পুণ্যভূমি সিলেটকে শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যই কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘শ্রীভূমি’ বলে আখ্যায়িত করেননি; শ্রীভূমির মানুষ কাব্যপ্রিয়, প্রেমবিলাসী ও রসিক বলে তিনি সিলেটের প্রতি দুর্বল ছিলেন। এ অঞ্চলে কাব্য, পুথি, মরমি সংগীতের ধারা বহমান যুগ যুগ ধরে। মহাকবি সৈয়দ সুলতান, হাসন রাজা, রাধারমণ দত্ত, দুর্বিন শাহ, শিতালং শাহ, কালা শাহ, দীনহীন, শেখ ভানু, সৈয়দ শাহ নূর, মাওলানা ইয়াছিন, ভেলা শাহ, লতিফ শাহ, আরকুম শাহ ও শাহ আবদুল করিম এঁরা এই সিলেটের সন্তান। যাঁদের ছন্দময় উচ্চারণ, সুর ও বাণীর ঝংকার আজও মানুষের মনে অনুরণন সৃষ্টি করে।
এ ধারার একজন সফল ও অনন্য গীতিকার শাহ আবদুল ওদুদ। জন্ম ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দের ১২ সেপ্টেম্বর সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার সিঙেরকাছের বুবরাজান গ্রামে। পিতা আলহাজ সিরাজুল ইসলাম, মাতা আলহাজ খোরশেদা বিবি। ৩ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে তিনি জ্যেষ্ঠ।
মানুষ ও জীবনের প্রতি অনাবিল ভালোবাসা, হৃদ্যতা ও প্রগাঢ় সহমর্মিতা না থাকলে সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেবক হওয়া যায় না। ভাবুকরাই ভাবসাগরে হরদম প্রসব যন্ত্রণায় ভোগেন। যাদের অবস্থান এর বিপরীতে তারা সর্বদা কটাক্ষ নিন্দার কাঁটা বুনেন। এতে প্রকৃত ভাবুকদের কিছু যায় আসে না। ভাবুকদের সঙ্গে আমার সখ্য দীর্ঘ দিনের। ভাবুকদের সংস্পর্শ পেলে মনে হয় আকাশের অর্ধেক চাঁদ পেয়েছি। আমার দৈনন্দিন জীবনের বেশিভাগ সময় কাটে ভাবুকদের সাথে।
মরমি গবেষক, গীতিকার ও সাংবাদিক, বন্ধুবরেষু মো. খালেদ মিয়া ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে একজন ভাবুকপ্রাণ মরমি সংগীত সাধক শাহ আবদুল ওদুদকে নিয়ে এলেন আমার অফিসে। ধবধবে সাদা পোশাক আর লকলকে কালো চুল-দাড়ির সফেদ মানুষ। পরিচয় পর্বের শেষ প্রান্তে জানা হলো তার ‘দিলতরঙ্গ’ নামক প্রথম গীতিগ্রন্থ প্রকাশিত হবে। গ্রন্থে আমার একটু মন্তব্য থাকবে এজন্যই আসা।
পাড়া গাঁয়ের নির্মল বায়ুর সংস্পর্শে বেড়ে ওঠা গ্রাম বাংলার অকৃত্রিম একজন সংগীত সাধকের প্রথম গ্রন্থ বেরুচ্ছে শুনে আমার অন্তর আনন্দে উদ্বেলিত হলো। আমি এ রকম গীতি চর্চাকে বরাবরই শ্রদ্ধা জানাই।
স্বল্প দেখায় অল্প কথায় বোঝা গেল শাহ আবদুল ওদুদ সহজ, সরল, নিরহংকার, খোদাভক্ত, ভাবের দেশে বসবাসকারী একজন নীরব সাধক। বিত্ত বৈভবের ধার ধারেন না তিনি। ওলি আউলিয়াদের পদস্পর্শে কাটে তার অধিক সময়।
১০১টি গানের অনবদ্য গ্রন্থ ‘দিলতরঙ্গ’ প্রকাশিত হলো। বিশ্বনাথের সিঙেরকাছে ১৫ জানুয়ারি ২০০০খ্রি. প্রকাশনা অনুষ্ঠান। গীতিকারের আবদার, সেখানে আমাকে থাকতে হবে। বালাগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষ সাংবাদিক মহিউদ্দিন শীরু ও জনপ্রিয় মরমি গীতিকার গিয়াস উদ্দিন আহমদের সাথে প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশ নিলাম। শাহ আবদুল ওদুদের আত্মীয়তায় সেদিন মুগ্ধ হয়েছিলাম। এভাবে সখ্য বেড়ে চলে তার সাথে।
আমি তখন জাতীয় গীতিকবি পরিষদের সিলেট বিভাগের আহবায়কের দায়িত্ব পালন করছি। বিভাগীয় কমিটিতে খালেদ মিয়ার সাথে শাহ আবদুল ওদুদও সংযুক্ত ছিলেন।
শাহ আবদুল ওদুদ নিয়মিত শাহজালাল (র.) ও শাহপরান (র.) সহ বিভিন্ন মাজারে প্রাণের টানে যাতায়াত করেন। সিলেট আসলেই আমার প্রকাশনী সংস্থায় উঠতেন। সব উরসেই তার কাফেলায় নিমন্ত্রণ থাকতো আমার। শাহজালাল (র.) এঁর মাজারে উরস হলেই তার কাফেলার সুবাদে প্রায়ই উরসে যেতাম। তিনি আমাকে দেখলেই ব্যস্ত হয়ে যেতেন-কোথায় বসাবেন, কোথায় রাখবেন।
এভাবে নিয়মিত যোগাযোগে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। আমিসহ আমার ভাইদের সাথে তার হৃদ্যতা ঘনিষ্ঠতর হয়। হয়ে ওঠেন তিনি ফ্যামেলি মেম্বার। সবার কাছে পীর সাহেব।
অন্য দশজন বন্ধুর চেয়ে তিনি সম্পূর্ণ আলাদা। সব সময় কম কথা বলেন। প্রয়োজনীয় কথা ছাড়া অতিরিক্ত কথা বলেন না। সদা সাদা পোশাক পরেন। পোশাক কখনো মলিন হয় না; সব সময় ধবধবে সাদা থাকে। তাকে যখন থেকে দেখেছি তখন থেকেই একই বয়সের মনে হয়। বয়স বাড়ে ও না কমে ও না এমন অবস্থা। তিনি প্রকৃত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হলেও আমি এবং খালেদ মিয়া সব সময় পীর সাব বলে সম্বোধন করি।
পীর সাহেব ২০১০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ইংল্যান্ড যাত্রা করেন। যাত্রার প্রাককালে ঘনঘন আমার অফিসে আসতেন। ইংল্যান্ডে গিয়ে বারবার যোগাযোগ, বারবার খবরাখবর যেন তার মন বসছে না পরদেশে। কিছু সীমাবদ্ধতা থাকায় আসতেও পারছেন না। কিন্তু দেশ, মাটি, মানুষ, ওলি আউলিয়ার মাজার যেন তাকে টানছে। তাকে হাতছানি দিচ্ছে। দেশের প্রতি নিখাঁদ ভালোবাসার গভীরতা লক্ষ্য করছি।
অনেক বন্ধু আছে প্রত্যক্ষভাবে উপকার করলেও পরোক্ষভাবে অপকার করার নজির সমাজে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত। কিন্তু শাহ আবদুল ওদুদ একজন খাঁটি বন্ধু, খাঁটি মানুষ। পরোক্ষে তার কোন আত্মঘাতি শব্দচয়ন শুনিনি। বিষবাণে জর্জরিত হইনি। তিনি আমাকে কেন এত ভালোবাসেন? আমার প্রতি কেন এত নির্ভরতা করেন? কেন এত মূল্যায়ন করেন? কিছুই আমি বুঝতে পারি না। প্রবাসে অবস্থানের পর থেকে নিয়মিত ফোনালাপ। আমার পরিবারের সকলের খবরাখবর নেয়া। তার সব কটি কাজে আমাকে ওয়াকিবহাল করা। মনে হয় সহোদর। যেমন-মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দায়িত্ব আমার উপর। বাংলাদেশ বেতারে গীতিকারের জন্য পাণ্ডুলিপি জমার দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। ‘পরশমণি’ গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠান যেভাবেই হোক করতে হবে। চারটি বই প্রকাশের দায়িত্ব আমাকেই নিতে হবে। এসব দায়িত্ব আমিই নিয়েছিলাম এবং সুচারুরূপে পালন করেছিলাম। অন্যান্য অনেক বিষয়ে যখন যেখানে দরকার আমাকেই শেয়ার করেন। ফ্যামিলিগত বিষয়গুলোও স্বাচ্ছন্দে আমাকে বলেন। আমাকে ওয়াকিবহাল করেন। যা সচরাচর মানুষ করে না। কেন এত বিশ্বস্ততা আমি জানি না। আমি কি এ বিশ্বস্ততার মূল্যায়ন দিতে পারব বুঝতে পারি না।
শাহ আবদুল ওদুদের এ যাবৎ প্রকাশিত গানের বই ৪টি। ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ৯ নভেম্বর ১০১টি গান নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘দিলতরঙ্গ’। ২০০২ খ্রিষ্টাব্দের ১ জানুয়ারি ১২৩টি গান নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘প্রেমের মরা’। ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ১০৬টি গান নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘মধ্যে মায়া নদী’। অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬ খ্রি. ৫৭টি গান নিয়ে প্রকাশিত হয় ‘পরশমণি’। ‘দিলতরঙ্গ’ ও ‘প্রেমের মরা’ গ্রন্থ দুইটির ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকায় ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় পরিমার্জিত করে আবার প্রকাশ করা হয়।
এছাড়া শাহ আবদুল ওদুদ ২০১৯ খ্রি. একুশে গ্রন্থমেলায় সম্পাদনা করেন ‘আল¬ামা দুর্বিন শাহ’ গ্রন্থ। সম্পাদিত এ গ্রন্থে মরমি কবি দুর্বিন শাহের বিভিন্ন স্বাদের বহুল প্রচারিত ও জনপ্রিয় ৫১টি গান সংকলিত হয়। গ্রন্থের ফ্লাপ লিখেন বাংলাদেশ বেতারের গীতিকার মো. খালেদ মিয়া।
শাহ আবদুল ওদুদের গানে উঠে এসেছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের হাসি-কান্না, আবেগ-অশ্র“, আশা-আকাক্সক্ষা, জীবন-জিজ্ঞাসা, অন্যায়-অসংগতি, অত্যাচার-অবিচার, নির্যাতন-শোষণ, প্রেম-বিরহ, জীবাত্মা ও পরমাত্মার মিলনের সাবলীল এবং গতিশীল সহজ সরল উচ্চারণ। কালজয়ী এ গানগুলোতে সচেতন মানুষের জন্য অনেক ম্যাসেজ আছে।
গীতিকারের প্রতি অবিচার করা হবে যদি তার শাশ্বত, চিরন্তন, বাস্তব, জনপ্রিয় কিছু গানের উক্তি এখানে তুলে না ধরি। তাই কয়েকটি গানের অংশবিশেষ সন্নিবেশিত করা হলো। যেমন-
‘মাকুন্দা নদীর তীরে আমার জন্মস্থান/ নামটি শাহ আবদুল ওদুদ পেশা হলো গান/ গান গাই না শুধু লেখি/ গানের সুরে বন্ধুরে ডাকি/ দিদারের প্রত্যাশা রাখি ওলি আউলিয়ার শান। খাগহাটা পীরবাড়ি/ সুখে দুঃখে বসত করি/ ভাবের টানে দিলাম ছাড়ি মান কুলমান/ মাথায় রাখি লম্বা চুল/ জীবন নদীর পাইলাম না কুল/ মুর্শিদ মৌলা শাহ আবদুল মুকিতের চরণ ধুল মহা মূল্যবান \’
‘যে ডুবে না ভাবের জলে/ কী লাভ হয় বলো কাঁদিলে/ ফানাপীর শেখ না হলে হয়কি কালার দরশন।/ মুর্শিদ নাম যার হয়েছে সার/ শুকনা গাঙে নাও দৌড়ে তার/ মরা গাঙে ফুলের বাহার এ ওদুদের ফুটাইবানি নিরঞ্জন \’
‘ইলিম ছাড়া সাজলে ফকির ঘটিবে লাঞ্ছনা/ দেখা দেখি লম্বা চুল কেউ রাখিও না/ গান বাজনায় মজাইলে মন/ তরিকা জানে না সেজন/ হইল না তার সাধন ভজন জীবনটা তার বেফানা \’
‘মানুষ জাতি আল¬াহর সৃষ্টি বড়ই মূল্যবান/ মানুষকে যে নিন্দা করে সে বড় নাদান \’
‘জায়গা চিনে করো সেজদা, নইলে যাবে বেহুদা/ চোখ থাকতে দেখলে না খোদা, মানব জীবন অকারণ \’
‘গানে মিলে আত্মার আরাম/ খোদার শানে গাও অবিরাম/ অর্থ না বুঝলে হারাম, দলিলে প্রমাণ পাই \’
বাংলাদেশ বেতারের অনুমোদিত গীতিকার শাহ আবদুল ওদুদ মাটি, মানুষ ও প্রকৃতির গভীর সন্নিকটে মিশে থাকায় তার লেখায় কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া নেই। তিনি সহজ, সরল, সুন্দর ও সাবলীল ভাষায় হৃদয়ের সকল ভালোবাসা দিয়ে অত্যন্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে চিত্রায়ন করেছেন জাগতিক ও মহাজাগতিক অনেক বিষয়াশয়। ধ্যানী ব্যক্তি শাহ আবদুল ওদুদ অবসর সময়ে ধ্যানমগ্ন থেকে নিজের সাথে নিজে কথোপকথন করেন। স্রষ্টা-সৃষ্টি নিয়ে ভাবেন।
শাহ আবদুল ওদুদ ব্যক্তিগত জীবনে বিবাহিত। তার সহধর্মিণী আম্বিয়া বেগম একজন সুগৃহিণী। লেখালেখির জগতে সহধর্মিণীর যথেষ্ট প্রেরণা রয়েছে বলেই তিনি সফলতার দ্বারপ্রান্তে যেতে পেরেছেন।
তিনি ৬ ছেলে ও ৩ মেয়ে সন্তানের সফল জনক। তার ছেলে মেয়েরা হলেন যথাক্রমে শাহ আলিমুল ইসলাম, শাহ তাহেরা খাতুন শিউলী, শাহ আমিনুল ইসলাম রুবেল, শাহ হাজেরা খাতুন চামেলী, শাহ আরিফুল ইসলাম জুবেল, শাহ আমিরুল ইসলাম শাকিল, শাহ আনিসুল ইসলাম শাহিন, শাহ আজিজুল ইসলাম জামিল ও শাহ সোনিয়া বেগম জুই।
আমার অন্তরঙ্গ বন্ধু হলেও কোন দিন তুমি শব্দ উচ্চারণ করতে পারিনি। কারণ পীর সাহেব আপনি ছাড়া কোন বাক্য সম্বোধন করেন না। তাই স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে আপনি শব্দটি। একজন মহৎ, নিরহংকার, বন্ধুবৎসল, পরোপকারী মানুষ শাহ আবদুল ওদুদের জন্মদিনে তাকে প্রাণখোলা মরমি শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। সেই সাথে তার লেখালেখির আরও সফলতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করছি।