ঈদের ছুটি এবার একটু আফসোসের মধ্য দিয়ে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। ছুটির দুদিনই যে পড়ে গেছে সাপ্তাহিক সরকারি ছুটির মধ্যে! তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাশরাফি বিন মুর্তজার ইচ্ছা পূরণ করলে দেশবাসীর ঈদের আনন্দ বেড়েও যেতে পারে। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জয়ের আনন্দ উদ্যাপন করতে কাল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে ঈদে সবার জন্য এক দিন বাড়তি ছুটির আবদার করেছেন বাংলাদেশের ওয়ানডে অধিনায়ক।
মাশরাফির ইচ্ছাপূরণ প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তবে ঈদের ছুটির আগেই যে বাংলাদেশের মানুষ ঈদ-আনন্দে উদ্বেল, সেটা এসেছে মাশরাফি বিন মুর্তজার দলের হাত ধরেই। পাকিস্তান, ভারতের পর কাল দক্ষিণ আফ্রিকাকেও উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ।
গোটা দেশেই যখন উৎসবের রং, আনন্দের উৎসমূলের আবহটা একবার চিন্তা করুন। সিরিজ জয়ের পর কেমন ছিল কাল রাতের জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম? ড্রেসিংরুমে ফেরার পথে কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহে বলছিলেন, ‘আমার চেহারা দেখে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন কতটা খুশি আমি। টানা তিনটি ওয়ানডে সিরিজ জিতেছে ওরা। এটা অসাধারণ। আমি কোনোটাকেই কোনোটার চেয়ে এগিয়ে রাখব না। একটার চেয়ে আরেকটা অনন্য।’ শেষ ম্যাচে সৌম্যের ব্যাটিং চোখ জুড়িয়ে দিয়েছে শ্রীলঙ্কান কোচের। তবে আলাদা করে বললেন তামিম ইকবালের কথা, ‘তামিম যেভাবে ফর্মে ফিরল, এককথায় দুর্দান্ত।’
সেই তামিম মাঠ ছাড়ার সময় অনুমিতভাবেই আটকে গেলেন সেলফি-শিকারিদের জটলায়। তার ভেতর থেকে মাথা বের করে জানাচ্ছিলেন সিরিজ জয়ের প্রতিক্রিয়া, ‘দলের সাফল্য মূল্যায়নের আমি কেউ নই। আপনারাই দেখতে পাচ্ছেন এটা কত বড় সাফল্য।’ তামিমের বাকি কথাগুলো হারিয়ে গেল ভিড়ের মধ্যে। পরে মুঠোফোনে জানালেন ‘কাম ব্যাক ইনিংস’ কতটা তৃপ্তির, ‘কয়েকটা ম্যাচ খারাপ খেলে একটু চাপেই পড়ে গিয়েছিলাম। চারদিকে সমালোচনা শুরু হয়ে গিয়েছিল। এসবের মধ্যে এভাবে ফিরে আসা আসলে সব সময় সম্ভব নয়। তারপরও সেটা করতে পারায় খুব ভালো লাগছে।’
তামিমের মতোই অনুভূতি মাহমুদউল্লাহ আর সাব্বির রহমানের। ‘চোট থেকে ফিরেই এমন একটা অর্জন আমার জন্য অনেক বড়।’—বলছিলেন মাহমুদউল্লাহ। সবার শেষে ড্রেসিংরুমে ফিরতে পেরেছেন সাব্বির। কেমন লাগছে এমন গৌরবের অংশ হতে পেরে? সাব্বিরের উত্তর, ‘খুবই ভালো লাগছে। এই সিরিজেই আমরা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলা নিশ্চিত করলাম। আনন্দটা তাতে আরও বেড়ে যাচ্ছে।’
খেলা শেষে প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদকে মনে হচ্ছিল সুখী মানুষদের প্রতিনিধি। সংবাদ সম্মেলনে যাওয়ার পথে সিরিজ জয়ের আনন্দের ভাগ অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা দিয়ে যান জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়ামের ১৮ জন মাঠকর্মীকেও। কিউরেটর জাহিদ রেজাকে বলে গেলেন দলের পক্ষ থেকে সব মাঠকর্মীর জন্য ঈদের বিশেষ বোনাস ঘোষণা করতে।
সিরিজ জয়ের বাইরে ওয়ানডেতে ২০০ উইকেট পাওয়ারও আনন্দ ছিল মাশরাফির, ‘ব্যক্তিগত কোনো অর্জনের দিনে ম্যাচ না জিতলে খারাপ লাগে। এখন খুব ভালো লাগছে, দুই শ উইকেট পেয়েছি। এটা যদিও বিশ্ব ক্রিকেটে খুব ছোট একটা ব্যাপার, কিন্তু আমার জন্য অনেক বড়। কারণ, আমার জীবন অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে গেছে।’ প্রথম ম্যাচে হেরেও ঘুরে দাঁড়াতে পারাটাই মাশরাফির কাছে বেশি তৃপ্তির। এর পুরো কৃতিত্ব দিলেন সতীর্থদের। বড় বড় দলকে নিয়মিত হারানোটা একসময় বাংলাদেশের জন্য স্বপ্নবৃত্তেই ঘুরপাক খেত। এখন সেটা অ্যাডিলেড, ঢাকা, চট্টগ্রাম—সবখানেই বাস্তব। তবে অন্য সব সময়ের চেয়ে সাফল্যে রঙিন এই সময়টাকেই বেশি চ্যালেঞ্জিং মনে করেন বাংলাদেশ অধিনায়ক। চ্যালেঞ্জ সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রাখার।
ওয়ানডেতে দক্ষিণ আফ্রিকা দলে এবি ডি ভিলিয়ার্সের না খেলাটাকে আশীর্বাদ মনে হচ্ছে অধিনায়কের কাছে, ‘ডি ভিলিয়ার্স খেললে আমরা সিরিজটা হারতেও পারতাম। ওর না খেলা দক্ষিণ আফ্রিকার যেকোনো প্রতিপক্ষের জন্যই স্বস্তির।’ সঙ্গে সঙ্গেই অবশ্য মনে করিয়ে দিয়েছেন, ডি ভিলিয়ার্স ছাড়াও প্রোটিয়া দলে তারকার অভাব নেই।
আসলেই তো! হাশিম আমলা, জে পি ডুমিনি, ডেভিড মিলারদের তুলনায় কোথায় বাংলাদেশের ক্রিকেটাররা? তারকা দ্যুতিতে প্রোটিয়ারাই তো বেশি উজ্জ্বল! মাশরাফি অবশ্য একটু অন্য ধারণায় বিশ্বাসী, ‘আমাদের দলে বড় ক্রিকেটার নেই, এটা অন্তত আমরা মনে করি না। হয়তো অন্যরা এটা বলে না। সাকিব যে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, এটা অনেক খেলোয়াড়ই বলে না। তবে এ নিয়ে আমাদের কোনো দুঃখ নেই। আমরা জানি, আমাদের ভেতরে কী আছে।’
এখন বোধ হয় সেটা জেনে গেছে গোটা ক্রিকেট বিশ্বই।