সিলেট শহর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দক্ষিন-পশ্চিমে বিশ্বনাথ উপজেলার অবস্হান। ৮টি ইউনিয়নের সমন্নয়ে গঠিত এ জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য ব্যাপক পরিচিতি আছে। ইউনিয়ন সমূহের নাম হচ্ছে – রামপাশা ইউনিয়ন, লামাকাজী ইউনিয়ন, খাজাঞ্চী ইউনিয়ন, অলংকারী ইউনিয়ন, দেওকলস ইউনিয়ন, দৌলতপুর ইউনিয়ন, দশঘর ইউনিয়ন, বিশ্বনাথ ইউনিয়ন।
জমিদার বিশ্বনাথ চৌধুরীর ভূমির উপর প্রথমে বাজার স্হাপিত হওয়ায় বাজারের নামকরন করা হয় বিশ্বনাথ বাজার। সেই বাজারে একটি পুলিশ ফাঁড়ি হয় এবং সেই পুলিশ ফাঁড়ি সিলেটের অন্যান্য পুলিশ ফাঁড়ির মতো বিশ্বনাথ পুলিশ ফাঁড়ি থানায় রুপান্তিত হয়, তাই বিশ্বনাথ চৌধুরীর নামানুসারে থানারও নামকরন হয় বিশ্বনাথ থানা। বিশ্বনাথ বাজার এখন একটি সমৃদ্ধশীল বাজারে পরিনত হয়েছে। সড়কপথের ব্যাপক সুযোগ সুবিধা থাকায় বিশ্বনাথ যাতায়াতের ব্যবস্হা অনেকটা সহজতর হয়েছে।
বিভিন্ন গ্রন্হ থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তৎকালীন সময়ে এ উপজেলায় হিন্দু, মুসলমান জমিদার দের বসতি ছিলো। পর্যায়ক্রমে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে লোকজন প্রবাসে পাড়ি জমায় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে উপজেলাকে সমৃদ্ধশালী করে তোলে। বর্তমানে বিশ্বনাথ থানা সিলেট জেলার এক অন্যতম উপজেলা হিসেবে প্রসিদ্ধ। বিশ্বনাথ উপজেলা সবার কাছে প্রবাসী অধ্যুষিত থানা হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করে। দার্শনিক স্হান সমুহের মধ্যে রামপাশার বিখ্যাত দেওয়ান হাছন রাজার জমিদার বাড়ি, ৩৬০ আউলিয়ার সফর সঙ্গী হযরত শাহ কালু ও হযরত শাহ চান্দ-র মাজার, গৌরগবিন্দ দীঘি, উপজেলা পরিষদ শহীদ মিনার।
আলোকিত ব্যক্তিত্ব :— এডভোকেট নুরুল ইসলাম খান এমপি, আ ন ম সফিকুল হক রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী পরিষদের অতিরিক্ত সচিব মইন উদ্দিন, ইলিয়াছ আলী এমপি, শফিকুর রহমান চৌধরী এমপি, ইয়াহিয়া চৌধরী এমপি, রোশনারা আলী বাংলাদেশী বংশোদভূত বৃটিশ রাজনীতিবিদ, দেওয়ান হাছন রাজা চৌধুরী- মরমী কবি ও সঙ্গীত শিল্পী, দেওয়ান একলিমুর রাজা চৌধুরী -রাজনীতিবিদ ও সাহিত্যি, দেওয়ান তৈমুর রাজা চৌধুরী -রাজনীতিবিদ ও মরমী গীতিকার, রাগিব আলী-সমাজ সেবক ও শিল্পপতি, ডক্টর শাহদীন মালিক -আইনজীবি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ, ডক্টর তুহিন মালিক -আইনজীবি ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ। এ ছাড়া দেশে বিদেশে আরো অনেক গুনীজন আছেন যারা বিভিন্ন সেক্টরে সামাজিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখে যাচ্ছেন।
প্রবাসে বিশ্বনাথ সংগঠনগুলো নিজের থানা উন্নয়নে নিরলস কাজ অব্যাহত রাখছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে উপজেলাটি যেমনই অনেক এগিয়ে আছে তেমনই চিকিৎসা সেবার ভূমিকা অপরিসীম।
এ উপজেলায় মোট ৪৩৬ টি গ্রাম আছে। তন্মধ্যে বিশ্বনাথ উপজেলার দৌলতপুর ইউনিয়নের একটি ঐতিহ্যবাহী এলাকার নাম সিঙ্গের কাছ। পাশ্ববর্তী অনেক গুলো গ্রাম যেমন শেখের গাউ,মাঝ গাউ,পশ্চিম গাউ, খান পাড়া,করপাড়া,কাজির গাউ গোয়াহরি ভাটিপাড়া খাগহাটা,বুরাইয়া,সিংরাওলী,নোয়াগাউ,সাতপাড়া,পলির গাউর প্রানকেন্দ্র হিসেবে সিংগের কাছ অতি সুপরিচিত। এলাকাটিকে একই বাক্যে সবাই চেনে। এখানে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা মসজিদ চিকিৎসা কেন্দ্র সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্নয়ে সমৃদ্ধশীল একটি এলাকা বলে খ্যাত।
সিংগের কাছের নামানুসারে বাজারের নামকরন হয়েছে সিংগের কাছ বাজার। অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি বর্গ জ্ঞানী গুনী জনের জন্ম স্হান সিংগের কাছ প্রবাসী অধ্যুষিত এলাকা বলে প্রসিদ্ধ। এই এলাকার অনেক লোক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। প্রবাসীদের অর্থায়নে গড়ে ওঠেছে বিলাসবহুল অট্টালিকা। ব্যবসা বানিজ্য আয় রোজগারের দিক দিয়ে এলাকাটি পিছিয়ে নেই। স্হানীয় ব্যবসায়ীদের নিষ্টা এবং পরিশ্রমের মাধ্যমে সিংগের কাছ বাজার বর্তমানে এলাকার উন্নতম বাজার হিসেবে গন্য করা হয়। বাজার সংলগ্ন মাকুন্দা নদীর ব্রিজ বাজারের অন্যতম আকর্ষন যা বাজারের পশ্চিম, উত্তর দক্ষিণ প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চালের যাতায়াতের আমুল পরিবর্তন এনে দিয়েছে। চলাচল ব্যবস্হা যেমনি উন্নতি হয়েছে তেমনি নদীর দু’পাড় ঘেষে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এলাকার মানুষের আর্থিক অবস্হা সচ্ছল হওয়ায় চাহিদাও বেড়ে গেছে। কল কারখানা, শপিং কমপ্লেক্স বিশাল আকারে দোকান-পাট ও চিকিৎসা ব্যবস্হা সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর দোকান গড়ে উঠায় সর্বসাধারণ সব ধরনের সুযোগ সুবিধা ভোগ করছে।অত্যাধুনিক জিনিস পত্র কেনাকাটার জন্য এখন আর শহরে যেতে হয় না। সিংগের কাছ বাজার এবং এলাকায় সরকারী বেসরকারী অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্হাপিত হওয়ায় শিক্ষার মান দিন দিন এগিয়ে যাচ্ছে।
কিছুদিন পূর্বে প্রবাসীদের উদ্যোগে এলাকায় নতুন একটি হেলথ সেন্টার উদ্বোধন করা হয়েছে। যার নামকরন হয়েছে সিংগের কাছ “হেলথ সেন্টার”। মনোরম পরিবেশে আধুনিক প্রযুক্তির সব ব্যবস্হা সমপন্ন সেন্টার টি ইতিমধ্যে সবার নজর কাড়তে সক্ষম হয়েছে। এখানে বিনা মুল্যে গরীব দুস্হদের চিকিৎসার ব্যবস্হা করা হবে। রাস্তাঘাট যাতায়াত ব্যবস্হা অতীতের তুলনায় অনেক উন্নীত করা হয়েছে। সিংগের কাছ থেকে সিলেট যাতায়াত ব্যবস্হা বর্তমানে আগের চেয়ে অনেক সহজতর হয়েছে।
সিংগের কাছের অন্তরভুক্ত মাকুন্দা নদীর উত্তর পারের অদুরে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা প্রাকৃতিক মনোরম পরিবেশ বিজড়িত গ্রামের নাম হচ্ছে সিংরাওলী। আমার জন্মস্হান। যার সাথে আমার নাড়ীর সম্পর্ক। যেখানে আমার শৈশব কৈশোরের রঙ্গিন কিছু সময় কেটেছে। যে গ্রামের লন্ডন প্রবাসী আরেক কৃতিমান পুরুষ ছিলেন আমার বাবা মরহুম আলহাজ্ব মৌলভী সিকন্দর আলী। যার অবদান এই ক্ষুদ্র পরিসরে লিখে শেষ করতে পারবো না। যিনি একাধারে একজন প্রখ্যাত আলেম, সিংরাওলী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা, শিক্ষানুরাগী, বিশিষ্ট সমাজ সেবক সর্বজন পরিচিত এক উজ্জ্বল ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। বিশ্বনাথ উপজেলার সিংগের কাছ এর সিংরাওলী গ্রামের মৌলভী সাব নামে এক বাক্যে দেশে বিদেশে সবার পরিচিত।
সিংরাওলী গ্রামের মাটির গন্ধ প্রতিনিয়ত আমাকে মোহিত করে। এই গ্রামের অলি গলি পথ দিয়ে কতো যে হেটেছি খেলেছি তা আজও স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। প্রাইমারী স্কুল শেষ করে সিংগের কাছ বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময়টা বেশ রোমাঞ্চকর। সেই থেকে সিংগের কাছ এর বাজার এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের সাথে আত্মার বন্ধন সব সময়ের। স্কুলের শিক্ষক ক্লাস মেট থেকে শুরু করে সবার সাথে সখ্যতা গড়ে ওঠে। হাই স্কুলে অধ্যায়নরত অবস্হায় ৮ম শ্রেনীতে পড়াকালীন সময়ে প্রবাসী হয়ে যাওয়ায় পিছনে ফেলে আসতে হয় স্বর্ণালী দিনগুলো। আজ শুধু সেই সব স্মৃতিময় দিনগুলো পিছু টানে। মনের আঙিনায় বার বার দোলা দেয়। প্রবাসের রঙীন চাকচিক্যময় জীবনে সুখ সাচ্ছন্দে ভরপূর হলেও জন্মভূমি তথা শেকড়ের টান প্রতিনিয়ত অনুভব করি। কবির ভাষায় বলতে ইচ্ছে হয়,
“এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্ম ভূমি”
লেখক : কবি, ইংল্যান্ড প্রবাসী।