মোহাম্মদ নওয়াব আলী :: সত্যকে স্বীকার করা। সত্যের সাথে বসবাস করা। সত্যকে আলিঙ্গন করা। সত্যকে সহজভাবে মেনে নেওয়াই হলো মানুষের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট। কিন্তু কিছু সত্যকে সহজভাবে মেনে নিতে কঠিন ও কষ্টসাধ্য হয়। বার বার পীড়া দেয়। বার বার মনের গভীর থেকে প্রতিধ্বনিত হয় এ সত্য মেনে নেয়া যায় না। এ সত্য আলিঙ্গন করা যায় না। তারপর মেনে নিতে হয়। স্বীকার করতে হয়। স্বাভাবিক হতে হয়। মনপ্রাণ শীতল করতে হয়। স্বাভাবিক নিয়মে আবার জীবন শুরু করতে হয়।
২০ ফেব্র“য়ারি ২০২০ বৃহস্পতিবার ভোর ৬.৩০ মিনিটে আমার বড় ভাই হাজী মো. তোয়াব আলী ইহজাগতিক সব কিছু বিসর্জন দিয়ে মহাজাগতিক সফরে যাত্রা করেন। পাখি ডাকা ভোরে একটু শিশির ঝরছে। মানুষের ঘুমের ঘোর এখনও কাটেনি। প্রকৃতি পরিচ্ছন্ন। কোলাহলমুক্ত সকাল। কেউ কেউ দীর্ঘায়ূর জন্য, সুস্থ সবলভাবে বেঁচে থাকার জন্য ¯্রষ্টার নিরবচ্ছিন্ন নির্ভেজাল প্রকৃতির অক্সিজেন নিচ্ছেন। আর এ সময় তুমি একদম নীরবে, কাউকে না বলে, প্রকৃতির অভাবনীয় অক্সিজেন উপভোগ না করে চলে গেলে!
মানুষ চলে যায়। চলে যাওয়াই নিগুঢ় সত্য। তবে অনেকেইতো চলে যাওয়ার সময় ডাক্তারখানায় যায়, আপনজন কিংবা প্রিয়জনের বিরাগভাজন, বন্ধুবান্ধব কিংবা আত্মার সাথে সম্পৃক্ত কাউকে কিছু না কিছু বলে যায়। কিছু না কিছু স্মৃতিচিহ্ন রেখে যায় কিন্তু তুমি চলে গেলে একদম নীরবে। পরিচ্ছন ভোরের আলোয়। মানুষের কার্বনডাই অক্সাইডে পৃথিবী বিষাক্ত হওয়ার আগে। ফজরের নামাজ, সকালের নাস্তা, ভোরের প্রাতঃভ্রমণ সবই ঠিক রেখে আপাদমস্তক একজন পরিশুদ্ধ মানুষ হিসেবে শান্ত শিষ্ট ক্লান্তিহীন ঘুমে তুমি বিভোর হলে।
আমার পরিপুষ্টি। আমার দেহ মনের শক্তি সাহস। আমার আমি হওয়ার পিছনের সব নেপথ্য শক্তিই ছিলে তুমি। শিশুকালে বাবার চলে যাওয়া। মায়ের শক্ত হাতের সাহসী দিকনির্দেশনা। তুমি আর মেঝে ভাইয়ের (ছোয়াব আলী) অক্লান্ত সংগ্রাম আর হাড়ভাঙা খাটুনি সংসারে পুষ্টি যুগিয়েছিল। আমি ও দুই আপা (পিয়ারা, মিনারা) কোনো দিন কোনো কিছুর অভাববোধ করিনি। আমি যখন অস্টম শ্রেণিতে পড়ি তখন তুমি চলে গেলে সৌদি আরবের মদিনা মনোয়ারায়। তোমার প্রবাসী রেমিডেন্টে আমরা সমৃদ্ধ হলাম। লেখাপড়া করলাম।
তুমি দীর্ঘ প্রবাস জীবন শেষে একবারেই চলে এলে স্বদেশে। দেখভাল শুরু করলে বাবার রেখে যাওয়া ও তোমাদের শ্রমে-ঘামে অর্জিত কৃষিজমি। জমিতে সোনালি ফসল ফলাতে। আমাদের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়ে অর্জিত হত আর্থিক সমৃদ্ধি। তুমি ছিলে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশির সাথে যোগাযোগ রক্ষার সেতুবন্ধন। তুমি ছিলে মসজিদের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের মুসলি। তোমার সাথে ইমাম ও মুসলিদের যুগসূত্র ছিল সবচেয়ে বেশি। মাইকে ভেসে আসা মৃত্যু সংবাদ কিংবা আশপাশে শোনা মৃত্যু সংবাদের জানাজায় অংশগ্রহণ ছিল তোমার রুটিন মাফিক কাজ। যেখানে ওয়াজমাহফিল সেখানে বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত তোমার উপস্থিতি ছিল সরব।
তুমি অন্ধের মতো ভালোবাসতে মাওলানা আবদুল লতিফ ফুলতলী সাহেব কিবলাকে। তাঁর মৃত্যুতে কিংবা মৃত্যুর পরে বছরে কম হলেও একবার ফুলতলীতে উপস্থিতি ছিল তোমার বাধ্যতামূলক। তুমি ছিলে ফুলতলীর প্রতিষ্ঠিত সুবহানিঘাট মসজিদের জুম্মার নামাজের মুসলি।
তুমি ছিলে মায়ের পুজারি। অষ্টপ্রহরই মায়ের কাছাকাছি থাকতে। মায়ের সাথে সবকিছু ভাগাভাগি করতে। মায়ের বেশির ভাগ আবদারই তুমি পূরণ করতে। কারণ আমরা বাহিরে বাহিরে থাকতাম আর তুমি থাকতে সনিকটে।
মামার বাড়ির ভাগনা বলতে তোমাকেই বোঝাতো, কারণ সকল মামা-মামির সাথে তোমার ছিল নিবিড় সম্পর্ক। প্রায় প্রতিদিনই ফোন হতো। তারা ডাক দিলেই চুপিচুপি চলে যেতে। তাদের সবগুলো অনুষ্ঠানের মধ্যমণি ছিলে তুমি।
আমি কোনো দিন আর্থিক সার্পোট দিতে পারিনি সংসারে। তারপরও তুমি কিংবা মেঝো ভাই কোনোদিন রাগ করোনি। তুচ্ছ তাচ্ছিল করোনি। আমার অর্থবিনাশী কাজগুলোকে উৎসাহ দিয়েছ। সাপোর্ট দিয়েছ। আমার মনগড়া কাজগুলো সেরে আমি গভীর রাতে বাড়ি ফিরলেই তোমাকে ঘরের বাহিরে পেতাম আমার জন্য অপেক্ষায় আছ। তারপরও দমক দিতে না সুন্দর করে বলতে দেরি না করার জন্য!
তোমার অবর্তমানে স্মৃতিগুলো আজ মন খুড়ে খুড়ে খাচ্ছে। পা বাড়ালে অন্ধকার দেখি। হাত বাড়ালেই শূন্যতা দেখি। তখন থেমে যাই। সব কাজে গতি হারাই। নিজেকে নিঃস্ব লাগে। তারপর স্বাভাবিক হই। আর ভাবি যে দিন যায় সে দিন আর আসে না। যে যায় সে আর ফেরে না। তুমিও ফিরবে না।
আমি হারালাম সততা, নিষ্ঠা, প্রগাঢ় ধর্মীয় অনুরাগ, প্রচণ্ড নীতিবোধ, মানুষের প্রতি গভীর সহানুভূতি ও ভালোবাসার একজন অভিভাবক।
এই বিশ্বের মহান প্রতিপালক, রাজাধিরাজ সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা তোমাকে যেন জান্নাতের সুশীতল ছায়ায় রাখেন।