মদ ইকবাল, ইকবার বাহার সোহেল, ফাহমিদা ইয়াসমিন, মুহাম্মদ মুহিদ, মো. ওয়াছি উদ্দিন তালুকদার রায়হান ও এম মোসাইদ খান। পংক্তিস্বজনে প্রত্যেক কবির পরিচিতি ও প্রকাশিত গ্রন্থের নাম তোলে ধরা হয়েছে। বিভিন্ন স্বাদের কবিতার সমাহার পংক্তিস্বজন।
এ কে এম আবদুল্লাহ : তাঁর ১০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতাগুলোতে লেগে আছে ভালোবাসার রং এবং মাটির গন্ধ। অপসংস্কৃতির আগ্রাসনের আশংকা আছে। তবে বিদেশি দামী পারফিউমের গন্ধের চেয়ে বাংলার সোঁদা মাটির গন্ধের মাঝে ডুবে আছে যার জীবন তাঁর আবার আগ্রাসনের কিসের ভয়? সুদূর প্রবাসে কবি নিজের সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশে কাজ করেন তাঁর দেশপ্রেম কতো গভীর তা ব্যাখার প্রয়োজন হয় না। তাঁর ‘প্রজন্মের খুঁটি’ কবিতায় তিনি বলেছেন ‘ব্রিকলেনের গলিতে ভাবনার সমাবেশ।/ লাউয়ের নরম ডগার মতো, আমার/ নরম ডগায় নাচে সংস্কৃতির প্রজাপতি;/ কষ্টের শিথানে জ্বলে সোডিয়াম কুপি।’ শথ প্রতিকুলতার মাঝেও দেশ, জাতি, ভাষা ও সাহিত্য সংস্কৃতির নানা অনুসঙ্গ ওঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। চমৎকার উপমার ব্যবহার কবিতাকে শিল্পিত সুষমার উৎজীর্ণ করেছে। তাঁর এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘সময়ের সাথে অনেক কিছু বদলে গেলেও/ আমার কাছে আজও মাটি রং খুব পছন্দ, মাটির গন্ধও।’ তাঁর কবিতার জীবনের নানা অভিজ্ঞতা, সমাজ বাস্তবতা, রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি প্রভৃতি বিভিন্ন অনুসঙ্গ ওঠে এসেছে। এ দেশে অতিবাহিত তাঁর স্মৃতিময় দিনের কথাও আমরা কবিতার মাঝে পাই।  ‘জীবনের প্রেসরিলিজ’ কবিতার শেষ স্তবকে তিনি বলেছেন, ‘হায়, মানিক মিয়া এভিন্যুতে/ পড়ে থাকে তৃতীয় চোখ; অনুভূতিহীন/ মার্বেল পাথরের মতো।’ এখানে চমৎকার একটি চিত্রকল্প ভেসে ওঠে আমাদের চোখে। তাঁর কাব্যকৌশল ও কাব্য ভাবনাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।
আবীর ইসলাম : এ গ্রন্থে তাঁর ১০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। আমাদের ধর্মগ্রন্থ বলে, পাপীরা মৃত্যুর পর দোজখের আগুনে পুড়বে। আর কাব্যভাবনার গভীরে ডুব দিয়ে আমরা দেখি, কবিরা রক্তিম কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুনে নিরন্তর পুড়ছেন। এ আগুন একজন কবিকে তাড়িত করে। জন্ম হয় কবিতার। মনের তাড়না থেকেই কবিতা সৃষ্টি। আবীর ইসলামের কবিতায় রোমান্টিকতার আবহই বেশি। তিনি এক কবিতায় বলেছেন, ‘ঘুমুতে দেয় না অবিবাহিত সুখ/ দক্ষিণের জানালা খোলা রাখি/ বিবিধ মায়ারা দরজা খুলতে চায়/ আকাশ দেখি, আকাশে তাকাই।’ একজন কবির দৃষ্টি বিশালতার দিকেই থাকতে হয়। ‘প্রেরণা’ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘জ্যোৎস্নায় পুড়ি যখন মধ্যরাতে/ শেখাও তুমি ভালোবাসার গান।’ একজন কবি জ্যোৎস্নায় পুড়তে পারেন, ভাসতে পারেন, ডুবতে পারেন, উড়তেও পারেন। কেবল একজন কবির পক্ষেই তা সম্ভব। তাঁর কবিতায় সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ও অধপতনের কথাও ওঠে এসেছে। সমাজের নানা অসংগতির কথাও ওঠে এসেছে। তাঁর এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘অউখানো কিতা শেষ নি সবতা জীবনের/ খোলস ভেঙে গেলো উদভ্রান্ত চাতকির,/ সহস্র ঘাত-প্রতিঘাতে একটি কথার/ মানে খুঁজি জীবনের পথে, অন্ধ চোখে শুনি উত্থাল পাতাল সমুদ্রের গর্জন।’ তাঁর কাব্য ভাবনা জীবন জটিলতাকে ছুঁয়ে যেতে সক্ষম।
আসমা মতিন : এ গ্রন্থে তাঁর বিভিন্ন স্বাদের ১০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। তিনি সমাজের অন্ধকারে ডুব দিয়ে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ভেতরের বাস্তবতা উপলব্ধি করার প্রয়াস পেয়েছেন। তাঁর কবিতা পড়ে আমরা তাঁর প্রখর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় পাই। সমাজবাস্তবতাকে ভেঙেচুরে দেখার দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন আমরা তাঁর কবিতায় দেখতে পাই। তাঁর এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘ওষ্ঠে কাচ কাটা হাসি, যকৃতে নেমেছে/ অন্ধকার,/ উজাড় হয়েছিল উৎফুল্ল যৌবন/ আজ পতাকার তলে অসতীর নাম শুনি,/ বারে বার।/ কিছুই ফেরত দেয়া হয়নি প্রসূতির ঘরে/ স্বপ্ন ছিঁড়ে জন্ম দিয়েছিল বঙ্গের আকৃতি/ বিনিময়ে পেয়েছে কতগুলো কাঠের/ পুতুলের গল্প।’ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অগণিত নারীর অপরিসীম আত্মত্যাগ, অবদান ও পরিশেষে তাদের বঞ্ছনার ইতিহাস কাব্যভাষায় উপস্থাপন করে আসমা মতিন তার দেশপ্রেম ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছেন। সমাজের প্রতি কবির দায়বদ্ধতার কথা তিনি ভুলে যান নি। তাঁর কবিতায় রোমান্টিক কিংবা বিষণœতার ঋতু বর্ষার কথা আছে, এ দেশের কাদামাটির কথা আছে, প্রেম ভালোবাসার কথা আছে, বিরহ বেদনার কথা আছে, অনেক কিছুই আছে। তিনি তাঁর এক কবিতায় আবেগভরা হৃদয়ে বলেছেন, ‘পাঁজর সেঁকা দিনের ভালোবাসার শেষবিন্দু। রেখে যাব সমাধির ঘাটে,/ একবার নিতে এসো প্রিয়।’ তাঁর কবিতায় আমরা মাটি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসার টান দেখি। তাঁর কবিতার ভাষায়- ‘আপন ভূখণ্ডে প্রত্যেকটি মানুষকে ভালোবাসা,/ স্মৃতি হয়ে বইলো অতীতের দিন,/ মনে পড়ে ওখানে অবিরত ভালোবাসার টানে।’
মোহাম্মদ ইকবাল : এ গ্রন্থে তাঁর ১০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। কবিতাগুলোতে তাঁর দক্ষতা, কাব্যভাবনা ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটেছে। এর মধ্যে অস্তিত্বে অনুভব’ শিরোনামে একটি সনেট রয়েছে। এ সনেটে তিনি রোমান্টিক আবহে এক মায়াবী বেদনার মাঝে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের চমৎকার বর্ণনা এবং এর সাথে মানবজীবনের আবেগ-অনুভূতির সামঞ্জস্যের কথা তোলে ধরেছেন। এ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘নদীচরে কাশফুল ফুটে রাশি রাশি/ ধূসর আকাশে একাকী বিরহী চাঁদ/ খুনসুটিতে ব্যাকুল বুনো হংস হাঁসি।’ এ গ্রন্থে প্রকাশিত তাঁর কবিতাগুলোতে সামাজিক টানাপোড়ন, অবক্ষয়, মনস্তান্তিক জটিলতা, মানুষের জীবন সংগ্রাম, ভোগবাদী সমাজের নানা অসংগতি প্রভৃতির প্রতিফলন ঘটেছে। তিনি নিজের মতো করে কাব্যশৈলী নির্মাণের চেষ্টা করেছেন। তাঁর এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘আমি সবিসময়ে লক্ষ্য করি শির যন্ত্রণা যেনো ছিলই না কখনো,/ আমাকে খুঁজে পাই যেনো কোনো আনকোনা তাজা বিশুদ্ধ তরুণ।/ এমনি করে যদি তোমার স্পর্শে যন্ত্রণাগুরি দূরীভূত হয়/ ঘটে যাক যেকোনো শারীরিক বিপর্যয়! ভয় নেই তাতে এতটুকুও।/ কারণ তুমি আছো আমার!/ মায়াবী হস্তস্পর্শে শোষিত হবে শারীরিক সব যন্ত্রণাটুকু।’
ইকবাল বাহার সোহেল : এ গ্রন্থে তাঁর ১০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। তিনি তাঁর কবিতায় যাপিত জীবনের নানা বাস্তবতার কথা তোলে ধরেছেন। পরিবর্তনশীল এই জগতে নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে মানুষ তার লক্ষ্যের দিকে যায়। তিনি তাঁর এক কবিতায় বলেছেন, ‘প্রহরে প্রহরে রং বদল হয়/ অদৃশ্য আর অজানা মায়ায়।’ এ মায়ার জাল কেউ ছিন্ন করতে পারে না। তাই তাঁর অপর এক কবিতায় দেখি তিনি আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘অন্তিমলগ্ন/ স্বপ্ন দেখে মন,/ বেলা বাকি নেই।/ সমুদ্র তটে মলিন বদনে বসে/ সন্ধ্যা নামার দৃশ্য দেখি।/ মেঘ ডাকছে আকাশে/ কোথাও কেউ নেই।’ এক কবিতায় তিনি ঋতু বৈচিত্রের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গিয়ে চমৎকার উপমা ব্যবহার করেছেন। তিনি এ কবিতায় বলেছেন, ‘মেঘেরা নিয়েছে তুলে/ নীলাভ সড়ক থেকে সব অবরোধ/ পাতায় পাতায় নাচে/ সোনার ঘুঙুর পরা হেমাঙ্গী রোদ।’ ‘জলডুবা’ কবিতায় তিনি গ্রামীণ জনপদের চমৎকার প্রতিচিত্র অংকন করেছেন। এ কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘রাজহাঁসের ঠোঁটে ভাসা/ আমার এই জলডুবা গাঁও/ বাতাসে ফেরে স্বর্ণচাঁপা/ শিরিষ হিজল কুরচির মধুগন্ধ ভরা/ এ এক মায়াবী ভালোবাসার নাও/ প্রিয়ার চোখের জলে ভাসা/ এই জরডুবা গাঁও।’ এ কবিতাটি পাঠক হৃদয়ে দাগ কাটবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর কবিতাগুলিতে শব্দবিন্যাস বা গঠনশৈলীতে আরো দক্ষতার ছাপ রাখতে পারলে ভালো হতো।
