কবিতাভাবনার বিন্দুগুলো
ফকির ইলিয়াস
অর্জনের ছায়া মানুষকে জাগিয়ে রাখে। হাতে তুলে দেয় মোমবাতির আলো।
বলে দেয়- তুমি এগিয়ে যাও মানুষ। জীবনের সন্ধানে। প্রেমের সন্ধানে। সৃষ্টির সন্ধানে। আমি আজীবন একটা ঘোরলগ্ন কাল কাটিয়েছি। যা, আমার কবিতায় চিত্রিত হয়েছে বিবিধ আয়তনে।
আমি আমার শব্দবুননে নিজস্ব ছাপ রেখে যেতে চেয়েছি। ভেবেছি- তৃণলতায় ঘেরাই
হোক- তারপরও এটাই আমার সুশীতল নীড়।
ফকির ইলিয়াস এর পাঁচটি কবিতা
জয়াগৃহ
যারা ছেড়ে যাচ্ছে, তারা জানে না যাচ্ছে কোথায়। যারা ফিরে আসছে
তারা খুঁজে পাচ্ছে না ভিটের মাটিচিহ্ন। একটি শালিখের ছায়া দেখে
একজন ফেরারি পথিক চিনতে পারছে- জয়াগৃহের ছাদ। বাঁশের চালা,
নডবড়ে খুঁটি, বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া শ্রাবণরাতের ঝড়মায়া।
মায়া, মানুষের করতলে নদীঘোর রেখে যায়। তার রেখাগুলো দেখে
তারা তাকাতে পারে প্রিয়তমার গমনদৃশ্যের দিকে।
যে ঢেউসমগ্র ভাগ করা যায় না-
তার বুকেই আছড়ে পড়ে প্রচণ্ড ভালোবাসার শেষ ঝাপটা।
ভার্চুয়াল ভোরের দক্ষিণে
বার বার ভুলে যাই পাসওয়ার্ড। ভোরের উত্থান দেখে
আবারও নির্ণয় করি আমার চারপাশে জাগ্রত দক্ষিণ।
কে রেখে গেছে ছায়া, ভার্চুয়াল উষ্ণ আকাশে,- তা
খুঁজে উঁচু করি শির। তাকাবার কৌশল জানা ছিল বলে,
খুব সহজেই দেখে নিতে পারি মেঘাবৃত মনের গহীন।
গ্রামলিপি পাঠ করে ক`জন কিশোর কিশোরী এসে
দাঁড়িয়েছে এই ভোরের উত্তরে। ইচ্ছে হয়, জানতে চাই
তাদের কুশল। প্রশ্ন করি, তাদের মতো এই বন্ধ্যানদীও
কী শিখেছে আদৌ জুমল্যান্সের ব্যবহার ! দূর থেকে
কাছে দেখার গোপন বিনয়।
বার বার ল্যাপটপের আলো দেখে চিনে ফেলি , হারিয়ে
যাওয়া মুখবইয়ের ছবি। ডাকযোগে হাতে আসা
প্রাচীন চিঠিগুলো টেবিলের এককোণে স্থির, ঝাপসা
অক্ষরের বেদনায় দ্রবীভূত হয়।
আরতিপর্ব
রূপেরও রহস্য থাকে সাগরের বিনম্র কসমে
ঢেউগুলো হাত তুলে ডাক দেয় পূবের হাওয়ায়
আমিও তোমার হাতে হাত রেখে দেখি পুনরায়
পাখির বুকের দীঘি প্রেম হয়ে দূরাকাশে জমে।
জমে থাকি সারারাত, পাঁজরে পাঁজর রেখে হিম
প্রবাহের চারপাশে তুলে রাখি ফাগুনের রঙ
জাগে ভোর, নামে সন্ধ্যা- আরো কিছু তৃষ্ণা এবং
তুষারের মুখোমুখি লিখি নাম কামের অসীম।
সে কথা তুমিও জানো, ঋতুবতী মেঘের পরশে
সিক্ত পাথরগুলো ডানা মেলে মাটির গহীনে
মানব কুড়ায় বীজ, মানবীর দখিনা বাগানে
আবার হবেতো দেখা,সে আশায় পুষ্পজলে ভাসে।
আমার আরতি নাও, হে রমণী – বিপুল বিধানে
ঢেকে রাখো এ আকাশ ,কাছে থাকো সৌরভ্রমণে।
/
জ্যামিতিক ঝড়জীবন
ক.
ভেতরে গ্রহাণু জীবন। কেন তবে এলে এই রূপের নগরে
কেন তবে অশ্রুআলোয় দেখা কোনো মোম ও মন
চাইলে গলিয়ে দিতে ! কিংবা নিতে চাইলে শরতস্মৃতি
সবাই কি নিতে আসে ? সবাই কি দেখতে চায় অন্তঅধিকার !
জালুয়ারা জাল বিছিয়ে একদিন ধরতে চাইতো নদীদের মন
এখন আমরা ডট.নেটে পরস্পরের মুখোমুখি হই
শালুক সংশ্লেষণে আমাদের প্রতিবেশী পাতারা ও
ভেসে ভেসে জানিয়ে যায় তাদের নীরব একাকীত্ব
আরেকটু ভালোবাসা চাই
আরেকটু শব্দসোঁদামাটি
জীবন বিনিময় করে করে ,
আর বলে –
আমরাও রেখে যাবো ছিন্ন জলস্তুপ ……
খ.
রীতিতে সিদ্ধি নেই আমার। বিবিধ বন্দনা গাই । একহাতে
স্রোত ,অন্যহাতে সমুদ্র নিয়ে খেলে যাই রচনাখেলা। কখনো
চাঁদ বিষয়ক , কখনো চাষী বিষয়ক। বিষয় নির্বাচনে আমি
সবসময়ই আদিম। যদিও হিংস্র নই ,তবু ভাঙতে ভালো লাগে
আমার । কলাতন্ত্র , ঢেউবিদ্যা , আঁচড়ের প্রাণ।
যে পড়ে স্রোতসংবিধান
তার সাথে মিতালী খুঁজে
মাঝে মাঝে বিলবোর্ড বাঁধি।
আর পঠনে বসে চেয়ে দেখি তারে , সপ্তঅনাদি।
সূর্যের পরিণত ঘর
একটি রক্তজবা হাতে নিয়ে মা বললেন, আজ বৃষ্টি হবে। ভিজে যাবে
সবটুকু সবুজ জমিন। ঘেরুয়া নদীর জল থেকে রক্তবাষ্প উড়ে দেবে
জানান, এই মাটিতে আততায়ী রাত নেমেছিল। হায়েনা পিশাচদের
উল্লাস কাঁপিয়েছিল এই আকাশ। সূর্যের পরিণত ঘর। মানুষের বিত্ত
বিবর। আর লুকিয়ে থাকার সাঁকো খুঁজে শরণার্থী তরুণ-তরুণী
গিয়েছিল উত্তরের বাঁকে। অগ্রজ পূর্বসূরীর হাতের লাঠি গর্জে উঠেছিল
`থামো ঝড়, থামো বজ্র` এমন আওয়াজে।
সেই প্রভাতে আমি ছিলাম মায়ের বাম হাত ধরা অবুঝ বালক। বালিকা
বোনটি কেঁদেছিল,`বাবা ,বাবা `-বলে।
বাবা যুদ্ধে গিয়েছিলেন। একটি গ্রেনেড চার্জ করতে গিয়ে উড়ে গিয়েছিল
তার ডান হাত। তাই নিজ ডানহাতটিকে ভয়ে লুকিয়ে রাখতেন
আমার মা। আর বলতেন, দেখিস- আমার হাতটা যেন কেউ না দেখে।
তার ভয় ছিল খুব। বাবার হারানো ডানহাতটিকে তিনি মনে করতেন
নিজের হাত। বাবার চোখগুলোকে মনে করতেন নিজের চোখ।
সেই প্রভাতে আমার মায়ের নিজস্ব কোনো দৃষ্টি ছিল না। বৃষ্টি আসবে বলে
সকল মুক্তিযোদ্ধার দৃষ্টি দিয়ে তিনি তাকিয়েছিলেন আকাশের দিকে।
আর বলেছিলেন, বৃষ্টি আসুক। তবু মুছে যাবে না এই বাংলা থেকে
থোকা থোকা রক্তগোলাপের দাগ।
@
কবি পরিচিতি
ফকির ইলিয়াস আশির দশকের কবি । প্রাবন্ধিক,গল্পকার,গ্রন্থসমালোচক। সাংবাদিক হিসেবেও রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি। কয়েকটি সাহিত্যপত্র, ওয়েবম্যাগাজিনের সম্পাদনা পরিষদের সাথে যুক্ত। প্রবাসে বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টি- লালন ও চর্চায় তিনি নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা তেরোটি। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ-`অবরুদ্ধ বসন্তের কোরাস`, `বৃত্তের ব্যবচ্ছেদ`, `গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ`, `ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম` ` গৃহীত গ্রাফগদ্য` , `অনির্বাচিত কবিতা`। এছাড়াও `কবিতার বিভাসূত্র` (প্রবন্ধ সংকলন), `চৈতন্যের চাষকথা`(গল্প সংকলন),`অনন্ত আত্মার গান`(গীতি সংকলন)এর জন্য তিনি নন্দিত হয়েছেন পাঠক মহলে। তাঁর লেখা নিয়মিত ছাপা হচ্ছে ঢাকা ,কলকাতা, লন্ডন, নিউইয়র্ক, কানাডা, সুইডেন,ইতালী,অষ্ট্রেলিয়া, জাপানসহ দেশ-বিদেশের বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, ম্যাগাজিন, সাহিত্যপত্রে। ওয়েব, ব্লগ, ই-নিউজ গ্রুপেও তিনি লিখছেন নিয়মিত।
সাহিত্য কর্মের জন্য তিনি `ফোবানা সাহিত্য পুরষ্কার` , `ঠিকানা শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ পুরষ্কার` পেয়েছেন। তিনি দ্যা একাডেমি অব আমেরিকান পোয়েটস, দ্যা এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিষ্টস, আমেরিকান ইমেজ প্রেস, – এর সদস্য।স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন নিউইয়র্কে।