মালয়েশিয়াপ্রবাসী বাংলাদেশি শ্রমিকদের অনেকেরই জীবনের চাকা থেমে যাচ্ছে ৩০ থেকে ৪০ বছরের কোঠায়। গত সাড়ে আট বছরে দেশটিতে ৩ হাজার ৩১২ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন। প্রায় সব ক্ষেত্রেই মৃত্যুর কারণ কর্মক্ষেত্রে দুর্ঘটনা, স্ট্রোক কিংবা অসুস্থতা।
প্রবাসী বাংলাদেশিরা বলছেন, এমন মৃত্যুর অনেকাংশে কারণ কর্মক্ষেত্র ও থাকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, সব সময় দুশ্চিন্তা, অতিরিক্ত কাজের চাপ।
বিভিন্ন দেশ থেকে আসা মৃত ব্যক্তিদের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বিভিন্ন দেশ থেকে যত লাশ আসছে, তার মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশই আসছে মালয়েশিয়া থেকে। এর মধ্যে গত বছর মালয়েশিয়া থেকে এসেছে ৫১০ জন বাংলাদেশির মরদেহ, যা এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। গত বছর মৃত্যুর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, তাঁদের ৩৩ শতাংশই স্ট্রোকে মারা গেছে। ৩৫ শতাংশ মারা গেছে হার্ট অ্যাটাক, যক্ষ্মাসহ নানা অসুখে। দুর্ঘটনায় মারা গেছে ২০ শতাংশ। বাকিরা অন্যান্য কারণে মারা গেছেন।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে মালয়েশিয়া থেকে ২১৬ জন, ২০০৮ সালে ৪১১ জন, ২০০৯ সালে ৪৭২ জন, ২০১০ সালে ৩৬১ জন, ২০১১ সালে ৩৫৬ জন, ২০১২ সালে ৩৪০ জন, ২০১৩ সালে ৩৮৭ জন, ২০১৪ সালে ৫১০ জন ও ২০১৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ২৫৯ জন বাংলাদেশির লাশ এসেছে।
মালয়েশিয়ার বাংলাদেশ হাইকমিশন ও ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সূত্র বলেছে, বছরে এমন দিন খুব কমই গেছে, যেদিন মালয়েশিয়া থেকে এক বা একাধিক বাংলাদেশির লাশ আসেনি। গত ১৭ জুলাই ঢাকায় পাঠানো হয়েছে চারজন প্রবাসীর লাশ। তাঁরা হলেন রংপুরের রাশেদুল ইসলাম, ইহসানুল হক, ঢাকার আশিক আহমেদ ও আরিফা সুলতানা। চারজনই দুর্ঘটনায় মারা গেছেন।
মাস দুয়েক আগে মালয়েশিয়া থেকে লাশ হয়ে দেশে ফেরেন ৩০ বছরের তরুণ মাদারীপুরের শরিফ মোল্লা। তাঁর মৃত্যুর কারণ লেখা আছে—স্ট্রোক। শরিফের ভাই গিয়াসউদ্দিন বলেন, ‘২০০৮ সালে শরিফ যখন মালয়েশিয়ায় যান, তখন তাঁর বয়স ছিল ২২ বছর। জীবিত অবস্থায় দেশে আসেননি, এলেন লাশ হয়ে। সুস্থ ভাইটা শুনলাম স্ট্রোক করে মারা গেছেন। এমন মৃত্যু আমরা মেনে নিতে পারছি না।’
সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ার আবদুল মজিদ (২৭) মালয়েশিয়া যাওয়ার তিন মাস পর হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। তাঁর ভাই নজরুল ইসলাম বলেন, ‘আগে তো তার এমন কোনো অসুখ ছিল না। মালয়েশিয়ায় গেল। তিন মাস পরই লাশ হয়ে ফিরল।’
২৯ বছরের এনামুল হকের বাড়ি কুমিল্লায়। তিনি মারা গেছেন স্ট্রোকে। ২৮ বছরের আলম মোর্শেদ মারা গেছেন দুর্ঘটনায়। ৩১ বছরের কবির হোসেন স্ট্রোকে। তাঁর বাবা বাবুল সরকার আজও ছেলের মৃত্যু মেনে নিতে পারেননি।
গাইবান্ধার বাবুল মিয়া (৩৮), নোয়াখালীর আবদুর রহমান শেখ (৩৭), কিশোরগঞ্জের রমজান (২৯) ও মুন্সিগঞ্জের সেলিম হোসেনও (৩২) মারা গেছেন স্ট্রোকে। গত বছরের ডিসেম্বরে তাঁদের লাশ এসেছে দেশে। তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এমন মৃত্যু নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
দক্ষিণ এশিয়ার অভিবাসনবিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলোর জোট কারাম এশিয়ার সমন্বয়ক হারুন-আল-রশিদ প্রথম আলোকে জানান, বাংলাদেশ থেকে দু-তিন লাখ টাকা খরচ করে অনেক স্বপ্ন নিয়ে একেকজন মালয়েশিয়া আসছেন। কিন্তু এখানে বেশির ভাগ জায়গাতেই কাজের পরিবেশ ভালো নয়। খরচের টাকা তোলার জন্য অনেকে দিনে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টাও কাজ করেন। কাজ শেষে কারখানার পেছনে বস্তির মতো গাদাগাদি করে থাকেন। নির্ধারিত সময়ে খরচের টাকা ওঠে না। ফলে অতিরিক্ত সময় থেকে তাঁকে অবৈধ হয়ে যেতে হয়। অতিরিক্ত পরিশ্রম, সব সময় মানসিক দুশ্চিন্তা, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থাকা-খাওয়া, পরিবারের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা—এসব কারণে তাঁরা অসুস্থ হয়ে পড়েন। অসুস্থ হলেও যথাযথ চিকিৎসা পান না। ফলে ৩০ কিংবা ৪০ বছর পেরোনোর আগেই একেকজন মারা যাচ্ছেন।
মালয়েশিয়ার ক্লাং জেলায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার বাংলাদেশি আছেন। ক্লাং সিটি কাউন্সিলের নির্বাচিত সদস্য মানিভানান আল ভেলুই বলেন, ‘বাংলাদেশি শ্রমিকেরা যেখানে থাকেন, সেখানকার পরিবেশ একেবারেই অস্বাস্থ্যকর। আমরা বিভিন্ন সময়ে কারখানার মালিকদের এ বিষয়ে বলেছি। এমন পরিবেশে থাকলে যেকোনো সময় অসুস্থতা অস্বাভাবিক কিছু নয়।’
মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশ হাইকমিশনের প্রথম সচিব (শ্রম) মুশাররাত জেবিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘মালয়েশিয়ায় প্রতি মাসে গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ জন বাংলাদেশি মারা যান। তাঁদের অধিকাংশই মারা যান স্ট্রোক, হৃদ্রোগ কিংবা দুর্ঘটনায়। আমরা লাশগুলো দেশে তাঁদের স্বজনদের কাছে পাঠাই। এসব মৃত্যু আসলেই মেনে নেওয়া যায় না। তবে যাঁরা কাজ করতে আসেন, তাঁরা যদি মানসিক দুশ্চিন্তা কমাতে পারেন, অসুস্থ হলে শুরুতেই যদি চিকিৎসক দেখান, তাহলে মৃত্যু অনেক কমে আসবে।’