কাব্যগ্রন্ত্রটি লিখেছেন বাংলা সাহিত্যর বিশিষ্ট কবি দিলওয়ার। প্রচ্ছদ- ধ্রæব এষ, সাদা-কালো মোড়কে গ্রন্থটি সাজানো হলেও আকর্ষণীয়, আভিজাত্যের প্রতিফলন রয়েছে। প্রকাশক- বাসিয়া প্রকাশনী, সামসুদ্দীন হাউস, স্টেশন রোড, সিলেট। মূল্য- ২২৫ টাকা, প্রকাশকাল- অমর একুশের বইমেলা- ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ।
কবি দিলওয়ার ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে ইন্তেকাল করেন। কবির অন্তর্দানের ৭ বছর পর বইটি প্রকাশিত হয়। মোট ৯০টি কবিতা এ গ্রন্থে স্থান লাভ করেছে। গ্রন্ত্রটিতে রয়েছে ২১টি সনেট। সনেট রচনায় কবি দিলওয়ারের সাফল্য ও দক্ষতা যে কেউ স্বীকার করবেন।
বইটির ভূমিকা লিখেছেন কবির
সূযোগ্য পুত্র কামরান ইবনে দিলওয়ার। গ্রন্ত্রটির নাম কবিতা- ‘সুর : শেখ মুজিবুর’। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে প্রথম কবিতা এবং শেষ কবিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সাম্যবাদী, গরিব-দুঃখী, মেহনতী মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতিকে নিয়ে সুখী ও সমৃদ্ধশালী জীবনের স্বপ্ন দেখতেন তা কবি দিলওয়ারের ভালোই জানা ছিল। কবি দিলওয়ার পৃথিবীর বহু বিখ্যাত মনিষী, রাজনীতিবিদ ও কবি সাহিত্যিকবৃন্দ নিয়ে জীবনে গবেষণা করেছেন। উক্ত গ্রন্থেও তাদের বিষয়ে অকুণ্ঠচিত্তে লিখে গেছেন কবি দিলওয়ার।
স্বদেশ ও স্বজাতীয় চেতনায় জীবনে বারবার দোলায়িত কবি বঙ্গবন্ধুকে উক্ত গ্রন্থে যেন নায়কের ভূমিকায় তুলে ধরেছেন। ‘সুর : শেখ মুজিবুর’ কবিতা থেকে উদ্ধৃতি তুলে ধরছি-
‘দেশ যদি বৃক্ষ হয়, তুমি তার প্রণেতা শিকড়
তোমাকে রেখে তাই যারা ঋদ্ধ হতে চায়
বিভ্রান্ত বিশ^াসে তারা হৃদপিন্ডে বৃদ্ধ হতে চায়।
বড় মর্মান্তিক সেই বিচারক কালের আঁচড়।’
‘প্রতিদিন পত্রিকায়’ নামক কবিতা থেকে-
‘আমাকে বলতে দিন সম্মানিত মহোদয়গণ
প্রতিদিন দুঃসংবাদ ছাপা হয় কত?
আমাকে বলতে দিন কত হয় আহত নিহত?
উন্মাদ আশ্রমে আছি এই বোধে কাঁদে কেন মন?
প্রতিদিন পত্রিকায় স্বদেশের আর্তদান শুনি
ছুটছে মাতাল তরী, দৈবাকাশে ঝাঁকের শকুনি।’
‘প্রিয় সম্পাদক’ নামক কবিতায় কোন প্রিয়জন সম্পাদকের উদ্দেশ্য কবি দিলওয়ারের কবিতা দেশ ও জাতির প্রতি ভালোবাসার চরম অভিব্যক্তি। যেমন-
‘প্রিয়জন সম্পাদক
বন্ধুজন তুমি
সমস্যা সংকুল দেশে
দৃষ্টি নিষ্পলক।
জানতে চাইবো না আমি
এই দেশে কবে
মুক্তি যুদ্ধ হয়েছিল
মুক্তিপক্ষ পাখির গৌরবে
বলবো না কত রক্ত
রূপ নিল কলঙ্ক কালিতে
আমাতে নৈরাশ্যবাদ
আজন্মই রয়েছে নিখোঁজ
চিরায়ত আলোবায়ু
আমাকে যোগায় রাজভোজ
তাই আমি প্রিয় সম্পাদক
তোমাকে একান্ত চাই রশ্মির কনক
কলমে ছড়াও তুমি
খুলে ধরো প্রাচীন প্যাপিরাস
জ্ঞাত হোক জনশক্তি
কী করে ঘটলো সেই দুর্বোধ্য প্রজ্ঞার সুপ্রকাশ।’
২০০৫ সনের জুন মাসে লিখিত কবিতায় কবি দিলওয়ারের বিদ্রোহ ও বিপ্লবের সুর তারণ্যের চেতনায় উদ্ভাসিত। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ছাড়া সে ধরনের ভাব, ভাষা, উপমা, উৎপ্রেক্ষা প্রকাশ দূর্লভ।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান (বর্তমান) অধ্যাপক ভীষ্মদেব চৌধুরীকে উদ্দেশ্য করে লেখা কবির একটি কবিতার অংশ বিশেষ-
তুমি ভুলে গেছো নারী একদিন শিকারী আমাকে
ঘরমুখো করেছিল যৌথভাবে ধানের আবাদে,
সেই কাল খৃষ্টপূর্ব দশ হাজার বছর হল যে!
যদিও তখনো প্রিয়া উঠেনি নোলক তোর নাকে,’
¯েœহ, প্রেম, প্রীতি, আকর্ষণ নারী পুরুষের স্বভাবজাত। ধর্মের বন্ধনে আমরা সংসার গড়ি। নারী পুরুষের মিলনে
হয় সৃষ্টি। কবি সেখানে স্বামী স্ত্রীর প্রেম, মিলন, ভালবাসা
তথা প্রকারান্তরে ধর্মের জয়গান গেয়েছেন। যেমন-
‘ধ্রæপদী আকাশ দেখো পূর্বেকার আদিম নয়নে
তারপরে যাব জুটি সভ্যতার কুসুম কাননে।’
(ধ্রæপদী আকাশ দেখা)
কবি দিলওয়ার তাঁর‘ সুর : শেখ মুজিবুর’ কাব্যগ্রন্ত্রে পৃথিবীর বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গকে টেনে এনেছেন। যেমন- কাজী নজরুল ইসলাম,রবীন্দ্রণাথ ঠাকুরম গ্যেটে, সক্রেটিস, এরিষ্টটল, প্লেটো, হোসিয়ড, পিন্ডার, হোমার,
ঈশপ, সফেক্লিস, আলেকজান্ডার, ভার্জিন, দ্বৈপায়ন, ফেরদৌসী, দান্তে, বাল্মিকী, মিল্টন, সেপিয়র, কার্ল মার্কস, স্পার্টাকাস, লিওর্নিদাস, লেনিন, মাওসেতুং, হোচিমিন, আরনেস্টা, চেগুয়েভারা, বেঞ্জামিন জেফানিয়াহ প্রমুখ কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক ও রাজনীতিবিদগণকে তুলে ধরেছেন। এমনকি সিলেটের কৃতি সন্তান রাজনীতিবিদ পীর হবিবুর রহমানকে নিয়েও কবিতা লিখেছেন। তাতে প্রমাণিত হয় কবি জীবনে বিশে^র বিভিন্ন ধর্ম, বিশ^ভ্রহ্মান্ড, দর্শন, সমাজতন্ত্র, ধনতন্ত্র, বিপ্লব, জাতিতত্ত¡, সবকিছু নিয়েই গবেষণা করেছেন।
‘২২ শে শ্রাবণ’ নামক কবিতায় কবি লিখেন-
‘রবীন্দ্রনাথ, আজ ২২শে শ্রাবণ ১৪০৮
এমনি এক বর্ষাকালে তোমার সর্বশেষ
শরীর সর্বস্ব পরিচিতি
তোমার বিশাল রচনা সম্ভারে
কালের অশ্রæ হয়ে যায়।
রবীন্দ্রনাথ, তুমি সত্যি ভাগ্যবান
বেঁচে থাকলে বিক্ষুদ্ধ বিস্ময়ে নীরিক্ষণ করতে
তোমার লেখা জাতীয় সংগীতে
কী নান্দনিক রক্তকরণ।’
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে ‘নজরুলের কৈফিয়ত ডাকে’ কবিতা থেকে-
‘কোথায় যাচ্ছো, তুমি
নজরুলের কৈফিয়ত ডাকে,
তোমার কী কৈফিয়ত
কহে দ্রোহী দৃষ্টি মৌচাকে,
শিকল পড়ার ছল… দেখো তুমি
সত্য হয়ে যায়,
কবিতা ‘বিদ্রোহী’ দিক চূর্ণ করে
সব অন্তরায়।’
কবি দিলওয়ারের চোখে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘বিদ্রোহী’ কবিতাই সব বাধা, ভেদাভেদ, ভন্ডামীর আসল মুখোশ উন্মোচিত করে, যা কোন দিন কেউ করেছে কি না, আমাদের জানা নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে গ্রন্থের শেষ কবিতা। কবি দিলওয়ারের লেখায় বঙ্গবন্ধু বিভিন্নভাবে বিভূষিত হয়েছেন। যেমন-
‘বঙ্গবন্ধু তোমার জন্মদিনে
নিপীড়িত আর শোষিত মানুষজন
নব জীবনের বিপ্লব নিক চিনে…
তোমার জবানে কথিত চার্টার দল
লোহিত সাগরে মিটাক কৌতূহল,
ঝরাক পশুরা মরণাস্ত্রের ঋণে,
মুক্তিযোদ্ধা ফিনিক্স পক্ষী হবে,
গণমানবিক দুরন্ত গৌরবে।
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল কবি দিলওয়ারের, ‘রক্তে আমার অনাদি অস্থি’ কাব্যগ্রন্থ পাঠ করলে তা অনুমান করা যাবে।
আমাদের আজকের আলোচ্য বিষয় কাব্যগ্রন্থ ‘সুর : শেখ মুজিবুর’। কবি দিলওয়ারের লিখায় ও চেতনায় বঙ্গবন্ধু মেখ মুজিবুর রহমান এদেশের জাতীয় নায়ক, দেশ জনগণের অকৃত্রিম বন্ধু।
পরিশেষে আমরা পরপারে বঙ্গবন্ধুর প্রতি জানাই অশেষ শ্রদ্ধা এবং কবির প্রতি মেবারকবাদ।