ফাহমিদা ইয়াসমিন : এ গ্রন্থে তাঁর বিভিন্ন স্বাদের ১০টি কবিতা সংকলিত হয়েছে। কাশফুলের মতো ধবধবে সাদা জ্যোৎস্নার জোয়ারে ভাসতে চায় অনেকেই। কিন্তু চাইলেই সবার পক্ষে তা সম্ভব নয়। তবে অনেকের পক্ষেই সম্ভব। ফাহমিদা ইয়াসমিনের প্রাঞ্জলভাষায় রচিত রোমান্টিক কবিতাগুলো সেরকমই ইঙ্গিত বহন করে। এ গ্রন্থে তাঁর ‘মা’ শিরোনামের কবিতাটি চমৎকার। আর মাকে নিয়ে যাই লেখা হোক না কেনো তাকে অবহেলা করার কোনো উপায় নেই। এ ছাড়া তাঁর ‘জেগে ওঠো’ কবিতাটি সমাজের নির্যাতিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত, শোষিত মানুষের মুক্তির মিছিলের শক্তিশালী শিল্পমাধ্যম। বর্তমান বাস্তবতায় এ রকম কবিতা বেশি বেশি লেখা প্রয়োজন। কারণ শ্রমজীবী মানুষের সামগ্রিত মুক্তিই সভ্যতার আলোকে উজ্জ্বল করে তোলতে পারে। এ কবিতার তিনি বলেছেন, ‘শোষণ করে গড়ছে তারা বিশাল বিশাল বাড়ি,/ নামীদামী পোশাক-প্রসাধন আর দামী দামী গাড়ি।/ প্রতিবাদ করার কেউ নেই তাদের ইচ্ছেমতো চুষে,/ একদিন তারা পড়বে ঠিকই শ্রমিক শ্রেণির রোষে।/ জাগরে শ্রমিক, উঠরে জেগে ঘুমাবি আর কত,/ গর্জে উঠো আদায় করো দাবি তোমাদের যত।’
মুহাম্মদ মুহিদ : এ গ্রন্থে তাঁর ১০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। এ কবিতাগুলিতে কালের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর আবেগ-অনুভূতি ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে। তাঁর কল্পনাশক্তি ও অভিজ্ঞতা নানাভাবে ওঠে এসেছে কবিতায়। হৃদয়ের অনুভূতি দিয়ে তিনি সমাজকে বুঝার প্রয়াস পেয়েছেন। এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘ফুলগুলি ঝরে নীরবে ভাঙে স্বপ্নের বুক,/ হতাশার বিস্তার ঘটে জল গড়ানোর মতো করে।/ বিশুদ্ধতার জমিনে জমে পাপের পলি,/ নকল আলোর ঝলকানিতে সাজে অন্ধগলি।’ সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, প্রাপ্তি-প্রত্যাশার ভেতর দিয়েই চলমান জীবন। মানুষ হিসেবে আমরা এর বাইরে যেতে পারি না। তবে অন্ধকার ঠেলে আলোর জগতের দিকে যাত্রাই মানুষের মূল লক্ষ্য। তবে এ লক্ষ্যের দিকে যাত্রাপথে নানা বাঁক পরিবর্তনকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। তার এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘সোনালি দিনের গল্প/ কালে কালে অভিন্ন রয় না বইয়ের পাতায়,/ মানুষের ইচ্ছের ইতিহাস পাল্টে কত/ অস্পষ্ট বোধের পাহাড় জমে।’ কাল থেকে মহাকালের দিকে যাত্রায় মানুষ অনেক কিছুই দেখে এবং উপলব্ধি করে। এক কবিতায় বলা হয়েছে, ‘মহাকালের আলোর গোলক হাসে সরস উল্লাসে,/ রুদ্রের বিছানায় উষ্ণ অনুভব-সবুজ/ নাচে হাওয়ার বৃক্ষ ও প্রান্তরে।’ এ জগতের মায়াজালে মানুষের ছায়াও আটকে যায় কোনো কোনো সময়। তারপরও এক হৃদয়জ তাড়নায় আমরা ছায়ার পেছনেই ঘুরি। মুহাম্মদ মুহিদ তাঁর এক কবিতায় বলেছেন, ‘অনন্ত অন্ধকারে ছায়াগুলি অদৃশ্য হয়ে যায়।/ ইচ্ছের বাগানের ফুল ঝরে পড়ে অবহেলায়,/ দেখা হলো না আর/ জীবনের ভাঁজে ভাঁজে গুঁজে থাকা অতৃপ্ত বাসনার গোলাপ।’
মো. ওয়াছি উদ্দিন তালুকদার রায়হান : এ গ্রন্থে তাঁর ১০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। তাঁর কবিতায় তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর অবস্থা ও অবস্থান, মুক্তিযুদ্ধে মানুষের অনন্য সাধারণ ভূমিকা, অবরুদ্ধ নয়মাসে মানুষের দুঃখ-দুদর্শা, মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী স্বাধীনতা বিরোধী ঘাতক-দালাল রাজাকার-আলবদর গোষ্ঠীর দৌরাত্ম প্রভৃতি বিষয়গুলোকে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তোলেছেন। তাঁর কবিতায় ওঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুসঙ্গ। বিশেষ করে ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতিকে ধারণ করেছে তাঁর কবিতা। রাজনীতির নামে মানুষকে পুড়িয়ে মারার বিষয়ও স্থান পেয়েছে তাঁর কবিতায়। মুক্তিযোদ্ধাদের অবহেলার কথা তিনি ক্ষোভের সাথে তোলে ধরেছেন তাঁর কবিতায়। তাঁর এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘ইদ্রিছ আলী ঝুড়ি বুনে/ সাহসী শাহজাহান ইটের ভাটায় ইট পোড়ায়। তাতে কোনো দুঃখ নেই তফাজ্জল মিয়ার/ তবু তার চোখ হয়ে ওঠে ছলছল/ নীরবে ঝরে বিজয়ী সে চোখের গরম নোনাজল/ বিজয়ের দিনে অনুযোগে বলে,/ ‘মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে কিনে নেয় মাসুদ সিদ্দিকীর দল।’ মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভৎস রাজনীতি ও রাজনীতি ব্যবসার বিরুদ্ধে সোচ্চার তাঁর কবিতা। তাঁর সাহসী উচ্চারণ ‘ভয়ার্ত চোখ আর কতোকাল রবে ভয়ের আঁধারে/ অসুক প্লাবনে আর কতো ভাসবে সাদা রঙের প্রাণ?/ চোখ রাঙিয়ে তাকাও একবার সম্মুখ পানে।/ হারামিরা মাথাগুলো গুজবেই শ্মশানে কিংবা গোরস্তানে।’ মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বিভীষিকাময় দিনের কথা ওঠে এসেছে তাঁর কবিতায়। তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন এসব বিষয় নিয়ে। তিনি বলেছেন, ‘প্রতিদিনের মতো মুঠোফোনে সেই একজনের কণ্ঠ/ স্বাধীনতা দিবসেও পরবাসী চোখের ঘুম ভাঙালো/ বড় আব্বু আজকে আমাদের স্বাধীনতার দিন/ তোমাদের কোনদিন?/ স্বাধীনতার শুভেচ্ছা তোমাকে/ ঘুমের ঘোরেই জবাব দিলাম সবুজ প্রজন্মকে,/ আমাদের প্রতিদিনই স্বাধীনতার দিন।’ অপর এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘পিপাসার শবযাত্রায় খুঁজে পাই,/ পাশের বালিশে নিথর দেহে/ চিকন শ্যামা চেনা মানুষটি শুয়ে আছে/ সমস্ত ঘরজুড়ে/ ছড়িয়ে ছিটিয়ে হাজার রকম মায়ার ধূপ।’ তাঁর কবিতায় দেশপ্রেম ও ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্বশীলতার পরিচয় চমৎকার ভাবে ফুটে ওঠেছে। আদর্শবাদী মানুষকে হত্যা করা যায়, প্রতিষ্ঠান পোড়ানো যায়, কিন্তু আদর্শকে ধ্বংস করা যায় না- এই শ্বাশত সত্যকেও বুকে ধারণ করেছে তাঁর কবিতা। শত হতাশার মাঝেও কবিতা মানুষকে সাহসী করে তোলে। মানুষ আশায় বুক বাঁধে। তিনি তাঁর এক কবিতায় বলেছেন, ‘একখানা জীবন আমার বুকে ধুঁকে বেঁচে থাকে,/ বিবর্ণ দুইখানা চোখকে দুইখানা এনার্জি বাল্ব করে/ মন ঘরে জ্বালিয়ে রাখার আশায়,/ একখানা বিধ্বস্ত মুখকে এক ফালি চাঁদ রূপে।/ মন গগনে চিরস্থায়ী আবাসন গড়ে দেয়ার কল্পনায়।’
এম মোসাইদ খান : এ গ্রন্থটি তিনি সম্পাদনা করেছেন এবং এতে তাঁর ১০টি কবিতা ছাপা হয়েছে। তাঁর কবিতায় তিনি সমাজ ভাবনা, জীবনবোধ ও যাপিত জীবনের নানা চিত্র বৈচিত্রকে শিল্পময় করে তোলেছেন। সমাজের নানা অসংগতি, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, মনস্তান্তিক জটিলতা প্রভৃতি সবকিছুই এসেছে তাঁর কবিতায়। তাঁর এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘পুরাতন ভাঙা চশমায় নতুন অন্ধকার/ নির্বীক পৃথিবীর/ অবাক চোখ দখলদার হাতের মৃত্যু ব্যবসা।’ চরিত্রহীন মানুষের ইতরামী তাকে পীড়া দেয়। কবিতার ভাষায় তিনি তুলে ধরেন মানুষ নামধারী পশুদের অপকর্ম। তিনি বলেন, ‘নাড়ির গিট্র আঙ্গুলের ভাঁজ/ ছিঁড়ছে কতো হেঁচকা টানে/ পশুর ভেতর দৌড়ে মানুষ/ ডুবছে দেখো স্বার্থস্নানে।’ সমাজের নানা অবক্ষয় ও অধপতন ধরা পড়েছে তাঁর কবিতায়। চমৎকার ্উপমা উৎপেক্ষা চিত্রকল্পের ব্যবহার তাঁর কবিতাকে শক্তিশালী করেছে এবং প্রাণসঞ্চার করেছে। এক কবিতায় তিনি বলেছেন, ‘ঝড়ের উৎসবে বৃষ্টি মাঝে রাজ-রাজ কপালে/ অনাদরী হাতের ফাঁক গলে/ তারারা খসে পড়ে সুদুর গৃহে,/ নির্বোধ কাঁপে ডুবে থাকে দিনমান/ রাতের পেয়ালায় লাল-নীল চোখ।’ তিনি যুক্তরাজ্যে বসবাস করলেও প্রতি পলে পলে শিকড়ের টান অনুভব করেন। যেমন- ‘মনন মজ্জায় শিকড়ের টান,/ দেখি মমত্ববোধের দীর্ঘ মিছিল।’ অন্য এক কবিতায় তিনি বলেছেন, একচোখা আলোর মোহময় ভঙ্গিতে/ মঞ্চ মাতিয়ে রাখে নিরূপম ছায়া/ সুখের সপ্তডিঙ্গায় কতো দুঃখের বিলাস। প্রমত্তা অসুখে যতো সুখ সুখ ভান/ চামড়ার গভীরে লাল-নীল কষ্ট।’

Developed by: