রক্তের আখরে লেখা শোকাবহ ১৫ আগস্ট

04আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব, সাহসিকতা ও নির্ভীকতায় এই ব্যক্তি হিমালয়। আমি ওই ঘটনায় হিমালয় প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।’’- কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো এভাবেই বঙ্গবন্ধুকে মূল্যায়ন করেছিলেন। আলজেরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর তার(বঙ্গবন্ধুর) অসাধারণ নেতৃত্বের প্রতি সম্মান জানাতে গিয়ে কাস্ত্রো এ মন্তব্য করেন।

এর দু’বছর পরই বাঙালিকে হারাতে হয় এই পর্বতসম এই মহান নেতাকে। ঘাতকের বুলেট তাকে কেড়ে নেয় বাঙালির কাছ থেকে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট প্রতিক্রিয়াশীল ঘাতকচক্রের হাতে সপরিবারে জীবন দিতে হয় বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

১৫ আগস্ট জাতীয় শোকদিবস। মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডটি ঘটে এই দিনের সূচনালগ্নে। মানবতার শত্রু স্বাধীনতাবিরোধী চক্র সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করে ইতিহাসের গায়ে কালিমালেপন করে।

হাজার বছরের নির্যাতিত, শোষিত, বঞ্চিত আর অধিকারহীন পুর্ববাংলার অধোমুখ বাঙালিকে সংগঠিত করে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবিত করেন শেখ মুজিবুর রহমান। দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা, ভূষিত হন ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ডাকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ এ দেশের মুক্তিকামী মানুষ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অসীম ত্যাগ আর তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। সেই সঙ্গে বিশ্ব একটি স্বাধীন জাতির অভ্যুদয় ঘটে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বাঙালি অধিষ্ঠিত করে তাদের জাতির পিতার আসনে। সেই বঙ্গবন্ধুকে ঘাতকের হাতে জীবন দিতে হয়।
’ক্ষণজন্মা যে পুরুষ বাঙালি জাতির হাতে তুলে দিয়েছিলেন স্বাধীনতার উজ্জ্বল পতাকা, দিয়েছিলেন একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র, সপরিবারে তাকেই বুক পেতে দিতে হয়েছে ঘাতকের বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়ার ‘দন্ড’।’

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরদিন ১৬ আগস্ট ভারতীয় বেতার ‘আকাশবাণী’ তাদের সংবাদ পর্যালোচনা অনুষ্ঠানে বলে … ’’যিশু মারা গেছেন। এখন লক্ষ লক্ষ লোক ক্রশ ধারণ করে তাকে স্মরণ করছে। মূলত একদিন মুজিবই হবেন যিশুর মতো।’’ আজকের বাস্তবতায় আকাশবাণীর সেই পর্যালোচনা বঙ্গবন্ধুর যথার্থ মূল্যায়ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জাতির পথপ্রদর্শক হিসেবেই বঙ্গবন্ধু তাদের হূদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। প্রতিবছর এই দিনটিতে জাতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও গভীর শোকে বঙ্গবন্ধুকে স্মরণ করে। দিনটি জাতীয় শোকদিবস হিসেবে প্রতিবছরের মতো এবারও পালিত হচ্ছে। এবছরই বঙ্গবন্ধুর ৪০তম শাহাদাৎবার্ষিকী। দিনটিকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে। জাতীয় পতাকা অর্ধনমিত ও শোকের কালো পতাকা শোভা পাচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয়। টুঙ্গিপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর সমাধিতে এবং ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুলেল শ্রদ্ধা নিবেদন করা হবে দিনভর।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয় … ’’বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ লোক শেখ মুজিবের জঘন্য হত্যাকাণ্ডকে অপূরণীয় ক্ষতি হিসেবে বিবেচনা করবে।’’ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের চার মুলনীতি-ধর্মনিরপেক্ষতা, বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ভুলুণ্ঠিত হয়। স্বাধীনতার চেতনা ও মুল্যবোধকে পদদলিত করে উল্টো পথে সেই পশ্চাদপদ পাকিস্তানি হীন ভাবধারার দিকে ধাবিত হয় বাংলাদেশ। আবারও বাঙালির ঘাড়ে জেঁকে বসে সামরিক স্বৈরশাসনের জোয়াল।

স্বাধীনতার পর জাতির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর গৃহীত পদক্ষেপগুলোকে বন্ধ করে দিয়ে এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবোধকে চিরতরে নস্যাৎ করতে চালানো হয় সব ধরনের অপপ্রয়াস। দেশে হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয়ে যায়। ষড়যন্ত্র, পাল্টা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একের পর এক সামরিক স্বৈরশাসনের পালাবদল হতে থাকে। সেই সঙ্গে সামরিক স্বৈরশাসকদের ছত্রছায়ায় দেশে স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত গোষ্ঠী, উগ্র সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটে। কলুষিত হয়ে পড়ে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ। সুস্থ ধারার রাজনীতির প্রেক্ষাপটটাকে বদলে দিয়ে অসুস্থ ধারার রাজনীতির ক্ষেত্র তৈরি করা হয়। স্বাধীনতাবিরোধী দেশীয় ও প্রতিক্রিয়াশীল আন্তর্জাতিক চক্র বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতাকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। সাম্প্র্রদায়িক রাজনীতিকে পুনর্জন্ম দান ও পুনর্বাসন করা হয়।

ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাঙালি স্বাধীনতা, স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনে এবং স্বাধীনতার পর দেশগঠনে বঙ্গবন্ধু ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ। তার অতুলনীয় গণমুখি নেতৃত্বে বাঙালি জাতি দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম এবং ৫২, ৬২, ৬৬, ৬৯, ৭০-এর চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ১৯৭১-এ এসে উপনীত হয়। পাকিস্তানি সামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ অসহযোগ আন্দোলনের এক পর্যায়ে ৭১-এর ৭ মার্চ ঐতিহাসিক ভাষণে জনগণের ভোটে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধু বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার দিকনির্দেশনা দিতে বাধ্য হন। বঙ্গবন্ধু এই দিন তার ঐতিহাসিক ভাষণে পাকিস্তানের দুঃশাসনে পিষ্ট বাঙালিকে ‘’ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’’ তোলার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘’এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ।‘’ বঙ্গবন্ধুর এই ডাকে সাড়া দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয় বাঙালি। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল দ্য নিউজউইকে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যা দেয়া হয় , ‘পয়েট অব পলিটিক্স’ (রাজনীতির কবি)। এ ম্যাগাজিন তার প্রচ্ছদে বঙ্গবন্ধুকে উত্সর্গ করে তাকে ‘স্বাধীনতার প্রতীক’ বলে বর্ণনা করে। একই সঙ্গে প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়, ’’মুজিব তার সমাবেশের লাখ লাখ জনতাকে আকৃষ্ট এবং তন্ময় করে তাদের বজ্রমুষ্টি উত্তোলিত করতে পারতেন। তিনি রাজনীতির কবি। তাই এ অঞ্চলের সকল শ্রেণি ও আদর্শের লোককে ঐক্যবদ্ধ করার জন্য তার পদ্ধতিই ছিল সঠিক।’’

স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির পিতার আসনে ভূষিত হওয়ায় বিশ্ব নেতৃবৃন্দ তাকে জনগণের জন্য নিঃস্বার্থ সংগ্রামী সম্মোহনী শক্তিসম্পন্ন বিশ্বব্যক্তিত্ব হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ব্রিটিশ রাজনীতিক লর্ড ফেন্যার ব্রোকওয়ে বলেছিলেন, ‘’শেখ মুজিব জর্জ ওয়াশিংটন, গান্ধী এবং দ্য ভ্যালেরার চেয়েও মহান নেতা।’’

দ্য নিউজউইক লন্ডন অবজারভারে সাংবাদিক সাইরিল ডান লেখেন, ’’বাংলাদেশের হাজার বছরের ইতিহাসে শেখ মুজিব হলেন একমাত্র নেতা যিনি রক্ত, ভাষা, সংস্কৃতিতে একজন পরিপূর্ণ বাঙালি। তার কণ্ঠ বজ্রের মতো। তার সম্মোহন ক্ষমতা জনগণের ওপর জাদুর মতো কাজ করে। তার সাহস এবং উচ্ছলতা বর্তমান সময়ে তাকে অতিমানবে পরিণত করেছে।’’

বাংলাদেশ যারা চায়নি সেই স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী, দেশি-বিদেশি চক্র বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত শুরু করে স্বাধীনতার পরপরই। বঙ্গবন্ধুর এই নৃশংস হত্যাকান্ডের সঙ্গে ওই চক্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত ছিল। এর পরও দেশ পরিচালনায় বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ও দূরদর্শী পদক্ষেপে অল্প সময়ের মধ্যেই সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে থাকে। বঙ্গবন্ধুর এই সফলতা ও উন্নতির দিকে এগিয়ে যাওয়ার গতি বুঝতে পেরেই ষড়যন্ত্রকারীরা ঠান্ডা মাথায় তাকে খুন করে।

’’কোনো কোনো মৃত্যু আছে পাখির পালকের মতো হালকা, আবার কোনো কোনো মৃত্যু আছে পাহাড়ের চেয়েও ভারি’’—চীনের বিপ্লবী নেতা মাও সে তুং-এর বিখ্যাত উক্তিটি যথার্থ। বঙ্গবন্ধুর মুত্যুতে বাঙালি জাতির যে ক্ষতি হয়েছে তা পাহাড়সমান।

১৫ আগস্ট ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর একমাত্র ভাই শেখ আবু নাসের, বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ পুত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শেখ কামাল, দ্বিতীয় পুত্র বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তরুণ কর্মকর্তা মুক্তিযোদ্ধা শেখ জামাল, সর্বকনিষ্ঠ সন্তান শিশুপুত্র শেখ রাসেল। ঘাতকরা হত্যা করে জাতির জনকের নবপরিণীতা পুত্রবধূ দেশবরেণ্য অ্যাথলেট সুলতানা কামাল ও রোজী জামাল, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান শেখ ফজলুল হক মণি ও তার অন্ত:স্বত্বা স্ত্রী বেগম আরজু মণিকে। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য কৃষকনেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তার ছোট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত, কনিষ্ঠ শিশুপুত্র আরিফ সেরনিয়াবাত, নাতি সুকান্ত আবদুল্লাহ বাবু, ভাইয়ের ছেলে শহীদ সেরনিয়াবাত, আবদুল নঈম খান রিন্টু, বঙ্গবন্ধুর জীবন রক্ষায় এগিয়ে আসা বঙ্গবন্ধুর প্রধান নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমেদকে। এছাড়া কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও সেদিন হত্যা করা হয়।

Developed by: