অপার সম্ভাবনাময় সিলেটের পর্যটন

সমতল ভূমির এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে সুউচ্চ পাহাড়। পাহাড়ের গায়ে খেলা করছে সাদা মেঘ। বৃষ্টি হলে পাহাড় বেয়ে নেমে আসা ঝর্ণাধারার জলে চিকচিক করে সূর্য। অনতিদূরে হাওর। হাওরের বুকে নানা জাতের পাখির ডুবো খেলা। পাহাড়-সমতল-জলাভূমির এমন অপূর্ব সৌন্দর্যের দেখা মেলে কেবল সিলেটে। এ অঞ্চলের মাটির নিচে প্রকৃতি যেমন লুকিয়ে রেখেছে মূল্যবান সম্পদ তেমনি উপরে মেলে ধরেছে তার অপরূপ সৌন্দর্য। আর শাহজালালের (রাহ.) চরণ স্পর্শে এ অঞ্চলে তৈরি হয়েছে আধ্যাত্মিকতার ছায়াময় পরিবেশ। জালালি কইতরের ডানা ঝাপটানো আর বাক-বাকুমে ঘুম ভাঙে এখানকার অধিবাসীদের, কমলা লেবু আর চায়ের পাতার ঘ্রাণ পাগল করে তোলে তাদের হৃদয়। প্রকৃতির কোলে বেড়ে উঠা এ জনপদের মানুষের কণ্ঠে তাই খেলা করে প্রকৃতিরই সুর। তাই সুরমার তীর ভরে উঠে হাছন-রাধা রমন আর করিমের দরাজ কণ্ঠে। সব মিলিয়ে হাজার বছরের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যে লালিত এ জনপদ তাই সারা দেশের কাছে পরিচিত পর্যটন নগরী হিসেবে। প্রকৃতির উদারতা সিলেটকে করেছে পর্যটনসমৃদ্ধ। পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা সত্ত্বেও সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের অভাবে এ সম্ভাবনার বিকাশ ঘটছে না। পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানো সম্ভব হলে এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক অবস্থার আমূল পরিবর্তন হতো বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।

সিলেটের পর্যটনের বিচিত্রতা :
সিলেট পর্যটনে অপার সম্ভাবনারই এক প্রতিশব্দ। যুগে যুগে এই জনপদের রূপ-লাবণ্যের টানে ছুটে এসেছেন পর্যটকেরা। বিশ্বখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা, রূপ পিয়াসী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-কে নেই সে তালিকায়। সিলেটের রূপে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ জনপদের নাম দিয়েছিলেন ‘শ্রীভূমি’। বৈচিত্র আর সৌন্দর্যের কারণে সিলেটের পর্যটন ক্ষেত্রগুলোর আকর্ষণ কখনওই ফুরোবার নয়।

রূপের খনি :
প্রকৃতি যেনো সিলেটকে নিজের মতো করে সাজিয়েছে। সৌন্দর্যের ভা-ার এখানটাতে উপুড় করে দিয়েছে প্রকৃতি। অকৃপণ হাতে সাজিয়েছে এই অঞ্চলের রূপ-লাবণ্য। সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরো একধাপ বর্ণিল করেছে উত্তরে ভারতের প্রায় ৪৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পর্বতমালা। সিলেটে বেড়াতে এসে পর্যটকরা সীমান্তের ওপারের বাড়তি সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারেন খুব সহজেই। প্রকৃতিকন্যা হিসেবে পরিচিতি পাওয়া জাফলং বেড়াতে এসে পর্যটকরা হারিয়ে যাওয়ার সুযোগ পান খাদিম রেইন ফরেস্ট, পান্না সবুজ জলের লালাখাল, দেশের প্রথম সমতল চা বাগান, তামাবিলস্থ গ্রিনপার্ক এবং পাহাড়, নদী ও জলধারার অপূর্ব মিশেল পাংথুমাইয়ে। আর বাড়তি পাওনা-বর্তমানে দেশের পর্যটনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ রাতারগুল। এশিয়ার ২৬টি জলাবনের অন্যতম গোয়াইনঘাটের রাতারগুল না দেখলে সিলেটের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ অসম্পূর্ণ থেকে যাবারই কথা। উত্তরে সিলেট নগরীর সীমানা পেরুলেই দেখা যাবে থরে থরে সাজানো চা বাগান। লাক্কাতুরা, মালনিছড়া আর তারাপুর চা বাগানে নারী শ্রমিকদের চা চয়নের দৃশ্যে স্থির হয়ে যায় পর্যটকের চোখ। সিলেটজুড়ে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা নদীগুলোও আলাদা দেশের অন্য এলাকা থেকে। কোনটা স্বচ্ছ জল, কোনটা সীমান্তরেখা বরাবর বয়ে চলা অথবা কোনটা পাথর কোয়ারির জন্য পর্যটকদের চোখ আটকে রাখে। আর সমুদ্রসম হাকালুকি হাওরের মায়া কাটানো কি সম্ভব।

সিলেটের মতো টিলা, পাহাড়, ঘনসবুজ বন আর চা বাগানে সাজানো না হলেও সুনামগঞ্জে প্রকৃতি তার উদারতা মেলে ধরেছে বিশাল জলরাশির মাঝে। তাইতো টাঙ্গুয়ার হাওর ইতোমধ্যে পর্যটকদের কাছে পরিচিতি পেয়েছে ‘মিনি সমূদ্র’ হিসেবে। আর তাহিরপুরের যাদুকাটা বা বারেক টিলার সৌন্দর্যের টানে পর্যটকরা দূর্গম পথে পা বাড়াতেও দ্বিধা করেন না।

সিলেটের ঐতিহ্য চা আর কমলা ভা-ারের প্রকৃত রূপ দেখতে হলে যেতে হবে মৌলভীবাজারে। শ্রীমঙ্গলের চা বাগান, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান, মাধবকুন্ড, পরিকুন্ড, হামহাম মৌলভীবাজারের পর্যটনকে অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে। আর এর সবটুকুই কেবল প্রকৃতির কল্যাণে। সিলেট বেড়াতে এসে মাধবকুন্ড জলপ্রপাত দেখতে না পারলে অতৃপ্ত থেকে যান পর্যটকরা। আর হবিগঞ্জে সাতছড়ি জাতীয় উদ্যান- সে প্রকৃতির আরেক উদারতা, বিচিত্রতা।

ঐতিহ্যের পরশ :
সিলেটর গায়ে গায়ে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের বাক বদলের নানা গল্প। সিলেটজুড়ে ইতিহাসের নানা নিদর্শন এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। সিলেটের মধ্যখানে শুয়ে আছেন সিলেট বিজয়ী বীর সাধক হযরত শাহজালাল (রাহ.)। পথে পথে ছড়িয়ে আছে তার সিলেট বিজয়ের স্মারক। সিলেটের এমন কোনো এলাকা নেই যেখানে খুঁজে মিলবে না শাহজালালের সফরসঙ্গীর সমাধি। শাহজালালের কাছে পরাজিত গৌড়ের রাজা গৌবিন্দের রাজ প্রাসাদের চিহ্ন এখনও টিকে আছে নগরীতে। আছে তার পালিয়ে যাওয়ার পথের চিহ্নও। জৈন্তার প্রতাপশালী নারী রাজ্যের স্বাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে জৈন্তা রাজবাড়ি। এখানে টিকে থাকা মেগালিথিক পাথরের নিদর্শন আজও জানান দিচ্ছে সিলেটের প্রাচীনত্বের।

Developed by: